৯ বছর পর আগামী বুধবার হবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) পঞ্চম সমাবর্তন। বিশ্বের ইতিহাসে একক কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বড় সমাবর্তন এটি। গায়ে কালো গাউন জড়িয়ে আর মাথায় টুপি পরে, হাতে সনদ নিয়ে আনন্দঘন মুহূর্ত কাটানোর জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় রয়েছেন প্রায় ২৩ হাজার শিক্ষার্থী। এতে সমাবর্তন বক্তা হিসেবে আসছেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। প্রধান উপদেষ্টার আগমন উপলক্ষে চলছে প্রস্তুতি। সমাবর্তন ঘিরে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ে বইছে উৎসবের আমেজ। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি হল, অনুষদ ও প্রশাসনিক ভবন সেজেছে নতুনরূপে। সর্বত্র লেগেছে সংস্কারের ছোঁয়া। ক্যাম্পাসের প্রতিটি সড়ক, অনুষদ, সব জায়গায় সাজসজ্জা করা হয়েছে। প্রতিটি ভবনে করা হয়েছে লাল–নীল রঙের আলোকসজ্জা। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক হয়ে ভিতরে ঢুকলেই চোখে পড়বে আলোর ঝলকানি।
সমাবর্তন ঘিরে ১৯টি আলাদা উপ–কমিটি তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে তৈরি করা হয়েছে দেড় লাখ স্কয়ার ফিটের প্যান্ডেল। এতে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ ধারণ করতে পারবে। সনদের কাজও শেষ। প্রতিটি বিভাগে পৌঁছে যাচ্ছে সমাবর্তীদের উপহার সামগ্রী। এ সমাবর্তনে শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের জন্য দেওয়া হয়েছে দিকনির্দেশনা। সব মিলিয়ে সমাবর্তন ঘিরে উৎসবের আমেজে চবি ক্যাম্পাস। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সূত্র জানায়, আগামী বুধবার দুপুর ২টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে অনুষ্ঠিত হবে সমাবর্তনের মূল অনুষ্ঠান। এতে অংশ নিচ্ছেন ২০১১ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করা ২২ হাজার ৫৬০ জন শিক্ষার্থী। এর মধ্যে ২২ জন পিএইচডি ও ১৭ জন এমফিল ডিগ্রিধারী রয়েছেন। অনুষদভিত্তিক অংশগ্রহণের দিক থেকে শীর্ষে রয়েছে কলা ও মানববিদ্যা অনুষদ (৪,৯৮৭ জন), এরপর ব্যবসায় প্রশাসন (৪,৫৯৬ জন), সমাজবিজ্ঞান (৪,১৫৮ জন), এবং বিজ্ঞান অনুষদ (২,৭৬৭ জন)।
সমাবর্তনে সমাবর্তন বক্তা থাকবেন প্রধান উপদেষ্টা নোবেলজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস, যিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষকও। তাকে সম্মানসূচক ডি.লিট ডিগ্রি প্রদান করা হবে। সভাপতিত্ব করবেন উপাচার্য প্রফেসর ড. ইয়াহ্ইয়া আখতার। এই বিশাল আয়োজনে খরচ হবে প্রায় ১৩ কোটি টাকা, যার মধ্যে সাড়ে ৬ কোটি এসেছে শিক্ষার্থীদের নিবন্ধন ফি থেকে। বাকি অর্থ দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়, ইউজিসি ও স্পন্সররা। সমাবর্তনের দিন নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকবে চূড়ান্ত পর্যায়ে। শিক্ষার্থীদের সিঙ্গেল লাইনে প্রবেশ করতে হবে। দুপুর ১টার পর কাউকে ঢুকতে দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছে স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স (এসএসএফ)। এছাড়া যেকোনো ধরনের ব্যক্তিগত গাড়ি ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে পারবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নম্বর ফটকে থাকবে পার্কিং ও বাস ট্রান্সফারের ব্যবস্থা। যাতায়াতের জন্য শহরের বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে ছাড়বে ১০০টি বিশেষ বাস এবং চলবে ৪টি বিশেষ শাটল ট্রেন। ক্যাম্পাসে অভ্যন্তরীণ চলাচলের জন্য থাকবে শাটল বাস সার্ভিস।
সমাবর্তী শিক্ষার্থীরা আগামীকাল সোমবার থেকে গাউন ও টুপি নিজস্ব বিভাগ থেকে সংগ্রহ করতে পারবেন। সমাবর্তনের দিন সকাল ৭টা থেকেও সংগ্রহ করতে পারবেন। অনুষ্ঠানের পরপর গাউন জমা দিয়ে তারা সনদ ও উপহার সামগ্রী গ্রহণ করবেন। তাছাড়া সমাবর্তনের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে ২৬ হাজার উপহার সামগ্রী। প্রত্যেকে পাবেন একটি পাটের ব্যাগ, কোর্ট পিন, কলম ও মোবাইল ওয়ালেট সমন্বিত কম্বো বঙ। এছাড়া গাউনের সাথে একটি করে টুপি উপহার হিসেবে দেওয়া হবে।
সমাবর্তন অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচার করবে বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি)। যারা মূল অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পারবেন না তাদের জন্য ক্যাম্পাসে শহীদ মিনার, জারুলতলা, সায়েন্স ফ্যাকাল্টি চত্বরসহ পাঁচটি স্থানে থাকবে এলইডি স্ক্রিনে সরাসরি সম্প্রচারের ব্যবস্থা। প্রশাসন জানায়, সমাবর্তনের লোগোতেও রয়েছে বিশেষ বার্তা। এতে প্রতিফলিত হয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবময় ইতিহাস, জুলাই বিপ্লব, শহীদ আবু সাইদের প্রতিকৃতি এবং ক্যাম্পাসের সবুজ প্রকৃতি। লাল ও সবুজের ব্যবহার এই আয়োজনের আবেগ ও ঐতিহ্যকে তুলে ধরেছে।
সমাবর্তন সূচি : অনুষ্ঠান শুরু হবে দুপুর ১টা ৩০ মিনিটে। ১টা ৪৫ মিনিটে অনুষ্ঠিত হবে সমাবর্তন শোভাযাত্রা। ২টা থেকে জাতীয় সংগীত পরিবেশন করা হবে। ২টা ১৫ মিনিটে সমাবর্তনের সভাপতি ও ভাইস চ্যান্সেলর সমাবর্তনের উদ্বোধন ঘোষণা করবেন। ২টা ১৬ মিনিটে উপ–উপাচার্য (শিক্ষা) স্বাগত বক্তব্য দেবেন। ২টা ২০ মিনিটে প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ডি.লিট ডিগ্রি প্রদান করা হবে। ২টা ৩০ মিনিটে উপাচার্য বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীদের ডিগ্রি প্রদান করবেন। ৩টা থেকে উপ–উপাচার্য (প্রশাসন) শুভেচ্ছা বক্তব্য প্রদান করবেন। এরপর ইউজিসি চেয়ারম্যান, শিক্ষা উপদেষ্টা এবং সমাবর্তন বক্তা বক্তব্য দেন। বিকাল ৩টা ৪০ মিনিটে সম্মাননা ক্রেস্ট প্রদান করা হবে। এরপর সভাপতি বক্তব্য প্রদান করে সমাবর্তন অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করবেন।
চবির তথ্য ও ফটোগ্রাফি শাখার প্রশাসক ও সমাবর্তন প্রচার–প্রকাশনা কমিটির সদস্য ড. শহীদুল হক বলেন, সমাবর্তন উপলক্ষে ক্যাম্পাস দারুণভাবে সেজেছে। আমরা রাত–দিন কাজ করে যাচ্ছি। বন্ধের দিনেও ক্যাম্পাসে এসে কাজ করতে করতে হচ্ছে। আমাদের সকল পর্যায়ের কাজ প্রায় শেষের দিকে।
সমাবর্তন উদযাপন কমিটির সদস্য সচিব ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক প্রফেসর ড. মো. এনায়েত উল্যা পাটওয়ারী বলেন, একক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে এটি দেশের সবচেয়ে বড় সমাবর্তন। সবাই নিয়মতান্ত্রিকভাবে এতে অংশ নেবেন–এটাই প্রত্যাশা। এছাড়া জরুরি নির্দেশনাগুলো সমাবর্তনের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে দেওয়া হবে, সেখান থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য পেয়ে যাবেন সমাবর্তী শিক্ষার্থীরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ–উপাচার্য (প্রশাসন) প্রফেসর ড. মো. কামাল উদ্দিন বলেন, ৫৮ বছরের ইতিহাসে মাত্র চারটি সমাবর্তন হয়েছে। এবার আমরা ইতিহাস গড়তে যাচ্ছি। একই সমাবেশস্থলে এত শিক্ষার্থীদের একসঙ্গে সমাবর্তন বিশ্বের ইতিহাসে এটাই হবে প্রথম। আজকেও (শনিবার) আমি সমাবর্তনের অনুষ্ঠানস্থল পরিদর্শন করেছি। আমাদের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। একটা দারুণ সমাবর্তন পেতে যাচ্ছে চবির সাবেক শিক্ষার্থীরা।