সমৃদ্ধ অর্থনীতির জন্য রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক স্থিতিশীলতা দরকার

| মঙ্গলবার , ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ at ৮:৩৩ পূর্বাহ্ণ

বর্ষীয়ান অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান দেশের রাজনীতিতে আলোচনা না করে ঘোষণা দিয়ে লোকজন জড়ো করার নতুন সংস্কৃতি চালু হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন। আর এভাবে গণতন্ত্রকে কার্যকর করা যাবে না বলেও মনে করছেন তিনি। গত ২২ ফেব্রুয়ারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের অষ্টম বার্ষিক অর্থনীতিবিদ সম্মেলনের প্যানেল আলোচনায় বিশেষ অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন তিনি। আলোচনায় রেহমান সোবহান বলেন, ‘দাবি আদায় করতে লোক জড়ো করা এবং ভায়োলেন্স এখন রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনীতি এখনো মানি পাওয়ারের কাছে বন্দি হয়ে আছে।’ অন্তর্বর্তী সরকারের চলমান সংস্কার কার্যক্রম নিয়ে তিনি বলেন, ‘সংস্কার এখন কিছু হবে, কিছু পরে হবে এমন নয়। বরং একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই সংস্কার হতে হবে। তবে এসব সুপারিশ কীভাবে বাস্তবায়ন হবে সেই প্রশ্ন রয়ে গেছে।’

বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার গত ৮ আগস্ট দায়িত্ব নিয়েছে দেশের বিভিন্ন খাত সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে। এর মধ্যে প্রধানতম অর্থনীতির সংস্কার। তবে রাজনীতির প্রভাবমুক্ত করতে না পারলে অর্থনৈতিক খাতের সংস্কার করা কঠিন হবে। কারণ বর্তমানে দেশের অর্থনীতির যে গভীর ক্ষত তার পেছনে দায়ী এর ব্যাপকমাত্রায় রাজনৈতিকীকরণ। বিগত সরকারের দীর্ঘ দেড় দশকের শাসনামলে দেখা গেছে, সেই সরকারের সুবিধাভোগী গোষ্ঠী নির্ভয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করে গেছে, যার দরুণ দেশের প্রায় সব খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে আর্থিক ও ব্যাংক খাতের, ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে এ খাত। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে আইনের অপপ্রয়োগ ঘটিয়ে প্রভাবশালী ও ব্যাংকের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা সর্বেসর্বা হয়ে দুর্নীতি ও লুটপাট করেছেন। আইন না মেনে রাজনৈতিক বিবেচনায় বিশেষ গোষ্ঠীকে ঋণ সুবিধা দেয়া হয়েছে, যা ব্যাংকগুলোকে খেলাপি ঋণে জর্জরিত করেছে। মুষ্টিমেয় ব্যক্তির হাতে ব্যাংকগুলো জিম্মি থেকেছে, যারা হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করেছে তাদের সুবিধা দিতে গিয়েই দীর্ঘদিন সুদহার ছয়নয়ে আটকে রাখা হয়েছিল, যা বাজার অর্থনীতির সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ ছিল। পাশাপাশি ঋণ আদায়কে গুরুত্ব না দিয়ে বারবার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ দেয়া হয়েছে সুবিধাভোগীদের। এর মধ্য দিয়ে ব্যাংক খাত গভীর সংকটের দিকে গিয়েছে।’

এদিকে, প্রবাসী আয়ের ওপর বাংলাদেশের অর্থনীতি ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল হলেও দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে অভ্যন্তরীণ আয় বৃদ্ধির বিকল্প নেই বলে মন্তব্য করেছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন।

প্রবাসী আয় দেশের অর্থনীতির জন্য এক বিরাট আশীর্বাদ উল্লেখ করে তিনি বলেন, দেশের নিজস্ব উৎপাদন এবং অর্থনীতি সংকীর্ণ হওয়ায় রিজার্ভের অনেকাংশ এই প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্সের ওপর নির্ভরশীল। তবে দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে অভ্যন্তরীণ আয় বাড়াতে হবে। নীতিমালা গ্রহণের ক্ষেত্রে অন্তর্দ্বন্দ্বমূলক নীতি থেকে বেরিয়ে জনকল্যাণমূলক নীতিমালা গ্রহণে বেশি মনোযোগী হতে হবে। জনগণের স্বার্থের বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ।

বিবিএসের প্রতিবেদনের তথ্যমতে, শ্রেণীভিত্তিক বিভাজনে অতিদরিদ্রদের মধ্যে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার হার ৭০ দশমিক ৩৭ শতাংশ। দরিদ্রদের মধ্যে ২২ দশমিক ৯ শতাংশ। মধ্যবিত্তদের মধ্যে এ হার ১৪ দশমিক ৮৮ শতাংশ। ধনীদের মধ্যে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভোগে ১ দশমিক ১১ শতাংশ। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের এক অধ্যাপক বলেন, ‘খাদ্যের জোগান থাকার পরও প্রয়োজনীয় খাদ্য গ্রহণ করতে না পারলে তাকে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা বলা হয়। এখন আগের চেয়ে মূল্যস্ফীতি অনেক বেশি। আয় করার পরও মানুষ হয়তো জিনিসের দাম বাড়ার কারণে প্রয়োজনীয় পণ্য ক্রয় করতে পারছে না।’

এদিকে জনপ্রসাশন সংস্কারের উদ্যোগ হিসেবে বর্তমান সরকার ব্যাপক রদবদল করেছে প্রশাসনে। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে প্রশাসনে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছে। এ ধরনের বিশৃঙ্খলার ঘটনা এক ধরনের রাজনৈতিকীকরণের ইঙ্গিত দেয় এবং অর্থনৈতিক সংস্কার গৌণ হয়ে ওঠার শঙ্কা তৈরি করে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, এমন পরিস্থিতিতে বর্তমান সরকারের প্রয়োজন অর্থনীতিকে যেকোনো উপায়ে রাজনীতির প্রভাবমুক্ত রাখা। গোষ্ঠীতেন্ত্রের লাগাম টেনে ধরা। এজন্য রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক স্থিতিশীলতা আবশ্যক। লোকজন জড়ো করার অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটানোর নতুন সংস্কৃতি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে