পাপের সীমাহীন বোঝা নিয়ে বিগত সরকারের পতন ঘটলেও তৎকালীন অপকর্মের সমাপ্তি পরিলক্ষিত নয়। বিশেষ করে নিত্যপণ্যের বাজারব্যবস্থায় বেপরোয়া সিন্ডিকেট কারসাজিতে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি রোধ করা যাচ্ছে না। জুলাই ২০২৪ ছাত্র–জনতার অসাধারণ গৌরবদীপ্ত গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে কিছুকাল দ্রব্যমূল্যের নিয়ন্ত্রণ দৃশ্যমান ছিল। নতুন করে চলমান সময়ে সিন্ডিকেট দৌরাত্ম্য প্রবল অনুভূত। ন্যূনতম দেশপ্রেম–মানবিকতা তাদের কদর্য চরিত্রকে কোনভাবেই স্পর্শ করতে পারছে না। বিপুল প্রাণ বিসর্জন ও অগণিত আহতদের আহাজারিতে দেশজুড়ে সবাই যারপরনাই যন্ত্রণায় কাতর। এমনিতেই আপামর জনসাধারণ বন্যাসহ নানামুখী প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিভিন্নভাবে পর্যুদস্ত। চাহিদা অনুসারে উৎপাদন আশানুরূপ না হলেও বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের বিচক্ষণতায় ডিমসহ খাদ্যদ্রব্য আমদানি বিশেষভাবে প্রশংসিত। অর্থলিপ্সু মানবরূপী দানবদের অতিমুনাফার লোভ কোনভাবেই যেন নির্বাসিত হচ্ছে না। বাজার নিয়ন্ত্রণে এসব অন্ধকারের শক্তির অপতৎপরতা অজানা কারণে রহস্যাবৃত।
নানাভাবে বাজার মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা থাকলেও মূল্যস্ফীতির কারণে নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনযাপন নাজুক অবস্থায় নিপতিত। প্রায় প্রতিদিন ইলেকট্রনিক মিডিয়ার বদৌলতে চাল–ডাল–মাছ–মাংস ও তরিতরকারিসহ যাবতীয় দ্রব্যাদির মূল্য ওঠা–নামার দৃশ্যাদৃশ্য অতিশয় হতাশাব্যঞ্জক। পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতাদের এক অপরের প্রতি অঙ্গুলি প্রদর্শনে পারস্পরিক দোষারোপ অসহনীয় পর্যায়ে ঠেকেছে। ফলশ্রুতিতে, সত্যিকার অর্থে দায়ী ব্যক্তি–প্রতিষ্ঠান সমূহ শনাক্ত করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি অনস্বীকার্য যে, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বাড়লে দেশের বাজারেও এর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু দেশে পণ্যের বাজারে কোনো ঘাটতি না থাকা সত্ত্বেও দাম বাড়ার যৌক্তিকতা কতটুকু তা নিয়ে জনমনে বিভ্রান্তির অন্ত নেই। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য সামান্য বৃদ্ধি পেলে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের তৎক্ষণাৎ মূল্য বাড়িয়ে অস্বাভাবিক পরিবেশ সৃষ্টির পাঁয়তারা যেন বেড়েই চলছে। পক্ষান্তরে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য পণ্যমূল্য কমানোর সময় তাদের অত্যন্ত ধীরগতির সাড়াও বৈরীতায় পরিপূর্ণ।
গণমাধ্যমে পরিবেশিত তথ্য–উপাত্ত বিশ্লেষণে প্রতিফলিত যে, অতিসম্প্রতি নানা অজুহাতে দেশের বাজারে ডিম, মুরগি, সবজি, কাঁচামরিচ, ভোজ্যতেল, চিনিসহ বেশ কিছু পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। সবচেয়ে বেশি অস্থিতিশীল ডিম ও কাঁচামরিচের দাম। কয়েকটি পণ্যের দাম কমেছে অতি সামান্য। সময়ের ব্যবধানে প্রধান খাদ্যশস্য চালের মূল্য বেড়েছে ১০ শতাংশ। নিত্যপণ্য থেকে শাবসবজির দাম বেড়েছে ৫ থেকে ৫০ শতাংশ। ডিমের বাজারে কারসাজি করে এরই মধ্যে কয়েক শত কোটি টাকা লুটে নিয়েছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। ডিমের বাজারে শৃঙ্খলা ফেরাতে সরকার দাম নির্ধারণ করে দিলে রাজধানী ঢাকা ও বন্দরনগরী চট্টগ্রামের প্রধান দুই পাইকারি বাজারে আড়তদাররা ডিম বিক্রি বন্ধ করে দেয়। সাধারণ খামারিদের অভিযোগ, করপোরেট সিন্ডিকেটের কারণে ডিমের দাম বাড়ছে। তাদের মতে, বাজারে ৮০ শতাংশ ডিম সরবরাহ করে খামারিরা এবং বাকি ২০ শতাংশ করে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো। অথচ করপোরেট গ্রুপ ডিমের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। তারাই সিন্ডিকেট করে বাজার অস্থির করে তোলে। পক্ষান্তরে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর দাবি, তারা সরকার নির্ধারিত দামেই ডিম বিক্রি করছে। গুজব ছড়িয়ে ডিমের দাম বাড়ানো হচ্ছে। তবে আড়তদাররা জানান, সরকার যে দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে তার চেয়ে বেশি দামে ডিম কিনতে হচ্ছে। ফলে তারা ডিম বিক্রি বন্ধ রেখেছে। বাজার সংশ্লিষ্টদের অভিমত, আড়তে ডিম বিক্রি বন্ধ থাকলে দাম আরও বৃদ্ধি পাবে। যদিও ১৬ অক্টোবর থেকে করপোরেট উৎপাদক ও খামারিরা সরকার নির্ধারিত দামে সরাসরি আড়তে ডিম সরবরাহের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে।
সিন্ডিকেটের অযাচিত হস্তক্ষেপ থেকে বাদ যায়নি সবজির মূল্যও। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর জ্বালানি তেলের দাম কমায় পরিবহণ খরচও হ্রাস পেয়েছে। পাশাপাশি কমেছে রাস্তার চাঁদাবাজি এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উৎপাত। এতদসত্ত্বেও পণ্যের দাম কমার বিপরীতে প্রতিদিনই বাড়ছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজধানীর খুচরা বাজারে বেশির ভাগ সবজির কেজি ১০০ টাকার ওপরে। কিছু সবজির দাম ৩০০ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। উক্ত প্রতিবেদনে আরও উপস্থাপিত যে, উৎপাদনকারী থেকে পণ্য ভোক্তা পর্যায়ে আসতে বেশ কয়েকটি ধাপ পেরোতে হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে– স্থানীয় ব্যবসায়ী, ব্যাপারী, ফড়িয়া, পাইকারি ব্যবসায়ী, খুচরা বাজার ইত্যাদি। প্রতিটি ধাপেই মূল্য বাড়ছে। সবকিছু যোগ করে নির্ধারণ হচ্ছে সবজির দাম। এর সঙ্গে লাভ যোগ করে খুচরা বিক্রেতা ভোক্তার হাতে পণ্য তুলে দিচ্ছেন। প্রাসঙ্গিকতায় কনজুমার্স অ্যসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গণমাধ্যমে বলেন, ‘মাঠে কৃষক আর বাজারে ভোক্তা উভয়েই ঠকছেন। বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতায় মধ্যস্বত্বভোগীরা অতি মুনাফা লুটছে। যদি কৃষক পর্যায় থেকে সরাসরি পাইকারি ও খুচরা বাজারে পণ্য বিক্রি করার উপায় থাকত, তবে মধ্যস্বত্বভোগীরা মুনাফা করতে পারত না। ক্রেতা কম দামে পণ্য কিনতে পারত।’
বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার নানা প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। পণ্যের যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণের পাশাপাশি সম্প্রতি কিছু পণ্যের শুল্ক–কর কমানো হয়েছে। আমদানির অনুমতিও দেওয়া হয়েছে কিছু পণ্যের। তাছাড়া টিসিবির পণ্য বিক্রি বাড়ানো, বাজার তদারকি সংস্থাগুলোর অভিযান বৃদ্ধি, সরবরাহ নিশ্চিতে সহযোগিতা ও জেলায় জেলায় টাস্কফোর্স গঠনসহ বিভিন্ন ইতিবাচক উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। গঠিত টাস্কফোর্সের কার্যপরিধিতে বলা হয়েছে– টাস্কফোর্স নিয়মিত বিভিন্ন বাজার–বৃহৎ আড়ত–গোডাউন–কোল্ড স্টোরেজ–সাপ্লাই চেইনের অন্যান্য স্থানগুলো সরেজমিন পরিদর্শন করবে এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যের যৌক্তিক পর্যায়ে রাখার বিষয়টি তদারক করবে। উৎপাদন, পাইকারি ও ভোক্তা পর্যায়ের মধ্যে যাতে দামের পার্থক্য নূন্যতম থাকে তা নিশ্চিত এবং সংশ্লিষ্ট সব স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করবে তারা। প্রতিটি জেলায় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে গঠিত এ টাস্কফোর্স প্রতিদিনের মনিটরিং শেষে একটি প্রতিবেদন তৈরি করবে। উক্ত প্রতিবেদন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দ্রব্যমূল্য পর্যালোচনা ও পূর্বভাস সেল এবং জাতীয় ভোক্তা–অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষে পাঠাবে। সর্বশেষ সরকার রাজধানীতে ওপেন মার্কেট সেলের (ওএমএস) আওতায় আলু, ডিম, পেঁয়াজ ও পটল বিক্রির যথার্থ পদক্ষেপ নিয়েছে।
ইতিমধ্যে দেশের সব বিভাগ ও জেলা পর্যায়ে সবজিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল ও সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার লক্ষ্যে টাস্কফোর্সসহ অভিযান পরিচালনা চলমান রেখেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। ১৪ অক্টোবর দেশের ৪৮টি জেলায় অধিদপ্তরের ৫৫টি টিম অভিযান পরিচালনা করে ১১৪টি প্রতিষ্ঠানকে ৬ লাখ ৩৪ হাজার টাকা জরিমানা করেছে। একই দিনে অন্তর্বর্তী সরকারের সম্মানিত অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ রাজধানীর কাওরান বাজার পরিদর্শন এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দোকান তদারকি করেন। পরিদর্শনকালে তিনি জানান, বন্যা–অতিবৃষ্টি ইত্যাদির কারণে ডিমের উৎপাদন হ্রাস পাওয়ার পাশাপাশি সবজিসহ কিছু পণ্যের উৎপাদন নষ্ট হয়েছে। যার ফলে সাপ্লাই চেইনে কিছুটা ঘাটতির কারণে এ সকল পণ্যের মূল্য কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি ব্যবসায়ীদের যৌক্তিক লাভ করে ব্যবসা করারও অনুরোধ করেন।
অর্থনীতিবিদদের মতে, বাজার নিয়ন্ত্রণে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হলেও সেগুলো পুরনো মডেলের। এগুলো অতীতেও নেওয়া হয়েছে। কিন্তু কার্যকর ফল মেলেনি। বাজার ব্যবস্থাপনায় বড় গলদগুলো এখনও রয়ে গেছে। এগুলো না শুধরে পুরনো কায়দায় যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, তাতে হিতে বিপরীত হচ্ছে। ক্রয়–বিক্রয়ে অনিয়ম–কারসাজি–সিন্ডিকেট–মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য ও চাঁদাবাজি কিছুই বন্ধ হয়নি। মূল্যবৃদ্ধির পুরনো বৃত্তেই বন্দি হয়ে আছে বাজার। আবার অনেকেই আগামী দিনগুলোতে দ্রব্যমূল্য আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। কারণ মূল্যস্ফীতি এখন বৈশ্বিক বাস্তবতা হয়ে উঠেছে, ব্যাহত হয়েছে বিশ্ব সাপ্লাই চেইন ও দেশেজ উৎপাদন এবং বিশ্বে চলমান যুদ্ধ–সংঘাত ও তেলের দাম বৃদ্ধির ফলে আমদানিকারকদের আত্মবিশ্বাস কমে যাওয়া ইত্যাদি।
দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যথেষ্ট উন্নয়ন সাধিত হলেও, অসাধু–অনৈতিক ব্যবসায়ীদের লোভ সংবরণ অনিয়ন্ত্রিত। দ্রুত সময়ের মধ্যে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি রোধ অনিবার্য। জনদুর্ভোগে দিনমজুর–শ্রমিক বা দৈনিক ভিত্তিতে কর্মজীবীরা দৈনন্দিন জীবনযাপনে অপরিমেয় সংকটে ভুগছে। গার্মেন্টসসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অহেতুক অরাজকতা সৃষ্টির চক্রান্ত–ষড়যন্ত্রের বিষয়টিও উচ্চকিত। অনেকের মতে, পতিত সরকারের এসব দুর্বৃত্তরা খোলস পাল্টিয়ে সমস্যা সমূহ তৈরি করছে। সরকারি গোয়েন্দা সংস্থাসহ জনগণের ঐক্যবদ্ধতায় এসব সিন্ডিকেট নির্মূল করা না গেলে সংকটের চৌহদ্দী দীর্ঘায়িত হবে। অসাধু ব্যবসায়ীদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ অতীব জরুরী হয়ে পড়েছে। অন্যথায় দেশবাসীর হতাশা অধিকতর অস্বস্তিকর পরিবেশ তৈরিতে সহায়ক হবে।
লেখক: শিক্ষাবিদ, সমাজ–অপরাধবিজ্ঞানী।