আমার এক বন্ধু গল্প লিখেন। তিনি একদিন বিকেলে আমাকে পতেঙ্গা সমুদ্র পাড়ে নিয়ে গেলেন গল্প শোনাবেন বলে। এরকম চূড়ান্ত প্রাকৃতিক পরিবেশে গল্প শোনার সৌভাগ্য সবার হয় না। তিনি, মানে গল্পকার এখন চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করে দিব্যি নাতি নাতনি নিয়ে দিনযাপন করছেন। অর্থাৎ আর্থিকভাবে সচ্ছল একজন গল্পকার। সাধারণত, বাংলাদেশের বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের লেখকদের জীবন সচ্ছল হয় না। তাঁর গল্প শুনলাম, এক এক করে তিনটি গল্প পাঠ করলেন। আমি নীরব শ্রোতার মতো শুনছি আর ভাবছি, আর্থিকভাবে সচ্ছল একজন গল্পকারের কাহিনিতে ওঠে এসেছে, অর্থাৎ গল্পের উপজীব্য বিষয় একেবারে সাধারণ গোছের মানুষ। তাদের নিত্য নৈমিত্তিক মধ্যবিত্ত জীবন, ঝগড়া ফ্যাসাদ আনন্দ কখনো বা উচ্ছন্নে যাওয়া কোনো যুবক তরুণের নির্মম পরিণতি, কিংবা বেশ্যালয়ে বেচে দেওয়া সদ্য গ্রাম থেকে আসা কোনো অবোধ তরুণীর মর্মন্তুদ ঘটনার রক্তাভ ইতিহাস। অথবা কোনো কোনো গল্পে ওঠে এসেছে অবাধ যৌনাচার, রিরংসা আর লোলুপ মরদের হাতছানি। কোনো গল্পে নৃশংস রাজনৈতিক বলিদানের মর্মান্তিক ইতিহাসও দুর্লক্ষ্য নয়। এসব আমাদের সামাজিক বাস্তবতা, যে সমাজে আমরা বাস করি, তার প্রতিদিনের চিত্র, ফটোগ্রাফ। এতে লুকানো আছে গ্রাম ও শহুরে মানুষের নিগৃহীত জীবন। সামাজিক অবক্ষয় আমাদের অসুখের মতো লেগে আছে। এর পেছনে কাজ করে, বেকারত্ব, কাজ না পাওয়া বখাটে ছেলেদের অসামাজিক অনৈতিক উৎপাত। রাজনৈতিক অস্থিরতা। এ–ই অবক্ষয় থেকে উত্তরণ কোথায়? একজন গল্পকার নিশ্চয় এর সমাধান দিতে পারবে না। সেতো আর নীতি নির্ধারকের কেউ নয়; সে রাজনৈতিক নেতাও না, মন্ত্রীও না। ক্ষমতা প্রয়োগকারী সংস্থার ক্ষমতাবানও কেউ নন। এই দায়িত্ব জনগণের ম্যান্ডেট পাওয়া সরকারের। যারা এ দেশের জনগণের জন্য নিরন্তর কাজ করে যাবেন। মৌলিক চাহিদাগুলো মেটাবেন তাদের অবিচল প্রচেষ্টার মাধ্যমে। আবার এ–সব দায়িত্ব পালন কি শুধুই সরকারের। মনে হয় না। প্রজাতন্ত্রের সব জনগণের দায়িত্ব ও কর্তব্য এর সাথে সম্পৃক্ত। আমাদের দেশে দারিদ্রসীমার নিচে চলে আসা লোকের সংখ্যা আবারও বাড়তে শুরু করবে। বাজারে দৈনন্দিন জিনিসপত্রের দাম আকাশ্চুম্বি। একবার বাড়লে আর কমে না। প্রধানত বাজারের ঊর্ধ্বগতিতে মূল্যের সঙ্গে আয়ের সংগতির অভাব। বাজার ও রাজনীতির অস্থিরতা পাল্লা দিয়ে বাড়িয়ে দেয় খুন, অপহরণ, গুম হত্যা আরো বিবিধ অপরাধ প্রবণতা। একটি সমাজের জন্য এটি কোনো শুভ লক্ষণ হতে পারে না। আমাদের দেশের নেতা–নেত্রী নীতি নির্ধারকের একাংশ কিংবা কিয়দংশ আইন প্রণেতারা এসবের প্রতিকার না করে বরং এ–সব ঘটনাকে আরো উসকে দিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিলে ব্যস্ত থাকেন। দিন দিন সমাজের একটি শ্রেণি পাহাড় সমান অবৈধ সম্পদের মালিক হন, আর একটি শ্রেণির সামাজিক অবস্থান ক্রমশই নিচের দিকে গড়াতে থাকে। তৃতীয় বিশ্বের ক্ষুদ্র মানচিত্রের একটি দেশের এ–ই তো গল্প ; এর পাঠক আজকের কিশোর, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া তরুণ, কিংবা সে–ই কর্মহীন যুবক যার অসুস্থ মানস চিন্তায় ভাসে এ–সব অনৈতিক বিষয়। আমি সমুদ্র পাড়ে বসে গ্রীস কবি লেখক কাজান জাকিসের কিছু কবিতার পঙক্তি আওড়াচ্ছি। কবি সমুদ্রকে প্রকৃতির দেবতা ভাবেন। সমুদ্রের নয়নাভিরাম অপার মুগ্ধতার মধ্যে অপদেবতাও দেখেন। কবি ভাবেন প্রকৃতির এই পাশাখেলার মধ্যে উঠে দাঁড়ানো মানুষের জীবন ও সংস্কৃতি। কবির সমুদ্র চর্চা নিদারুণ সুন্দর। সমুদ্র এত বড় বলে, সব কিছুকে গ্রহণ করে, ফিরিয়ে দেয় আবার নিয়েও ফেলে, এটা–ই সমুদ্র ও প্রকৃতির খেলা। কিন্তু মানুষ নিয়ে আমাদের রাজনীতিবিদদের নিষ্ঠুরতম খেলা কখন শেষ হবে?
সরকারের চেষ্টার শেষ নেই। দৃশ্যমান উন্নয়ন যেমন হচ্ছে। দৃশ্যমান দুর্নীতির পাহাড়ও তৈরি হচ্ছে তেমন। নেতা ও আমলারা নিজেদের অতি স্বার্থপর দৃষ্টিভঙ্গি না পাল্টালে দেশের সার্বিক উন্নয়ন কখনো সম্ভব হবে না। একটি জনগণতান্ত্রিক দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য দরকার ব্যক্তি চরিত্র দূষণমুক্ত করা। সঠিক নেতৃত্বের গুণগত শাসনমান সৃষ্টিও প্রধান অবলম্বন, ভাবতে হবে। সংসদের বিরোধী দলের ভূমিকা হবে গঠনমূলক এবং আইনসম্মত। যদিও কথাগুলো বেশ পুরনো কিন্তু দেশের স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য অন্য কোনো বিকল্প পথ এখন পর্যন্ত নেই। যে অবক্ষয় আমাদের সমাজ রাষ্ট্রে চলছে তা বাড়তে দিলে ঘুণধরা সমাজ মাংসহীন কঙ্কালে পরিণত হবে। মানব সম্পদ সৃষ্টি সহায়ক হবে না। মানব দেহে রোগ বাসা বাঁধলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হয়। ঠিক তেমনি সমাজ রাষ্ট্রে রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটলে সারাবার ব্যবস্থা বড্ড অপ্রতুল এখানে। প্রাচীন গ্রিসে আমরা লক্ষ্য করি, নাগরিক হওয়ার জন্য তরুণদের এফেবিক কলেজে যাওয়া ছিল বাধ্যতামূলক। অর্থাৎ তরুণরা বিশ্ববিদ্যালয় পাস দেবার পর পরবর্তী টানা দুইবছর রাষ্ট্র কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এফেবিক কলেজে অধ্যয়ন করতে হতো। কিছু বিষয়ে শিক্ষার্থীদের শপথ ছিল বাধ্যতামূলক ;
১) আমরা আমাদের শহরটাকে অসততা দিয়ে অবমানিত করব না।
২) আমরা একে বা অনেকে মিলে লড়ব এই আদর্শ আর পবিত্রতা রক্ষার জন্যে।
৩) আমরা শহরের আইন মেনে চলব
৪) জনগণের নাগরিক সচেতনতা বাড়ানোর জন্য আমরা কাজ করে যাব। এসব কাজের মাধ্যমে আমাদের শহরটাকে আমরা এখন যেমনটা পেয়েছি, তা থেকে আরও উন্নত আরও সুন্দর হিসেবে গড়ে তুলে রেখে যাব।
এফেবিক কলেজের মতো ধারণা নিয়ে দেশের রাজনীতিতে আসা যুবক তরুণদের জন্য একটা ট্রেনিং ইন্সটিটিউট তৈরি করার দরকার আছে, আমার ধারণা। সে–ই প্রতিষ্ঠান শিক্ষা দেবে গণতন্ত্রের, দেশ প্রেমের, মানবতাবাদের, রুচিবোধ ও সৎচরিত্রবান নাগরিক ধারণার। খুব কঠিন কাজ কি? যে কোনো পতিত সমাজকে টেনে তোলার দায়িত্ব রাষ্ট্রের এবং জনগণের। দুর্নীতি, রাহাজানি, লুটপাট, খুন, বেশ্যাবৃত্তি‘র মতো জঘন্য অসদ্গুণ বদভ্যাস থেকে ফেরাতে পারে জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্র ব্যবস্থা। বিপথগামী তরুণ তরুণীদের ফেরানোর জন্যে গ্রামগঞ্জে অথবা শহরে বিকল্প কর্মসংস্থান, যথা বুটিক শিল্প, হাতের নানাবিধ কাজ, সেলাই কাজ এবং সৎ উপার্জনক্ষম যে কোনো কাজে ব্রতী হওয়া এবং এ–সব কাজ সম্পাদনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যাংক অর্থায়ন নিশ্চিত করা। যারা সংসদে বিরোধী পক্ষ তারা সংসদে উপস্থিত থেকে প্রাঞ্জল ও সুসভ্য ভাষায় নাগরিকদের উপকারে আসবে এমন বিলে সম্মতি প্রদান করা। একইসঙ্গে জনসাধারণের স্বার্থ বিঘ্নিত হবে এমন বিলে প্রতিবাদ করা।
যে গল্পকারের উপজীব্য বিষয় নিয়ে শুরু হয়েছিল লেখাটি সেটি আসলে নতুন কিছু নয়। গল্প মানে অল্প কল্পনা আর অল্প বাস্তবতা এই দুইয়ের মিশেল। যে বাস্তবতা কল্পনাকে প্রশ্রয় দিয়ে ওঠে আসে না, তা নিরেট বাস্তবতা। তা দিয়ে প্রতিবেদন হয়, গল্প কি হয়! আমাদের সাহিত্যে আছে ভাঙন হতাশা অন্ধকার নাভিশ্বাস এবং নৃশংস দুর্বিষহ অনুষঙ্গ। স্তুতিবাদ জড়িয়েছে ভীষণ রকম আমাদের সাহিত্যে। কোথাও আশার আলো নেই। একটা ইতিবাচক মানসিক পরিবর্তন দরকার সবখানে। গণতন্ত্রমুখী হওয়া দরকার প্রতিষ্ঠানসহ সব মানবপক্ষের। আন্তরিকতা ও ভালোবাসা দিয়ে অনেক দূর এগিয়ে থাকা যায়। শুধু দুপক্ষের সদিচ্ছা দরকার। এ–ই আয়োজন যদি আমরা নির্বিঘ্ন করতে পারি তবে গল্পকারের বিষয় নির্বাচনে পরিবর্তন আসবে। এবং আসবে অন্য কোনো নান্দনিক প্রসঙ্গ। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে মনে পড়ছিল সে – দিন গণসঙ্গীত শিল্পী ভুপেন হাজারিকার একটি গানের কলি ; ‘মানুষ মানুষের জন্য জীবন জীবনের জন্য। একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না ও বন্ধু, মানুষ মানুষের জন্য..’
আসলে সহানুভূতি এত দ্রুত তৈরি হবে না। সময়ের দরকার আছে। আমাদের লেখকেরা সাহসী নয় সব কথা খুলে বলতে পারে না। আবার লিখতেও আড়ষ্টবোধ করেন ফলস্বরূপ অপ্রিয় অনেক কথা বাদ থেকে যায়। সেদিন গল্পকার আমাকে ডেকেছিল তার গাড়িতে যেতে। কিন্তু তার গলার স্বরে জোর পাইনি। ড্রাইভার দেখবে আমাকে এটিই মস্তবড় অপরাধ যেন। আমাদের গল্পগুলো এভাবে ম্রিয়মাণ হয়ে ওঠে। আটকে থাকে, ছোট হতে থাকে। সত্য, কল্পনা ও শাশ্বত সুন্দর মূল্যহীন থেকে গেলে কাহিনি গল্প হয়ে উঠতে পারে না গল্পের অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণে।
লেখক:কবি ও প্রাবন্ধিক।