সরকারি কর্মকর্তাসহ জড়িত দুই ডজনের অধিক ব্যক্তি চিহ্নিত

বিপিসির ৭ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পে জমি হুকুম দখলে দুর্নীতি দুদকের চার্জশিট চূড়ান্ত

আজাদী প্রতিবেদন | সোমবার , ২৬ জুলাই, ২০২১ at ৫:৪৯ পূর্বাহ্ণ

২০২০ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি র‌্যাবের অভিযানে ঘুষের ৯৩ লাখ ৬০ হাজার ১৫০ টাকাসহ কক্সবাজার এলএ শাখার সার্ভেয়ার ওয়াশিম খান গ্রেপ্তারের মামলা তদন্তে নামে দুর্নীতি দমন কমিশন। তদন্তে নেমে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের অর্থায়নে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকার এসপিএম (সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং) প্রকল্পের জমি হুকুম দখলের নামে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনা বেরিয়ে আসে। ঘটনায় জড়িত মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব, জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারী, জনপ্রতিনিধি, দালালসহ প্রায় দুই ডজনের অধিক ব্যক্তিকে চিহ্নিত করেছে দুদক। ইতোমধ্যে ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্রও চূড়ান্ত হয়েছে।
বিপিসি সূত্রে জানা গেছে, ২০১০ সালে ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের (ইআরএল) মাধ্যমে সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করে বিপিসি। পরে নানা জটিলতা কাটিয়ে একাধিকবার সংশোধিত হয়ে ২০১৬ সালের ১৮ আগস্ট ৫ হাজার ৪২৬ কোটি ২৬ লাখ ৮৩ হাজার টাকার প্রকল্পটির প্রশাসনিক অনুমোদন দেয় জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ। ২০১৬ সালের ৮ ডিসেম্বর চায়না ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না পেট্রোলিয়াম পাইপলাইন ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেডের (সিপিপিইসিএল) সাথে চুক্তি করে বিপিসি। ২০১৮ সালের ১৪ মে থেকে কাজ শুরু করে ঠিকাদার। গত বছরের ৬ জুলাই আরো এক দফায় সংশোধিত হয়ে ১ হাজার ১৪২ কোটি টাকা বাড়ে প্রকল্পটির ব্যয়। পরবর্তীতে মাতারবাড়ি চ্যানেলকে ঝুঁকিমুক্ত করতে আরও ৩৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রায় দেড় কিলোমিটার পাইপলাইন সমুদ্রতটের ৩০ ফুট গভীরে বসানোর কাজও শেষ করেছে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। সব মিলিয়ে প্রকল্পের ব্যয় দাঁড়াবে ৬ হাজার ৯২৮ কোটি টাকা। ২০২২ সালের ৩০ জুন প্রকল্প সম্পন্ন হওয়ার কথা রয়েছে।
এসপিএম নির্মাণের পাশাপাশি প্রকল্পের আওতায় মহেশখালীর মাতারবাড়ি উপকূলে ৫০ হাজার মেট্রিক টন ধারণক্ষমতার তিনটি ক্রুড অয়েল স্টোরেজ ট্যাংক এবং ৩০ হাজার মেট্রিক টন ধারণক্ষমতার তিনটি ডিজেল স্টোরেজ ট্যাংক নির্মাণ করা হচ্ছে। মহেশখালীতে তৈরি করা হচ্ছে পাম্প স্টেশন, স্কাডা সিস্টেম ও ফায়ার ফাইটিং সিস্টেম। নির্মাণ করা হচ্ছে দুটি সংযোগ সড়কও। এসব কাজ করার জন্য কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে (এলএ মামলা নং ০৮/২০১৭-২০১৮ মূলে) মহেশখালী উপজেলার সোনাপাড়ায় কালারমারছড়া, ঝাপুয়া ও ধলঘাট মৌজার ১৪৪ দশমিক ৫০৮ একর জমি হুকুম দখল করা হয়। হুকুম দখলের আওতায় বার্ষিক উৎপাদিত ফসলের ক্ষতিপূরণ প্রদানের মাধ্যমে অধিযাচন/হুকুম দখলের আওতায় আনা হয়। এ লক্ষ্যে ২০১৮ সালের ১৭ মে ইস্টার্ন রিফাইনারি ও কক্সবাজার জেলা প্রশাসন যৌথ তদন্ত সম্পন্ন করে ক্ষতিগ্রস্ত পান বরজ, বোরো ধান, লবণ চাষ ও অন্যান্য ফসলের বর্গাচাষিদের তালিকা প্রস্তুত করা হয়।
সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুমদখল আইন-২০১৭ অনুযায়ী, অধিগ্রহণকৃত জমির ক্ষেত্রে জমির মালিক ক্ষতিপূরণ পেলেও হুকুম দখলের ক্ষেত্রে বর্গাচাষি ফসলের ক্ষতিপূরণ প্রাপ্য হবেন। কিন্তু সার্ভেয়ার ওয়াশিম খানের মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া অন্য আসামিদের আদালতে দেওয়া ১৬৪ ধারার জবানবন্দি ও মামলার তদন্তে দুদক কর্মকর্তারা জানতে পারেন, যৌথ তদন্তে প্রস্তুত করা ফিল্ড বইয়ে উল্লেখ করা ক্ষতিগ্রস্ত চাষিদের ক্ষতিপূরণের টাকা না দিয়ে জেলা প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও দালালদের যোগসাজশে হুকুম দখলের টাকা ভূমির মালিকদের দেওয়ার মাধ্যমে ৩০-৩৫ শতাংশ কমিশন নিয়ে আত্মসাৎ করেছেন। প্রকল্পের ক্ষতিগ্রস্তদের কোনো নোটিশ দেওয়া হয়নি। বরং নোটিশ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে গোপন করে মনগড়া জমির মালিকদের নামে রোয়েদাদ ও ২২ ধারার নোটিশ তৈরি করা হয়। ভূমি অধিগ্রহণ শাখা থেকে এলএ নোটিশের কপি ও এডভাইস সংক্রান্তে মূল রেকর্ডপত্র গায়েব করা হয় বলেও নিশ্চিত হন দুদকের তদন্তকারীরা।
তদন্তকালে দুদক কর্মকর্তারা জানতে পারেন, নুরুল ইসলাম বাহাদুর নামের এক দালাল একটি দলিল দুই জায়গায় ব্যবহার করে ক্ষতিপূরণের টাকা উত্তোলন করেছেন। পরবর্তীতে প্রকল্প এলাকায় ক্ষতিগ্রস্ত চাষিরা ২০১৯ সালের ২৭ জানুয়ারি কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগ দেন।
তাছাড়া স্থানীয় এক জনপ্রতিনিধির এসপিএম প্রকল্পে নিজের জমি না থাকা সত্ত্বেও অবৈধভাবে ৫টি গভীর নলকূপের ক্ষতিপূরণের জন্য ৭ লক্ষ ৯২ হাজার টাকা এবং এসপিএম প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহণকৃত বন বিভাগের জমি হতে ঘরবাড়ি উচ্ছেদের নামে চায়না ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান থেকে চেকের মাধ্যমে কক্সবাজারের একটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের শাখায় নিজ হিসাবে ৯ কোটি ৫৫ লক্ষ ১ হাজার টাকা নিয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের না দিয়ে নিজেরাই আত্মসাৎ করার বিষয়ে নিশ্চিত হন তদন্ত কর্মকর্তা। এ নিয়ে দণ্ডবিধির ১৬১, ১৬২, ২০১, ৪০৯, ৪২০, ৪৬৭, ৪৬৮, ৪৭১, ১০৯ ধারা, মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের ৪ (২) ধারা তৎসহ ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫ (২) ধারায় অভিযোগপত্র দেওয়ার বিষয়টি চূড়ান্ত করেছেন বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে মামলার বাদী ও তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের উপ-সহকারী পরিচালক শরীফ উদ্দিন কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংশ্লিষ্ট আরেক কর্মকর্তা আজাদীকে বলেন, ইতোমধ্যে অভিযোগপত্র প্রস্তুত হয়েছে। প্রায় ২৫-২৬ জনকে আসামি করা হতে পারে; যাতে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা, অতিরিক্ত ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা, কানুনগো, সার্ভেয়ার, অফিস সহকারী, স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও চিহ্নিত দালাল রয়েছে। তাদের অনেকে ঘুষ লেনদেন করেছেন। প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের টাকা না দিয়ে নিজেরাই আত্মসাৎ করেছেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিয়ের ৫ দিন পর শ্বশুর বাড়িতে যুবকের গলাকাটা লাশ
পরবর্তী নিবন্ধমানুষ ঢুকছে নগরে গাড়িও বেড়েছে