দৈনিক আজাদীর সাবেক সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ ছিলেন চট্টগ্রামের সাংবাদিকতার জগতে একজন পথিকৃৎ। প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ আবদুল খালেকের পদাঙ্ক অনুসরণ করে তিনি সৎ সাংবাদিতার ইতিহাসে অনন্য ভূমিকা পালন করে গেছেন। রাজনৈতিক অঙ্গনেও তিনি ছিলেন বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার এক আলোকবর্তিকা। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবেও তাঁর ভূমিকা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনের বিশ্বস্ত সহচর।
অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ ব্যক্তিগতভাবে অমায়িক মানুষ ছিলেন, তাঁর মধ্যে সামান্যতম অহংবোধও ছিল না। ছিলেন নির্লোভ ও নিঃস্বার্থ। এরকম মানুষ সমাজে বিরল। সমাজ ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থান করেও তিনি পায়ে দলে গেছেন সব রকমের লোভ-লালসার ভিত্তি, উপেক্ষা করেছেন যাবতীয় হাতছানি। অনেক সুযোগ তাঁর কাছে অবারিত ছিলো। কিন্তু সেই বিত্ত সম্পদ-আরাম-আয়েশের লোভ সামলে নিয়ে সমাজের অনন্য বটবৃক্ষ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। সব মানুষ এ ধরনের লোভ সংবরণ করতে পারেন না, অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের মতো প্রবল মানসিক শক্তির অধিকারী মানুষরাই কেবল পারেন। একজন মানুষ হিসেবে তিনি মানুষের জন্যই নিবেদিত ছিলেন। পদ পদবীর জন্য তার কোনো আকাঙ্ক্ষা ছিল না। তাঁর আরাধ্য ছিল মানুষের কল্যাণ ও সমাজের প্রগতি। একজন সৎ মানুষ হিসেবে তাঁর সততার মাপকাঠি ছিল অনন্য উচ্চতায়। এ কারণেই তিনি আমাদের অন্তরে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
ভাষাবিজ্ঞানী শিক্ষাবিদ ড. মনিরুজ্জামান বলেছেন : ‘প্রফেসর মোহাম্মদ খালেদ জীবিতকালেই প্রমাণ করলেন এই ক্ষয়িষ্ণু সমাজে তিনি শুধু কিংবদন্তিতুল্য এক মহান ব্যক্তিত্বই নন, তিনি আমাদের কাঙ্ক্ষিত সর্বোদয় উত্থানের পথে আশাপ্রদ ও অপরিহার্য অর্জন এবং আশ্রয়’। জীবিতকালে অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ যেমন আমাদের আশ্রয় ছিলেন, তেমনি মৃত্যুর পরেও ভূমিকা পালন করছেন পথ প্রদর্শকের। তাঁর অপরিসীম কল্যাণ ও শুভবোধ আমাদের উদ্দীপ্ত করে, তাঁর সততা ও কর্মনিষ্ঠ মনোভাব আমাদের প্রতিনিয়ত উৎসাহিত করে এবং মানুষের প্রতি মমতা ও দেশ-জাতির প্রতি তাঁর দায়বদ্ধ থাকার অন্তর্গত প্রেরণা আমাদের অঙ্গীকারবদ্ধ করে তোলে। তিনি আমাদের আলোকিত পুরুষ ও আদর্শবান ব্যক্তিত্ব। মৃত্যুর আগেও, মৃত্যুর পরেও।
অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ ছিলেন অনন্যসাধারণ এক ব্যক্তিত্ব। কি সাংবাদিকতা, কি সমাজসেবা, কি শিক্ষা, কি রাজনীতি, কি সংস্কৃতি – প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। প্রতিটি বিষয়ে তিনি ছিলেন সমান ওয়াকিবহাল। সব বিষয়ে যথেষ্ট পড়াশোনা ছিল বলে যে কোনো সভা-সমাবেশে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে তিনি তাঁর বক্তব্য উপস্থাপন করতে সক্ষম হতেন। তিনি যখন বক্তৃতা দিতেন, তখন সুন্দর সরল ভাষার শুদ্ধ প্রয়োগ শুনে উপস্থিত সকলেই মুগ্ধ হতেন। বেশি সময় ধরে বক্তৃতা দিতেন না। স্বল্পকথায় কংক্রীট বক্তব্য উপস্থাপন করতেন। ঋজু, দিকনির্দেশনামূলক ও যুক্তিপূর্ণ বক্তব্যদানে তাঁর তুলনা তিনি নিজেই। একই দিনে অনেকগুলো সভায় বক্তৃতা দিতে হয়েছে তাঁকে। কিন্তু কোনো জায়গায় বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি থাকতো না। সকল বক্তৃতা হতো সম্পূর্ণ ভিন্ন ও স্বতন্ত্র প্রকৃতির।
অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ ছিলেন সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য একজন ব্যক্তিত্ব। বিশেষ রাজনৈতিক দর্শনের অধিকারী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হয়েও তিনি ছিলেন পরমতসহিষ্ণু পুুরুষ। অন্যের বক্তব্য তিনি মনোযোগ সহকারে শুনতেন, ভিন্নমতকে গুরুত্ব দিতেন এবং কোনো পয়েন্টে বিরোধিতা করতে হলে যুক্তিনির্ভর আলোচনা করতেন। তিনি ছিলেন দৃঢ়চেতা, যা বিশ্বাস করতেন-তাই বলতেন। একজন ধর্মপ্রাণ মানুষ হয়েও আপাদমস্তক তিনি ছিলেন অসামপ্রদায়িক। সব শ্রেণীর, সব ধর্মের মানুষের প্রতি তাঁর ছিল মমত্ববোধ। উন্নত মানসিকতাসম্পন্ন মানুষ বলতে যা বোঝায় – অধ্যাপক খালেদ তাই। তাঁর চারিত্রিক দৃঢ়তা, পরমতের প্রতি শ্রদ্ধা এবং অন্য ধর্মের প্রতি সহিষ্ণুতা তাঁকে মহীরূহ করে তুলেছে, করে তুলেছে সর্বজন শ্রদ্ধেয়।
সময়ের সাহসী ব্যক্তিত্বের প্রতিচ্ছবি ছিলেন অধ্যাপক খালেদ। দেশের নানা উত্থান-পতন, জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, গণতান্ত্রিক আন্দোলন, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন ও সামপ্রদায়িকতা বিরোধী আন্দোলনে তিনি পালন করেছিলেন অগ্রণী ভূমিকা। তিনি চিন্তা করতেন বিবেক দিয়ে এবং আন্দোলনের কথা বলতেন অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে। তিনি ছিলেন আমাদের প্রগতিশীল ধারার বিবেকী কণ্ঠস্বর। ‘মুক্তিযুদ্ধে, সংবিধান প্রণয়নে এবং পরবর্তী গণতান্ত্রিক সংগ্রামে তিনি ইতিহাসের প্রবাহ-পথে তাঁর স্থান নিয়েছেন ও সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন’। মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।