পার্বত্যবাসী ১২ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীসহ সংখ্যালঘুদের কথা বলছি। স্মরণ রাখা ভালো, ধর্মীয় পরিচয়ে সব’চে বৃহৎ সংখ্যালঘুর দেশ ভারতের পরে বাংলাদেশ। এটাও বলে রাখা ভালো সভ্যতার ইতিহাসে প্রথম সব’চে বৃহৎ সংখ্যালঘু উদ্বাস্তু সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল সাতচল্লিশে বাংলা ও পাঞ্জাবে। এরপর দ্বিতীয়বার ঘটেছে একাত্তরে। মোটামুটি ৯০ লক্ষের মতো হিন্দু ভারতে উদ্বাস্তু হয়েছিল। এতো বিশাল সংখ্যালঘু উদ্বাস্তু, সংখ্যালঘু নিপীড়ন ও উদ্বাস্তু সংকটের দায়ভার কার! উপমহাদেশে ধর্মের ভিত্তিতে রাষ্ট্রসৃষ্টির রাজনৈতিক তত্ত্বের জনক জিন্নাহ বা গান্ধী বা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় কতটুকু দায়ী তা ইতিহাস নির্ধারণ করবে। তবে এটা ঠিক যে মুসলমানের বা ইসলামের দেশ পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়া মাত্রই অবধারিত হয়ে ওঠে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। বলা হয়েছিল কম্যুনিস্টরা পাকিস্তানের শত্রু। এরা ইসলামের শত্রু। অথচ গঙ্গাধর অধিকারীর থিসিস গ্রহণ করে সিপিআই পাকিস্তান আন্দোলন সমর্থন করেছিল। একেবারে শুরুতেই পাকিস্তান তথা পূর্ব–পাকিস্তানে কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ করা হল। সেই সব দুর্বিষহ দিনের একটি লোমহর্ষক বর্ণনা দিলে ঘটনার গুরুত্ব বোঝা যাবে। যতদূর মনে পড়ে ফতেয়াবাদ খগেন্দ্র চক্রবর্ত্তীর পুকুর পাড়ে চিরনিদ্রায় শায়িত কমরেড অনঙ্গ সেনের সমাধিতে ফুল দিতে গিয়েছিলাম। বসন্ত রোগে আক্রান্ত জেলা কমিটির সম্পাদক কমরেড অনঙ্গ সেনকে ফতেয়াবাদ স্থানান্তর করা হয়। চিকিৎসা হয়েছিল তবে সব ধরনের চিকিৎসা ও শুশ্রূষাকে পরাস্ত করে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। তাঁকে দাহ করা যায়নি। কারণ চিতার অগ্নিশিখা বিদ্যুৎ গতিতে পুলিশ ও গোয়েন্দা পর্যন্ত পৌঁছে যাবার সমূহ ঝুঁকি ছিল। অগত্যা স্বপনদা’র পুকুর পাড়ে সমাধিস্থ বা কবরস্থ করা হয়। এর পরের কাহিনি হলো পূর্ববঙ্গে হিন্দুদের উদ্বাস্তু জীবনের মহাকাব্যিক ঘটনা প্রবাহ। কথা ছিল পশ্চিম বঙ্গের যে সব মুসলমান পূর্ব–বাংলায় আসবে তাদের ঘরবাড়িতে গিয়ে হিন্দুরা আশ্রয় নেবে। বাস্তবে ঘটল উল্টো। ধনাঢ্য, সরকারি চাকুরে ও অভিজাত মুসলমান ছাড়া সাধারণ মুসলমানরা পূর্ব–বাংলায় আসল না; উল্টো পূর্ব–বাংলা থেকে দলে দলে হিন্দুরা ছুটে চললো ভারতের আসাম ত্রিপুরা পশ্চিমবঙ্গের দিকে। একসময় এ সংখ্যা হাজার পেরিয়ে লক্ষ লক্ষে পৌঁছায়। ধারণা করা হয় শতভাগ হিন্দুর এই ভূ–খণ্ডে সাতচল্লিশ থেকে অদ্যাবধি ভারতে আশ্রিত হিন্দুর সংখ্যা তিন প্রজন্ম মিলে প্রায় ১০ কোটি। ১৯৪১ সালে হিন্দু জনসংখ্যা ছিল ২৮%, ১৯৫১ সালে তা নেমে ২২% এ দাঁড়ায়। ১৯৭৪ এ অনুপাত নেমে দাঁড়ায় ১৩–১২ % এ। ১৯২২ এ দাঁড়িয়েছে ৭.৯৫%। জাতিসংঘের উদ্বাস্তু বিষয়ক সংস্থার (UNHCR) জরীপ মতে ১৯৭১ শরণার্থী ক্যাম্পে মৃত্যুর সংখ্যা মোটামুটি ৮ লক্ষ। বায়াত্তরে সংবিধান প্রণয়নের সময় সংখ্যালঘু সমস্যার একটি স্থায়ী সমাধান খোঁজা হয়েছিল। ৬ দফা, ১১ দফা, ৭০ এর নির্বাচনী মেনিফেস্টো ও প্রক্লেমেশন অব ইন্ডিপেন্ডেন্সে ‘সেক্যুলারিজম’ শব্দটি না থাকার পরও এটি জাতীয় চার নীতিতে স্থান করে নিয়েছিল নিতান্ত ঐতিহাসিক প্রয়োজনে। গণ–পরিষদে ধর্মনিরপেক্ষতার উপর তুমুল তর্ক–বিতর্ক হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত সংবিধান প্রণেতারা স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছেন যে, সাম্প্রদায়িকতাকে চিরতরে বিদায় করতে হলে ধর্ম নিরপেক্ষতা ছাড়া রাষ্ট্রকে পক্ষপাতহীন রাখা যাবে না। বোঝা যাচ্ছে আলী রিয়াজের প্রস্তাবনাতে যাই’ই থাকুক না কেন, পরবর্তী সংসদে সংবিধান সংশোধন হবেই, হতে বাধ্য এবং হওয়া দরকারও। সম্ভাব্য সংশোধনীতে (সপ্তদশ) পার্বত্যবাসী সহ সংখ্যালঘুদের বলার অনেক কিছুই আছে। তবে রাষ্ট্রধর্ম সংক্রান্ত আর্টিকেল ২ সংশোধন দরকার আছে। প্রখ্যাত সাংবাদিক নুরুল কবির বলেছেন, ‘রাষ্ট্রধর্ম অন্যধর্মের উপর অন্যায়ের সামিল’। তাঁর সাথে শতভাগ ঐকমত্য পোষণ করে বলতে চাই সম্ভাব্য সংশোধনীতে রাষ্ট্রধর্ম বাদ দেয়া সাম্প্রদায়িক সহাবস্থান, মুক্তবুদ্ধি ও প্রগতির স্বার্থেই দরকার। সরকারি চাকরি তথা পুলিশ, মিলিটারী, সিভিল সার্ভেন্ট হিসেবে প্রতিযোগিতায় সংখ্যালঘুদের জনসংখ্যা অনুপাতে কোটা সংরক্ষণ বাস্তবতার নিরীখে প্রয়োজন। এখনো সেনাবাহিনীর অফিসার পর্যায়ে সংখ্যালঘুদের উপস্থিতির হার খুবই কম, সৈনিক পর্যায়েও কম। এরকম আরো যে সব ক্ষেত্র আছে সেসবে জনসংখ্যা অনুপাতে শতকরা ৮ ভাগ কোটা (পাহাড়ী ব্যতীত) সাংবিধানিকভাবে সংরক্ষিত না হলে বাঙালি বা বাংলাদেশী জাতীয়তার প্রসঙ্গটি অর্থহীন হয়ে পড়বে। রাষ্ট্রের সবক্ষেত্রে ৮ ভাগ (পাহাড়ী ব্যতীত) সংখ্যালঘু কোটা বাধ্যতামূলক না হলে দু’তিন দশক পর ভূ–খণ্ডটি এককভাবে কেবল শতভাগ মুসলিম জনপদে পরিণত হবে। এর অর্থ দাঁড়াবে ধর্মীয় রক্ষণশীলতার উত্থান। সিরিয়া বা আফগানিস্তান নাটকের মঞ্চায়ন। ১৯৩৫ সনের ভারত শাসন আইনের সুবাদে ১৯৫৪ সালের সংসদে সংখ্যালঘুদের সদস্য সংখ্যা ছিল ৭২। তৎকালীন কংগ্রেস, আওয়ামী লীগ ও স্বতন্ত্র নেতৃত্বের মধ্যে সম্পাদিত হয় বিখ্যাত পঞ্চশীলা নীতি। নেতৃত্ব একমত হন যে সংখ্যালঘুদের সংরক্ষিত আসন পদ্ধতি তুলে না দিয়ে বাঙালি জাতিসত্তার বিকাশ লাভ সম্ভব নয়। সেদিনের তত্ত্ব সঠিক ছিল। সত্তরের নির্বাচনে পঞ্চশীলা নীতির প্রভাব ছিল। মুক্তিযুদ্ধ হল, দেশ স্বাধীন হল। ২০১৮ সালের সংসদে সংখ্যালঘু প্রতিনিধি দাঁড়াল মাত্র ১৯। ভবিষ্যতে এ হার আরো কমবে। সংরক্ষিত মহিলা আসন হয়তো তুলে দেয়া হবে। তুলে দিলেও তেমন কোন মৌলিক পরিবর্তন হবে না। কিন্তু সংখ্যালঘুদের বিষয়টির উপর কোটি মানুষের অস্তিত্ব, নিরাপত্তা ও ক্ষমতায়নের প্রশ্ন জড়িত। সম্ভাব্য সংশোধনীতে রাজনৈতিক দলগুলো যেন শতকরা ন্যূনতম ৮ ভাগ (পাহাড়ী ব্যতীত) সংখ্যালঘু মনোনয়ন নিশ্চিত করে তার বিধান রাখা উচিত। কোটা পদ্ধতি ছিল বলেই পার্বত্যবাসীরা জীবনের বহু ক্ষেত্রে আজ মূল জনস্রোতে একাকার। হিন্দু মেয়েদের উত্তরাধিকার না থাকা এক বড় ধরনের মানবিক সমস্যা। বিগত সরকারের নারীনীতি কার্যকর করা যায়নি, হিন্দু ও মুসলিম ধর্মীয় নেতৃত্বের বিরোধিতার কারণে। এখন সময় এসেছে সম্পত্তি সংক্রান্তে অভিন্ন সিভিল কোড প্রণয়ন। এরপরও যদি মুসলিম সম্প্রদায় অভিন্ন সিভিল কোডে না আসতে চান অসুবিধা নেই। হিন্দুদের পক্ষ থেকে দাবি জানানো হচ্ছে– ছেলে মেয়ে মা স্ত্রী নির্বিশেষে প্রত্যেক উত্তরাধিকারী সমান উত্তরাধিকার নিশ্চিত করা হোক। ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ, বার কাউন্সিলসহ সব ধরনের বেসরকারি ক্লাব, বার এসোসিয়েশন, চেম্বার অব কমার্স জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে ১০ ভাগ প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে। নির্বাচনী প্রক্রিয়াতেই প্রতিদ্বন্দ্বী দল, গ্রুপ মনোনয়নের সময় এই হার রক্ষা করতে বাধ্য থাকতে হবে। এই প্রস্তাব নিতান্ত সম্প্রদায়গত দৃষ্টিতে মর্মে ভাবা ভুল হবে। অসম প্রতিযোগিতার মুখোমুখি সংখ্যালঘুদের সাংবিধানিকভাবে রক্ষা করা না গেলে ইতোমধ্যে সৃষ্টি হওয়া আস্থার সংকট আরো বাড়বে। সংখ্যালঘুরা চোখের জলে নিজ জন্মভূমি ছেড়ে আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপ, ভারতে পাড়ি জমাবে। নিতান্ত ঘুম পেট আর ইজ্জতের তাগিদে।
খোলাখুলি বলা ভালো মধ্যপ্রাচ্য আর উত্তর আফ্রিকার মুসলিম জনমিতি এমনভাবে বেড়েছে যে ঐসব দেশের আদিবাসী বারবাররা শতকরা এক ভাগের নিচে চলে এসেছে। শতভাগ হিন্দুর দেশ আফগানিস্তান আজ প্রায় হিন্দুশূন্য। বহু সম্প্রদায়, বহু জাত, বহু চিন্তার সমাবেশ না থাকলে একটি রাষ্ট্র স্থিতিশীল হয় না। বিজ্ঞানমুখী হয় না। প্রগতিশীল হয় না। আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপ এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ। ধর্ম নিরপেক্ষতা কোনো অবস্থাতেই সংবিধান থেকে তোলা যাবে না। এই একটি স্তম্ভের কারণে সংখ্যালঘুরা এই রাষ্ট্রের আধুনিকতা নিয়ে আস্থাশীল। বহুবার গর্ব করে বলেছি পৃথিবীর যে কোনো প্রগতিশীল সংবিধানের সাথে বাংলাদেশ সংবিধান তুলনীয় ও সমমর্যাদার। কেউ স্বীকার করল অথবা কেউ করল না–তাতে কী, বাঙালি জাতিসত্তার বিকাশ ঘটেছে অন্তত এক হাজার বছর ধরে, এর পরিণতি এসেছে বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে। বাঙালি জাতীয়তা এর পরিচয়। এই পরিচয়ের মাঝেই স্থিতি আছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা। সম্ভাব্য সংশোধনে যেন কোনো অবস্থাতেই ধর্ম নিরপেক্ষতা ও বাঙালি জাতীয়তাবোধের বিপর্যয় না ঘটে।
লেখক: প্রাবন্ধিক–কলামিস্ট; আইনজীবী, আপীল বিভাগ।