সম্পর্কই হচ্ছে পৃথিবীর চালিকাশক্তি

করবী চৌধুরী | শুক্রবার , ১৫ জানুয়ারি, ২০২১ at ৭:৩৯ পূর্বাহ্ণ

মানবজীবনে ‘সম্পর্ক’ বিষয়টি এতটাই এতটাই গুরুত্ববহ যে, একে ছাড়া জগতসংসার অচল। ‘সম্পর্ক মানে, একে অপরকে অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ করে রাখার নাম। সম্পর্ক সারা পৃথিবীজুড়ে বিরাজমান। সমগ্র জীবকুলের মধ্যেই এর উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। এই বিশ্বব্রহ্মান্ডে আমরা সকলেই একটা সূক্ষ্ম সম্পর্কের মধ্যে চলাফেরা করি। আমাদের অজান্তেই প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের নিবিড় একটা সম্পর্ক তৈরি হয়। প্রকৃতিও সর্বদা তার কোলে আমাদের স্থান দিয়ে স্নেহ- আদরে আমাদের প্রাণে স্নিগ্ধতা যোগায়। আর সেটা হয় খুবই নিশ্চুপে। একজন মা তার সন্তানকে গর্ভে ধারণ করে তারই রক্তমাংস দিয়ে গড়ে তোলেন আরেক জ্যান্তপ্রাণকে, যা সম্ভবপর হয় শুধুমাত্র এমন একটি সুন্দর সম্পর্কের ফলে, যে সম্পর্কটি পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ সম্পর্ক হিসেবেই খ্যাত।
পরম মমতায় একজন বাবা যে তার শিশু সন্তানের ছোটছোট আঙুল ধরে এক পা, দুই পা করে হাঁটতে শেখান, তাকে প্রথম কথা বলতে শেখান তার নিটোল রূপই হলো, এই বাৎসল্য সম্পর্ক।
প্রাণের কথা খুলে বলার জন্য যে আর এক প্রাণের খোঁজ চলে, আর তা শোনার জন্য যে হাত বাড়ায়, তা হলো ‘বন্ধুত্ব’ নামক এক অটুট সম্পর্ক। নিজের সবকিছু উজাড় করে দিয়ে একে অপরের প্রাণের দোসর হওয়ার নাম হলো প্রেমের সম্পর্ক। আর মনোমন্দিরে ভালোবাসার মানুষটির নাম নিভৃত যতনে লিখে রাখার নাম হলো প্রেম। অকারণ খুনসুটি, চুল টানাটানি, একে অন্যের উপর অহেতুক দোষ চাপিয়ে দেওয়া, ঝগড়া, আবার পরক্ষণেই বুকে জড়িয়ে নেওয়া.. এরূপ মিস্টি সম্পর্ক হলো ভাই-বোনের সম্পর্ক। মোটকথা হলো, সম্পর্কই হচ্ছে পৃথিবীর চালিকাশক্তি। সম্পর্ক যেরকমই হোক না কেন, চারটি স্তম্ভের উপর ভিত্তি করেই তা সঠিকভাবে টিকে থাকে।
সম্মান : প্রেমভালোবাসার সম্পর্ক হোক বা বন্ধুত্বের সম্পর্ক হোক, সম্মান ছাড়া কোন সম্পর্কই টিকতে পারে না। যে কোন সম্পর্কের মাঝে পারস্পরিক সম্মানবোধ থাকাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
বিশ্বাস : যে কোন সম্পর্কে বিশ্বাস হলো মূল স্তম্ভস্বরূপ। এই পৃথিবীটাই টিকে আছে বিশ্বাসের উপর। পৃথিবীর সৃষ্টি, স্থিতি, স্রষ্টা, সবকিছুর ভিত্তিই হলো শুধুমাত্র একটা বিশ্বাস। এই বিশ্বাসই হলো সব সম্পর্কের প্রাণভোমরা। প্রাণ ছাড়া যেমন দেহ অচল, ঠিক তেমনি বিশ্বাস ছাড়া সব রকমের সম্পর্কই অচল। যে কোন সম্পর্কে যখন অবিশ্বাসের মেঘ ভর করে, তখনই সাথেসাথে মৃত্যু হয় তার। তছনছ হয়ে যায় সাজানো সবকিছু।
যত্ন বা পরিচর্যা : আমরা প্রায়শই শুনিযে, ভালোবাসাযুক্ত যত্ন আর পরিচর্যা দিয়ে মরুভূমিতে ফুল ফোটানো যায়। পাথরেও ফুল ফোটানো সম্ভব। তাহলে একটা সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে যত্ন যে কতটা গুরুত্ববহন করে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
বোঝাপড়া : এই বিষয়টাকেই বর্তমানে সব সম্পর্ক ভাঙার মূল কারণ হিসেবে গণ্য করা হয়। বোঝা ভালো, কিন্তু বেশি বোঝা বা ভুল বোঝা মোটেও ভালো নয়। এই ভুল বোঝাবুঝির জন্যই উভয়পক্ষের মাঝে কারণেঅকারণে সন্দেহ এবং এমন বড় ধরণের ঝগড়ার সৃষ্টি হয়, যার শেষপরিণাম হলো, একটি সম্পর্কের অপমৃত্যু!
তাই যেকোন সম্পর্ক ভালোভাবে চালিয়ে যেতে পরস্পরের মধ্যে ভালো বোঝাপড়া থাকাটা জরুরী। অনেক সময় বেশ ছোটখাটো বিষয় নিয়েও সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়। দেখা গেলো, সবকিছু ঠিকঠাকমতো চলছে, উভয়ের মধ্যে মনমানসিকতার মিলও রয়েছে, পরস্পরের প্রতি ভালোবাসাও রয়েছে যথেষ্ট, কিন্ত কেন জানি সম্পর্কের মাঝে সূক্ষ্ম একটা দ্বন্দ্ব ঠিকই বিরাজ করছে। আসলে অনেকসময় পরিবেশ-পরিস্থিতিও সম্পর্ক মধুর করার ক্ষেত্রে নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। পরিবেশের কারণেও একটা সম্পর্কে দূরত্ব আর তিক্ততা আসতে পারে।
মূলত সম্পর্ক যেমনই হোক না কেন, তা ভালোভাবে টিকিয়ে রাখা বেশ কষ্টসাধ্য। এর জন্য অনেকটাই ছাড় দিতে হয়। নিজের মধ্যে মানিয়ে চলার মানসিকতা তৈরি করতে হয়। মোদ্দা কথা, কোন বিষয়গুলো একটা সম্পর্ককে মধুর করতে পারে আর কোনগুলো তিক্ততার জন্ম দিতে পারে, সে ব্যাপারগুলো সম্বন্ধে ভালোভাবেই ওয়াকেবহাল থাকতে হবে।
জীবনকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখে কিছু বিষয়কে মেনে চললে অন্যকে শান্তিতে রাখার পাশাপাশি নিজেকেও শান্তিতে রাখা যায়। যেমন:
* অনুভূতিকে স্বাভাবিক করতে হবে। সর্বক্ষেত্রে নেতিবাচক মনোভাব ছাড়তে হবে। চাইলেই সবার সবকিছুতেই ভুল ধরা সম্ভব। কিন্তু একটা সম্পর্কের মধ্যে যত বেশি দোষ খোঁজা হবে ততই তার অবনতি হবে।
* পরস্পরকে দেওয়াটা সম্পর্ক স্বাস্থ্যবান রাখার একটা উল্লেখযোগ্য উপাদান।
না চাইলেও একটা সময়ে যে কোন সম্পর্কের মাঝেই রাগ, দুঃখ, হতাশা, অসহায়ত্ব, উদ্বিগ্নতা ইত্যাদি এসেই যায়। সেক্ষেত্রে নিজেদের সময় দিলে, এবং একে অপরের অনুভূতির প্রতি সংবেদনশীল হলে সম্পর্ক দ্রুতই আবার সুস্থ এবং স্বাভাবিক হয়ে ওঠে।
* সন্দেহ থেকেও অনেক সম্পর্কের অবনতি ঘটে। বাবা- মা-সন্তান, প্রেমিক-প্রেমিকা বা দম্পতির মধ্যে। পরস্পরকে নিয়ে যে কোন কারণে মনে সন্দেহের উদ্রেক হতেই পারে। তখন উত্তেজিত না হয়ে সুষ্ঠু একটা আলোচনাই পারে ভুল ভাঙিয়ে সবকিছু আবারো ঠিকঠাক করে দিতে।
* কেন মতের অমিল হচ্ছে তা উভয়পক্ষ নিজেদের মাঝে আলোচনার মাধ্যমে জানার চেষ্টা করতে হবে। একটা সমাধান বেরিয়ে আসবেই ঠিকঠিক!
* অন্যপক্ষের কোনকিছু বা কোনকথা মনোমত না হলে সাথেসাথে বিরক্ত হয়ে তার সাথে খারাপ ব্যবহার করার ফলেও মনোমালিন্য হতে পারে। সম্পর্ক যদি ভালো রাখতে হয় তবে এধরনের রূঢ় আচরণ থেকে নিজেকে বিরত রাখতে হবে। ভুলক্রমে হয়ে গেলেও, তার কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নেওয়াটাই উদারতার লক্ষণ। হোক সে বয়সে ছোট বা বড়।
জীবন চলার পথে সম্পর্ক হলো পরমধন। আর ধৈর্য, পরমতসহিষ্ণুতা, উদারতা এসব গুণাবলীই পারে এই পরমধনটিকে বাঁচিয়ে রাখতে।
লেখক : প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় সাধারণ মানুষ উদ্বিগ্ন
পরবর্তী নিবন্ধজুম্আর খুতবা