সরকারি প্রতিষ্ঠানের জন্য পঞ্চবার্ষিকী কর পুনর্মূল্যায়নে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) ওপর আরোপিত স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করেছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। তবে বেসরকারি হোল্ডিংয়ের জন্য পূর্বের স্থগিতাদেশ বহাল থাকবে। গতকাল রোববার এ সংক্রান্ত নির্দেশনা পেয়েছে চসিক। নির্দেশনার আলোকে নগরে বিদ্যমান সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের হোল্ডিংয়ের বিপরীতে পুনর্মূল্যায়িত পৌরকর আদায় করা যাবে। যা (পুনর্মূল্যায়ন) বেসরকারি হোল্ডিংয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। এর আগে করদাতাদের আন্দোলনের মুখে ২০১৭ সালে অ্যাসেসমেন্ট কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছিল। চসিকের রাজস্ব শাখা সূত্রে জানা গেছে, পুনর্মূল্যায়িত গৃহকর আদায় করতে পারলে শুধু সরকারি প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে ২২৩ কোটি ৪১ লাখ ৯ হাজার ৭৯১ টাকা বেশি আয় হবে। চলতি অর্থবছরে এক হাজার ৫১৬টি সরকারি হোল্ডিংয়ের পৌরকর ধার্য করা হয়েছে ৫৬ কোটি ৫৯ লাখ ৮৭ হাজার ৬৮ টাকা। অথচ স্থগিত হওয়া পুনর্মূল্যায়নে সরকারি হোল্ডিংয়ের সংখ্যা ছিল দুই হাজার ৫৪৮টি। এতে প্রস্তাবিত পৌরকর ছিল ২৮০ কোটি ৯৬ হাজার ৮৫৯ টাকা। এর মধ্যে শুধু চট্টগ্রাম বন্দরের বিপরীতে প্রস্তাবিত পৌরকর হচ্ছে ১৬০ কোটি ১৬ লাখ ৪১ হাজার ১৬২ টাকা। বর্তমানে বন্দর কর্তৃপক্ষের ধার্যকৃত পৌরকরের পরিমাণ হচ্ছে সাড়ে ৩৯ কোটি টাকা।
যে কারণে স্থগিত হয়েছিল : ২০১৭ সালের ১০ ডিসেম্বর চসিকের পঞ্চবার্ষিকী করপুনর্মূল্যায়ন স্থগিত রাখার নির্দেশনা দিয়েছিল স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। এর আগে পৌরকর নির্ধারণে চসিক ২০১৬ সালের ২০ মার্চ প্রথম দফায় নগরীর ১১টি ওয়ার্ডে ‘অ্যাসেসমেন্ট’ (ভবনের পুনর্মূল্যায়ন) শুরু করে এবং একই বছরের ২০ জুন শেষ হয়। দ্বিতীয় দফায় ২০১৬ সালের ১৮ অক্টোবর অবশিষ্ট ৩০টি ওয়ার্ডে অ্যাসেসমেন্ট শুরু করে এবং তা শেষ হয়েছে ২০১৭ সালের ১৫ জানুয়ারি। পঞ্চবার্ষিকী কর পুনর্মূল্যায়ন শেষে তা ২০১৭ সালের ৩১ আগস্ট জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয়। এতে দেখা গেছে, নগরীতে হোল্ডিং রয়েছে ১ লক্ষ ৮৫ হাজার ২৪৮টি। এসব হোল্ডিংয়ের বিপরীতে ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে ৮৫১ কোটি ৩০ লাখ ৬৪ হাজার ৫৫৯ টাকা পৌরকর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে চসিক। যা পূর্বের অর্থবছরে ছিল ১০৩ কোটি ৪৪ লাখ ১৮ হাজার ৫৩৭ টাকা।
জনসম্মুখে চসিকের অ্যাসেসমেন্টর বিষয়টি প্রকাশ হওয়ার পর প্রস্তাবিত পৌরকরের বিরুদ্ধে আপত্তি জানান ভবন মালিকরা। বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে তারা মাঠে নামেন। এক্ষেত্রে চট্টগ্রাম করদাতা সুরক্ষা পরিষদ নামে একটি সংগঠন ধারাবাহিক কর্মসূচি পালন করে। প্রয়াত মেয়র মহিউদ্দীন চৌধুরী এবং চসিকের বর্তমান প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজনও এর বিরোধিতা করেন। ২০১৭ সালের ১৬ নভেম্বর গৃহকর বৃদ্ধি করায় জাতীয় সংসদেও ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন মন্ত্রী-এমপিরা।
এর প্রেক্ষিতে একই বছরের ২৬ নভেম্বর স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে বৈঠক করেন মন্ত্রণালয়টির শীর্ষ কমর্তকর্তারা। এতে সারা দেশের হোল্ডিং ট্যাক্স কার্যক্রম অটোমেশনের আওতায় না আসা পর্যন্ত অ্যাসেসমেন্ট স্থগিতের সিদ্ধান্ত হয়, যা ১০ ডিসেম্বর চসিককে পত্র দিয়ে জানিয়ে দেয় মন্ত্রণালয়। অবশ্য এর আগে মৌখিক নির্দেশনার প্রেক্ষিতে ২৭ নভেম্বর থেকে অ্যাসেসমেন্ট কার্যক্রম স্থগিত করেছিল চসিক। স্থগিতের আগের দিন পর্যন্ত ৬৭ হাজার ৩৫২ জন হোল্ডার আপিল করেন এবং এর মধ্যে ৩ হাজার ৯৭৮টি আপিল নিষ্পত্তিও করা হয়ছিল।
পুনরায় উদ্যোগ নেন প্রশাসক : একসময় অ্যাসেসমেন্ট কার্যক্রমের বিরোধিতা করলেও সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর স্থগিত হওয়া অ্যাসেসমেন্টের আলোকে গৃহকর আদায়ে উদ্যোগ নেন খোরশেদ আলম সুজন। ২২ সেপ্টেম্বর তিনি সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে স্থগিত হওয়া পঞ্চবার্ষিকী কর মূল্যায়নের আলোকে হোল্ডিং ট্যাক্স আদায় করার জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে অনুমতি চেয়ে পত্র দেন।
পত্রে তিনি লিখেন, ১৯৮৬ সালের ২১ নং বিধান অনুযায়ী পাঁচ বছর পর পর কায়িক অনুসন্ধানের মাধ্যমে গৃহকর পুনর্মূল্যায়নের এখতিয়ার সিটি কর্পোরেশনের আছে। সে আলোকে ২০১৬-২০১৭ সালে চসিক পুনর্মূল্যায়ন কার্যক্রম গ্রহণ করলেও কর আদায়ের প্রাক্কালে বিভিন্ন মহলের বিরোধিতার কারণে এবং স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ২০১৭ সালের ১০ ডিসেম্বর গৃহকর কার্যক্রম পুনর্মূল্যায়ন স্থগিত রাখার নির্দেশনা দেয়। তাই সেটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।
এছাড়া বিভিন্ন সময়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রীর সঙ্গে ব্যক্তিগত সাক্ষাতেও এ বিষয়ে সহযোগিতা চান। চসিকের শীর্ষ কর্মকর্তারাও মন্ত্রণালয়ের পদস্থ কর্মকর্তাদের কাছে এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ চান। এর প্রেক্ষিতে গতকাল স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করা হয়।
সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য : স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের বিষয়টি নিশ্চিত করে চসিক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন আজাদীকে বলেন, শুধু সরকারি হোল্ডিংয়ের বিপরীতে পুনর্মূল্যায়িত গৃহকর আদায় করা হবে। অ্যাসেসমেন্ট তো আগে থেকে করা আছে। সেই আলোকে আদায় করব। সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে পঞ্চবার্ষিকী পুনর্মূল্যায়নের আলোকে কর আদায় করতে পারলে সিটি কর্পোরেশনের আয় বেড়ে যাবে এবং সাধারণ মানুষের ওপর চাপ পড়বে না। বেসরকারি হোল্ডিংয়ের বিষয়ে তিনি বলেন, তাদের কাছ থেকে আগের নিয়মেই আদায় করব। তবে গত পাঁচ বছরে যাদের ভবন সম্প্রসারণ হয়েছে সেই বর্ধিত ভবনের বিপরীতে কর আদায় করা হবে।
চসিকের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মো. মুফিদুল আলম আজাদীকে বলেন, চলতি অর্থবছর থেকেই অ্যাসেসমেন্টের আলোকে কর আদায় করব। সেজন্য সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে ডিমান্ড নোটিশ ইস্যু করব।
চট্টগ্রাম করদাতা সুরক্ষা পরিষদের সমন্বয়ক হাসান মারুফ রুমি আজাদীকে বলেন, সরকার-বেসরকারি সব ক্ষেত্রে গৃহকর নির্ধারণে আইন কিন্তু একটাই। এখন একই আইন আলাদা আলাদা কিভাবে বাস্তবায়ন করা হবে? এক্ষেত্রে সরকারি প্রতিষ্ঠান আপত্তি জানালে বেসরকারির ওপরও তো চাপানো হতে পারে। কাজেই এখানে বিশৃক্সখলা হওয়ার আশঙ্কা আছে। যদি বেসরকারি থেকে বর্ধিত পৌরকর আদায় করা হয় তাহলে আমরা আবার আন্দোলনে যাব।