বর্তমান বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে বাংলাদেশের বয়স পঞ্চাশ পূর্ণ হলো। পঞ্চাশ বছর একটি দেশের জন্য কম নয়। দেশ হিসাবে বাংলাদেশ এখন শৈশব পেরিয়ে যৌবনে অবতীর্ণ হয়েছে।এখন গভীরভাবে ভাবা দরকার দেশের কোন কোন খাতকে আমরা অধিক গুরুত্ব দেবো। আরো একটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া দরকার সেটি হলো সরকারের নিয়ন্ত্রাধীন হাজার হাজার কোটি টাকা লস দেওয়া বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে আমরা কী করবো।একটু ভেবে দেখুন ব্যক্তি মালিকানাধীন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান শত শত কোটি টাকা লাভ করলেও একই ধরনের সরকারি প্রতিষ্ঠান হাজার হাজার কোটি টাকা লোকসান দেয়। সরকার যদি এই হাজার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি না দিয়ে উন্নয়ন খাতে খরচ করতো, তবে দেশে উন্নয়নের জোয়ার বয়ে যেতো ও দেশের চেহারা বদলে যেতো। একটু খেয়াল করলে দেখা যায়, সরকারি এমন কোন বাণিজ্যিক সেক্টর নেই যেটি লস দেয় না। আগে কয়েকটি সেক্টর সামান্য লাভ করতে পারলেও বর্তমানে প্রায় সব সরকারি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান লস দেয়। এর একটি বড় উদাহরণ হলো বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল করপোরেশন (বিএসইসি)। একসময় বিএসইসি অধীনে ৬৩টি প্রতিষ্ঠান ছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে এর প্রতিষ্ঠান সংখ্যা কমতে কমতে এখন ৯টিতে এসে ঠেকেছে। যার মধ্যে ৭টি বহুদিন থেকে লস দিচ্ছে, বাকি ২টি কিছুটা লাভ করতে পারলেও ২০২০ এ করোনার প্রকোপে বড় ধাক্কা খেয়েছে। ফলে সব কটি প্রতিষ্ঠানই এখন ধুঁকছে। তাই প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে। বর্তমানে বিএসইসি এর নয়টি কোম্পানি হলো, প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ লিঃ, গাজী ওয়্যারস লিঃ, এটলাস বাংলাদেশ, ন্যাশনাল টিউবস, ইস্টার্ন টিউবস, ইস্টার্ন কেবলস, জেনারেল ইলেকট্রিক ম্যানুফ্যাকচারিং কোঃ, বাংলাদেশ ব্লেড ফ্যাক্টরী, ঢাকা স্টিল ওয়ার্কস লিঃ। এর মধ্যে প্রথম দুইটি কোম্পানি সামান্য লাভ করতে পারলেও বাকী সাতটি কোম্পানি হলো লোকসানি প্রতিষ্ঠান।
বাংলাদেশ শিল্প প্রতিষ্ঠান(জাতীয়করণ) অধ্যাদেশ ১৯৭২ অনুযায়ী ১৯৭২ইং এর ১লা জুলাই গঠিত হয় বাংলাদেশ ইস্পাত কারখানা করপোরেশন এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল ও জাহাজ নির্মাণ করপোরেশন। পরে ১৯৭৬ সালে সংস্থা দুটিকে একীভূত করে গঠন করা হয় বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল করপোরেশন (বিএসইসি)। তবে লোকসানের কারণে বিএসইসি এর প্রতিষ্ঠানগুলো ছেড়ে দেওয়া শুরু হয় জিয়াউর রহমানের শাসনামলে। তাঁর আমলে ১৯৭৬-৮১ তে ২২টি কোম্পানি বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। পরে এরশাদের আমলে ১৯৮২-৯০ তে ১৮টি প্রতিষ্ঠান ছেড়ে দেওয়া হয় বেসরকারি খাতে। এরপর খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার আমলেও বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। এ ছাড়া অন্য সংস্থার অধীনে দেওয়া হয় কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে। যেমন মেশিন টুলস ফ্যাক্টরীকে দেয়া হয় বাংলাদেশ আর্মির অধীনে এবং ডকইয়ার্ড ও ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কসকে দেওয়া হয় বাংলাদেশ নৌবাহিনীর অধীনে।বর্তমানে বিএসইসি অধীনে চালু থাকা নয়টি কোম্পানির মধ্যে সবচেয়ে লাভজনক ও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে গাড়ি সংযোজন কারখানা প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড।১৯৬৬ সালে চট্টগ্রামের বাড়বকুণ্ডে ২৪.৭৫ একর জমির ওপর এটি স্থাপিত হয়। বর্তমানে এটির জনবল ৩২১জন এবং বছরে ১৫০০টি গাড়ি সংযোজনের ক্ষমতা রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির সংযোজিত গাড়ির মধ্যে রয়েছে কার, ট্রাক, জিপ, এম্বুল্যান্স, ট্রাক্টর, পিকআপ। আমাদের দেশে এই ধরনের গাড়ির প্রচুর চাহিদা রয়েছে। যদি প্রতিযোগিতাপূর্ণ মূল্যে ও সঠিকভাবে এর সংযোজিত পণ্যগুলো বাজারজাত করা যায় তবে শুধু এই প্রতিষ্ঠান থেকেই সরকারের শত শত কোটি টাকা মুনাফা হওয়ার কথা। প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রগতি এ পর্যন্ত মাত্র ৫০ হাজার গাড়ি সংযোজন করেছে। বিএসইসি সমপ্রতি প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজের পাঁচ বছরের উৎপাদন বিক্রি ও লাভ লোকসান নিয়ে একটি পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে।এতে দেখা যায় ২০১৫-১৬ সালে কোম্পানিটি ৫৮০ কোটি টাকার পণ্য উৎপাদন করে। ২০১৯-২০ বছরে উৎপাদন করে ৬৩২ কোটি টাকার পণ্য। মাঝে ২০১৮-১৯ বছরে করেছিলো ৮০৯ কোটি টাকার পণ্য। আর ২০২০-২১ এর প্রথম চার মাসে করে ১৩৯ কোটি টাকার পণ্য। এই পাঁচ বছরে কোম্পানি টির বিক্রি ৬৯৭ কোটি থেকে বেড়ে ৮৯৮ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে যদিও একই সময়ে মুনাফা ৯৪ কোটি থেকে কমে ৬১ কোটি হয়েছে। আর চলতি প্রথম চার মাসে মুনাফা হয়েছে মাত্র ৫৫ লাখ টাকা। প্রগতির গাড়ির সবচেয়ে বড় ক্রেতা সরকার নিজে। যদিও করোনা শুরু হওয়ায় অর্থ মন্ত্রণালয় এক আদেশে প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজকে ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ও পরে ৩০ শে জুন পর্যন্ত সব ধরনের গাড়ি কেনায় নিরুৎসাহিত করে।এতে করে প্রতিষ্ঠানটির মুনাফায় ধস নেমেছে বলে বিএসইসি কর্তৃপক্ষ মনে করে। অথচ দেশে বছরে শুধু রিকন্ডিশন্ড প্রাইভেট গাড়ির চাহিদা রয়েছে ১৬-২০ হাজারের মত। সেজন্য বেসরকারি কোম্পানিগুলো দেশীয় বাজারে ঠিকই হাজার হাজার গাড়ি বাজারজাত করছে। কিন্তু প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ তাদের দক্ষতার অভাবে গাড়ি বিক্রির ক্ষেত্রে এগিয়ে যেতে পারেনি। প্রশ্ন হলো, কেন বেসরকারি কোম্পানির সাথে তারা প্রতিযোগিতায় টিকতে পারে না? মুক্তবাজার অর্থনীতিতে সরকারি কোম্পানিকে আর কত দিন এই ধরনের একচেটিয়া সুবিধা দেওয়া হবে? বিএসইসির আরেকটি লাভজনক প্রতিষ্ঠান হলো গাজী ওয়্যারস। ১৯৬৭ সালে চট্টগ্রামের কালুরঘাটে চার একর জায়গার উপর এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। যার লোকবল ১৭৯ জন।এটি ইলেকট্রিক ট্রান্সফরমার ও মোটরের অন্যতম উপাদান সুপার এনামেল কপার ওয়্যার উৎপাদন করে। যার বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ৭০০টন। পাঁচ বছর আগে এটি ৭৬ কোটি টাকার পণ্য বিক্রি করলেও ২০১৯-২০ সালে তা কমে ৫৩ কোটি টাকায় নেমে এসেছে এবং মুনাফা কমেছে পাঁচ বছরের ব্যবধানে ১৬ কোটি হতে ১ কোটিতে। হয়ত সামনে এটিও লসে চলে যাবে। বিএসইসির আরেকটি সম্ভাবনাময় প্রতিষ্ঠান হলো এটলাস বাংলাদেশ। গাজীপুরের টংগিতে ৯.৬২ একর জায়গার উপর ১৯৬৬ সালে এটি স্থাপিত হয়। এটি প্রথমে হোন্ডা কোম্পানি লিমিটেডের সাথে যৌথভাবে উৎপাদন শুরু করে।পরে ১৯৯৩ সালে ব্যবসা শুরু করে ভারতীয় হিরো মোটর সাইকেলের সঙ্গে। ২০১১ সালে জাপানের হোন্ডার সাথে ভারতীয় হিরোর অংশীদারত্ব ছিন্ন হয়। ফলে এটলাসের সাথে হিরোর সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ায় ২০১৪ সালে এটলাসের উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। পরে ২০১৫ সালে অগাস্ট থেকে চীনের জংশন গ্রুপের সাথে আবার ব্যবসা শুরু করে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ৭০০০ মোটর সাইকেল। অন্য দিকে দেশে বছরে লক্ষাধিক মোটর সাইকেলের চাহিদা রয়েছে। শুধু সরকারি প্রতিষ্ঠান হওয়ায় এতো দীর্ঘ সময়েও এটলাস একটি নিজস্ব ব্যান্ড তৈরী করতে পারেনি। বর্তমানে এটলাসের উৎপাদিত মোটর সাইকেলের দাম ক্ষেত্রবিশেষে ৪৯ হাজার হতে সর্বোচ্চ ১ লাখ ৩৫ হাজার টাকা। এতো সস্তায় মোটরসাইকেল বিক্রি করলেও এটলাস মুনাফা করতে পারছে না, যা সত্যি বিস্ময়কর। বিএসইসির তথ্য মতে পাঁচ বছর আগের চেয়ে এটলাসের উৎপাদন ও বিক্রি দেড়গুণ বেড়েছে। এতে লোকসানের পরিমাণও বেড়েছে। ২০১৫-১৬ সালে লোকসান ছিলো ৩ কোটি টাকা, ২০১৯-২০ সালে লোকসান বেড়ে হয়েছে ৪ কোটি ২০ লাখ টাকা আর চলতি ২০২০-২১ এর প্রথম চার মাসে লোকসান হয়েছে ২.৫ কোটি টাকা। যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। অথচ মোটর সাইকেল কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে ব্যবসা করে হাজার হাজার কোটি টাকা আয় করছে। এভাবে খতিয়ে দেখলে দেখা যায় বিএসইসির দু’টি বাদে সাতটি প্রতিষ্ঠানই ধারাবাহিকভাবে লোকসানের মধ্যে রয়েছে। অথচ বিএসইসির অধীন প্রতিটি প্রতিষ্ঠান মুনাফা করতে পারতো যদি এগুলো বেসরকারিভাবে পরিচালিত হতো, তাহলে গলদটা কোথায়? সময় এসেছে এই প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে নতুন করে ভাবনার।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট