কোরবানি পরবর্তী সময়ে আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায় পশুর চামড়া। দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চট্টগ্রামে এবার কোরবানি দাতা কমে যাওয়ায় লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী কাঁচা চামড়া সংগ্রহ হয়নি। কোরবানির দিন সকাল থেকে সাড়ে ৩ লাখ কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্য নিয়ে মাঠে নামেন আড়তদাররা। গত রোববার পর্যন্ত মোট ৩ লাখ ১৯ হাজার পিস পশুর চামড়া সংগ্রহ হয়েছে। এর মধ্যে ২ লাখ ৫৮ হাজার পিস গরু এবং বাকিগুলো ছিল মহিষ, ছাগল ও ভেড়ার। তবে এ বছর চামড়া সংগ্রহে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলার খবর পাওয়া যায়নি। এছাড়া ছিল না মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য। করোনাকালে মৃতদেহ দাফন–সৎকার কার্যক্রমে আলোচনায় আসা গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশের স্বেচ্ছাসেবীরা গত বছরের মতো এবারও নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় চামড়া সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করেছেন।
আড়তদাররা বলছেন, গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশের স্বেচ্ছাসেবীরা চট্টগ্রাম নগরী ছাড়াও বিভিন্ন উপজেলা থেকে ট্রাকে ট্রাকে চামড়া সংগ্রহ করেছেন। এর অধিকাংশই বিনামূল্যে। এর ফলে মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট সুবিধা করতে পারেনি।
পত্রিকান্তরে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, চট্টগ্রামে ছোট–বড় ২২৫টি আড়তে চামড়া সংরক্ষণ হয়। আড়তদার আছেন ৩৭ জন। অধিকাংশ আড়ত নগরীর আতুরার ডিপো এলাকায়। কোরবানির দিন চট্টগ্রাম জেলা ও মহানগর থেকে আসা কাঁচা চামড়ার সবচেয়ে বেশি সমাহার ঘটে এই আতুরার ডিপো এলাকায়। ডিপোর বাইরে সড়কে লাখো চামড়ার হাতবদল হয়। হাজার–হাজার ক্রেতা–বিক্রেতার সমাগম ঘটে। কিন্তু এবার আতুরার ডিপোর পরিস্থিতিও ভিন্ন। বৃহত্তর চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার সমবায় সমিতি এবার গরু, মহিষ ও ছাগল মিলিয়ে সাড়ে তিন থেকে চার লাখ কাঁচা চামড়া সংগ্রহের টার্গেট নিয়েছিল। কিন্তু চট্টগ্রামে এবার কোরবানি দেওয়া হয়েছে ৮ লাখ ৭৪ হাজার পশু। আর ব্যবসায়ীদের চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্য সাড়ে তিন লাখ। চট্টগ্রাম জেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগের দেওয়া কোরবানির এ তথ্যের সঙ্গে চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যে ব্যাপক ফারাক। এ বিষয়ে চট্টগ্রাম জেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের তথ্য মতে, চট্টগ্রামে এ বছর ৮ লাখ ৭৪ হাজার পশু কোরবানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়, যার মধ্যে গরু ৫ লাখ ২৬ হাজার ৩২৫টি, মহিষ ৭১ হাজার ৩৩৩টি। জেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ডা. মো. আলমগীর বলেন, এবার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১০ শতাংশ কম কোরবানি হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
চামড়া বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি খাত। কিন্তু বাস্তবে সিদ্ধান্তহীনতা এবং দুর্নীতির শিকার হয়ে গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরেই এই খাত পতনশীল! পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) প্রধান অর্থকরী ফসল ছিল পাট। পাট ও পাটজাত পণ্যই ছিল পাকিস্তানের প্রধান রপ্তানি পণ্য। দেশের জাতীয় আয়ের ৬৫ শতাংশই আসত কৃষি খাত থেকে। দেশীয় ব্যবহার ও রপ্তানিতে চা ও চামড়ার উপস্থিতি এবং অবস্থান ক্রমে বাড়তে থাকে। এ দেশ মুসলিম অধ্যুষিত হওয়ায় পবিত্র ঈদুল আজহার সময় প্রচুর গরু, ছাগল প্রভৃতি পশু কোরবানি হয়। এছাড়া সারা বছরই এসব পশুর মাংস ক্রয়–বিক্রয় হয়ে থাকে। ফলে চামড়ার উৎপাদন ও সরবরাহ বাংলাদেশে বহুপূর্ব থেকে ক্রমে বাড়ছে। ব্যবসা হিসেবে এ দেশে চামড়া খাতের যাত্রা শুরু হয়েছে গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকে।
চামড়া শিল্প খাতের ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, দেশের চামড়া খাতের প্রধান সমস্যা কমপ্লায়েন্সের অভাব। যার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশে উৎপাদিত পণ্য কম দাম পাচ্ছে পাশাপাশি স্থানীয় বাজারেও চামড়ার ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে ১০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয় সম্ভব বলে ধারণা করা হয়েছে। সে জন্য এ খাতের কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করা জরুরি। অধিকন্তু, সাভারের চামড়া শিল্প নগরীতে স্থাপিত ইটিপি এখনও পূর্ণাঙ্গ পরিবেশবান্ধবভাবে কাজ করছে না এবং কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনাও ঠিক হয়নি। এজন্য, বাংলাদেশে উৎপাদিত পণ্য ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কম পাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, ট্যানারি শিল্প খাতের প্রধান কাঁচামাল চামড়া। আমাদের দেশে চামড়া শিল্প সম্ভাবনাময় এবং উল্লেখযোগ্য খাত হিসেবে চিহ্নিত। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, দীর্ঘদিন ধরেই ব্যর্থতার চক্করে ঘুরপাক খাচ্ছে এ শিল্প খাতটি। এ খাতের বিকাশ এবং স্থায়ীকরণের জন্য ২০০ একর জমিতে চামড়া শিল্পনগরী গড়ে তুলতে দীর্ঘ ১৬ বছর পার করেছে সরকার। এতে পর্যায়ক্রমে চামড়া রপ্তানির আয় কমে যাচ্ছে এবং কাঁচা চামড়ার দামের ধস নেমেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, সারা বছর ট্যানারির জন্য চামড়া এলেও কোরবানির পশুর চামড়ার আধিক্য প্রতি বছরই পরিলক্ষিত হয়। অথচ চামড়া শিল্পের প্রধান এই কাঁচামাল চামড়ার দাম বাজারে সবচেয়ে কম।
বৃহত্তর চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার সমবায় সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ মুসলিম উদ্দিন আজাদীকে বলেন, এ বছর কোরবানিতে আমরা সাড়ে ৩ লাখ কাঁচা চামড়া সংগ্রহের টার্গেট নিয়েছিলাম। কিন্তু মানুষের আর্থিক অবস্থা খারাপ হওয়ায় কোরবানি দাতার পরিমাণ ১০–১৫ শতাংশ কমে গেছে। তাই আমাদের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে আমরা ৩ লাখ ১৯ হাজার পিস চামড়া সংগ্রহের হিসাব দিয়েছি। সরকার প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করেছে ৪৫ টাকা। ট্যানারি মালিকরা যেন সরকার নির্ধারিত দামে চামড়া কিনে, সরকারের কাছে আমরা দাবি জানাচ্ছি।
তাই বহুমুখী চামড়াজাত পণ্য উৎপাদনে সংশ্লিষ্টদের ভাবতে হবে, এগিয়ে আসতে হবে উদ্যোক্তাদের। দেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে হলে সম্ভাবনাময় চামড়া খাতের উন্নয়নে ব্যাপক পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।