সমাজ থেকে নারীবিদ্বেষী আবহ দূর করতে হবে

| শুক্রবার , ২৯ আগস্ট, ২০২৫ at ৪:৫৭ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ আয়োজিত ‘বাংলাদেশে নারী ও কন্যা নির্যাতন: ২০২৪ সমীক্ষা’ প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে বলা হয়েছে, নারী ও শিশু নির্যাতনের মধ্যে কিছু ধরনের অপরাধের ঘটনা গত বছর যা ছিল এবার চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসেই সেই সংখ্যার প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা ছাড়িয়ে গেছে। যেমন এ বছরের প্রথম ছয় মাসেই ধর্ষণের ঘটনা সংখ্যাগত দিক দিয়ে গত বছরের প্রায় সমান। আবার যৌন নিপীড়ন ও উত্ত্যক্তকরণ, বাল্যবিবাহ এবং যৌতুকের জন্য নির্যাতনের ঘটনা গত বছরের চেয়ে এখনই বেশি। সংখ্যার ভিত্তিতে মোট নির্যাতনের পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৩ সালে ২ হাজার ৯৩৭টি, ২০২৪ সালে ২ হাজার ৫২৫টি এবং চলতি বছরের ৬ মাসে ১ হাজার ৫৫৫টি নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে।

মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত এ অনুষ্ঠানে সমীক্ষার বিভিন্ন তথ্য উপস্থাপন করেন মহিলা পরিষদের জ্যেষ্ঠ প্রশিক্ষণ ও গবেষণা কর্মকর্তা আফরুজা আরমান। তিনি জানান, চলতি বছরের ছয় মাসে সাইবার অপরাধ এবং গৃহকর্মী নির্যাতনের সংখ্যা কিছুটা কমলেও অন্যগুলো বেড়েছে।

সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়েছে, ২০২৪ সালে জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত ৩৬৪ জন ধর্ষণের শিকার, এর মধ্যে ২২০ জন কন্যা ও ১৪৪ জন নারী। ১৪৮ জন দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার, যার মধ্যে ৪৯ জন কন্যা ও ৯৯ জন নারী। ১৩৪ জন কন্যা ও ৭৭ জন নারী ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছেন। যৌন নিপীড়ন ও উত্ত্যক্তকরণের শিকার ২২৪ জনের মধ্যে ১২৫ জন কন্যা। বাল্যবিবাহের শিকার ২০ জন কন্যা। যৌতুকের শিকার ৬৬ জন নারী ও ২ কন্যাশিশু। গৃহকর্মী নির্যাতনের মধ্যে ১৬ জন কন্যা ও ৮ জন নারী এবং সাইবার অপরাধের শিকার হয়েছেন ২৬ জন কন্যা ও ৩ জন নারী।

অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম বলেন, দেশে নারী ও মেয়েশিশু নির্যাতনের ব্যাপ্তি ও ভয়াবহতা বেড়েছে। সমীক্ষার তথ্য উল্লেখ করে তিনি বলেন, কম বয়সীরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে আবার অভিযুক্তদের বয়সও কম। এটা উদ্বেগজনক। এ ছাড়া বিভিন্ন গবেষণায় এসেছে, একই অপরাধী বারবার অপরাধ করতেই থাকে। এর পেছনে অপরাধীদের রাজনৈতিক এবং ক্ষমতাসীনদের মদদ দেওয়ার বিষয়টি সম্পৃক্ত। ক্ষমতাসীনদেরও অনেকে অপরাধের সঙ্গে যুক্ত থাকে। ফওজিয়া মোসলেম বলেন, বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির পাশাপাশি সমাজে নারীবিদ্বেষী আবহ তৈরি হয়েছে। কেন টিপ পরছে, কেন এমন জামা পরছেএমন প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে। সমাজ থেকে নারীবিদ্বেষী আবহ বা সংস্কৃতি দূর করতে সামাজিক আন্দোলনের পাশাপাশি গণমাধ্যমকে সক্রিয় হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলেন, নারী নির্যাতনের মামলার দীর্ঘসূত্রতা কমাতে সমাজে সুশাসন নিশ্চিতের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। সমীক্ষা অনুযায়ী, ঘরেবাইরে শিশুরা অনিরাপদ হয়ে যাচ্ছেএ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন তিনি।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ধর্ষণ বিরোধী আইন কঠোর করা হলেও এখনো রোধ করা যাচ্ছে না এই হীনতম কর্মকাণ্ড। ধর্ষণের মতো বিকৃত সামাজিক ব্যাধির হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না কোমলমতি নিষ্পাপ শিশুরাও। ঘরেবাইরে কোথাও নিরাপদ নয় তাদের জীবন। স্কুলে, মাদ্রাসায়, খেলার মাঠে, ঘরের ছাদে কোনো স্থানেই এখন নিরাপত্তা নেই। খোদ পরিবার, আত্মীয়স্বজন, শিক্ষকশিক্ষয়িত্রীদের কাছেও নিরাপদ থাকছে না মেয়েরা। সভ্যতার বড়াই করা, সামাজিকসাংস্কৃতিক মূল্যবোধের বক্তৃতা দেওয়া এবং ধর্মীয় বিশুদ্ধতার দাবিদার ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর কাছেও আজ বিপন্ন এরা। ধর্ষণের দায়ে বিচারও হচ্ছে। তবু কেন এ ঘটনা কমছে না, তা বোধের মধ্যে আসছে না।

বলা যায়, ধর্ষণের ঘটনার লাগাম নেই। যাতে কেবল নারীর জীবনযাপন বিপন্ন হচ্ছে, তা নয়; সামগ্রিক নিরাপত্তাবলয় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এসব অপকর্মের সঙ্গে যারা জড়িত, তারা হয় বেপরোয়া, নয়তো রাজনৈতিক শক্তির আশ্রয়ভুক্ত। ক্ষমতার ছায়া ছাড়া এহেন অপকর্ম করা ও বিচারের বাইরে থাকা সাধারণ মানুষের পক্ষে অসম্ভব। যত্রতত্র ঘটা ধর্ষণের পরিসংখ্যানই তা বলে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, সমাজ এখনো নারীকে ভোগ্যপণ্য হিসেবে বিবেচনা ও উপস্থাপন করার স্তরেই রয়ে গেছে। পারিবারিক সহিংসতা ও পরিবারে নারী নির্যাতনের ঘটনাগুলো বিবেচনা করলেও এটা স্পষ্টভাবে বোঝা যায়। ফলে নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলের কাজটা পরিবার থেকেই শুরু করতে হবে এবং শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলের বিষয়টা নিয়ে কাজ করতে হবে। কেননা, সুস্থ সমাজের জন্য সুস্থ মানসিকতা দরকার। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ জাতীয় অপরাধ আগেও ঘটত। এখন তার কলেবর বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ জন্য দায়ী অনেকগুলো ফ্যাক্ট। আর অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত না করায় ঘৃণিত এই সহিংসতা প্রতিরোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। প্রতিরোধ না করা গেলে সামনের পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে