পদ্মা অয়েল কোম্পানির ৫০ লাখ লিটার ডিজেলের চাহিদা ছিল গোদনাইল ডিপোতে। জাহাজে করে এই তেল নিতে তিনটি অয়েল ট্যাংকার লাগত। যেতে কমপক্ষে ২৪ ঘণ্টা সময় লাগত। জাহাজ থেকে তেল খালাস করে ডিপোতে নিতে প্রতিটি জাহাজের জন্য লাগত কমপক্ষে আরো ১৫ ঘণ্টা। এতে তিনটি জাহাজের তেল খালাসে সময় লাগত ৪৫ ঘণ্টা। অথচ পদ্মা অয়েল কোম্পানির চাহিদার প্রায় ৫০ লাখ লিটার ডিজেল পাইপলাইনে গোদনাইলে পৌঁছল মাত্র বারো ঘণ্টায়।
অপরদিকে উক্ত ৫০ লাখ লিটার তেল চট্টগ্রাম থেকে গোদনাইল পাঠাতে অয়েল ট্যাংকারগুলোকে দশমিক ১৭ শতাংশ সিস্টেম লস ছাড় দিতে হতো। অর্থাৎ সাড়ে ৮ হাজার লিটার তেল নষ্ট হতো। কেউ কেউ এই নষ্টকে চুরি বলে থাকে। তেল পরিবহনের আড়ালে এই চুরি বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের বা বিপিসি কর্তৃক স্বীকৃত। কিন্তু গতকাল পদ্মা অয়েল কোম্পানি চট্টগ্রাম থেকে দেওয়া ৪৯ লাখ ৫২ হাজার ৮৪ লিটার তেলের পুরোটাই গোদনাইলে রিসিভ করেছে। এক লিটার তেলও এদিক–সেদিক হয়নি। বিষয়টি কেবলমাত্র চট্টগ্রাম–ঢাকা পাইপলাইনের কারণেই সম্ভব হয়েছে। দেশের জ্বালানি তেল পরিবহনের জন্য ২০১৮ সালে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকামুখী পাইপলাইনে জ্বালানি তেল সরবরাহের প্রকল্প হাতে নেয় বিপিসি। ২০২০ সালের ৩০ জুন প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও করোনাসহ নানা জটিলতায় কাজ শুরু হয় ২০২২ সালে। এরপর নানা চ্যালেঞ্জ ও প্রতিকূলতা পার করে অবশেষে পুরোপুরি চালু হলো বহুল প্রত্যাশিত পাইপলাইন।
পরীক্ষামূলক তেল পরিবহন সফল হওয়ার পর এর বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু হওয়ার প্রথম ধাপে পদ্মা অয়েল কোম্পানি গতকাল উপরোক্ত ৫০ লাখ লিটার ডিজেল চট্টগ্রাম থেকে গোদনাইল নিয়েছে। সেনাবাহিনীর সহায়তায় প্রায় তিন হাজার ৭০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত পাইপলাইনটি নির্মাণ করা হয়।
বিপিসি সূত্র বলছে, এটি দেশের অভ্যন্তরে স্থলভাগে চালু হওয়া প্রথম তেল পরিবহন পাইপলাইন। এর আগে অবশ্য ভারত থেকে বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইন নামে একটি পাইপলাইন নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া সমুদ্র থেকে অপরিশোধিত তেল খালাসের জন্য পৃথক একটি পাইপলাইন নির্মাণ করছে বিপিসি।
বিপিসি বলছে, দেশে সবচেয়ে বেশি তেল পরিবহন হয় চট্টগ্রাম–গোদনাইল পথে। মূলত চট্টগ্রাম থেকে নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল পর্যন্ত অয়েল ট্যাংকারে করে তেল আনা হয়। এই পথে একটি অয়েল ট্যাংকার আসতে অন্তত ২৪ ঘণ্টা সময় প্রয়োজন হয়। কিন্তু পাইপলাইনে তেল আনা হলে মাত্র ৪ ঘণ্টায় তেল পৌঁছে যাবে। এছাড়া পাইপলাইনে তেল আনা হলে সিস্টেম লস থাকবে না। অয়েল ট্যাংকারে দুই দফা তেল লোড–আনলোডের কারণে সিস্টেম লস হয়। এছাড়া নদীর মাটি ও পানির সঙ্গে তেল মিশে পরিবেশ দূষণ হয়। কিন্তু পাইপলাইনে তেল পরিবহন করা হলে এই দূষণ হবে না। পাইপলাইনে ৫০ লাখ লিটার জ্বালানি তেল পরিবহনের প্রথম চালানে বিপিসির দাবির পুরোপুরি সত্যতা মিলেছে। এক লিটার তেলও চুরি হয়নি। নির্ধারিত সময়ে চট্টগ্রামের তেল গোদনাইল পৌঁছে গেছে।
বিপিসির দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় অয়েল ট্যাংকারে তেল পরিবহনে এখন প্রতি বছর বিপিসির ব্যয় হয় ৩২৬ কোটি টাকা। কিন্তু পাইপলাইন চালু হলে ব্যয় হবে ৯০ কোটি টাকা। এতে বছরে অন্তত ২২৬ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। একই সঙ্গে আবহাওয়ার কারণে অনেক সময় জ্বালানি তেল পরিবহনে সমস্যার সৃষ্টি হয়। পাইপলাইনে পরিবহন করা হলে নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
পাইপলাইনটির মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ২৫০ কিলোমিটার। এর মধ্যে ১৬ ইঞ্চি ব্যাসের পাইপ ২৪১ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে পতেঙ্গা থেকে নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল পর্যন্ত এবং ১০ ইঞ্চি ব্যাসের পাইপ ৮.২৯ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ফতুল্লা ডিপো পর্যন্ত ডিজেল পৌঁছায়। পথে রয়েছে ২২টি নদী ও খাল, যার নিচ দিয়ে এই পাইপলাইন গেছে। পুরো সিস্টেমে মোট ৯টি পাম্পিং স্টেশন রয়েছে। প্রকল্পটিতে আধুনিক স্কাডা (কম্পিউটারাইজড) সিস্টেম সংযোজন করা হয়েছে। অর্থাৎ পাইপলাইনটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত হবে। কোথাও সমস্যা সৃষ্টি হলে পাইপলাইনটি অটোমেটিক সিগন্যাল দেবে। এতে পাইপলাইন থেকে তেল চুরি করা অসম্ভব বলে মনে করা হচ্ছে।