আইজাক বাশেভিস সিঙ্গারের জন্ম ১৯০৪ সালে, পোল্যান্ডে। সমসাময়িককালের একজন শ্রেষ্ঠ ঈদিসভাষী লেখক হিসেবে তিনি বিবেচিত। নোবেল পেয়েছেন। ইহুদি জীবনের আখ্যান তাঁর রচনার মূল বিষয়। ছোটদের জন্যও প্রচুর লিখেছেন। অনূদিত এই সাক্ষাৎকার গৃিহত হয়েছিল ১৯৭৬ সালে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কানেকটিকাট বিশ্ববিদ্যালয়ের চিলড্রেন লিটারেচারের ক্লাসে।
সেই বয়সে, যখন আপনি তরুণ, কোন বইগুলো আপনাকে প্রচণ্ড প্রভাবিত করেছিল?
সিঙ্গার: সেই বয়সে প্রায় সকল লেখকই কমবেশি প্রভাবিত করেছেন, যখনই কোনও বই পড়ছি, ঠিক তখনই, সেই মুহূর্তেই সিদ্ধান্ত নিচ্ছি আমিও এমন একটি বই লিখব। তো, লেখকদেরকে অনুকরণ করতে শুরু করলাম এবং একসময় বুঝতে পারলাম এভাবে কিছুই হবে না, এই পদ্ধতি ভুল; ঠিক তখনই আমি নিজেকে আবিষ্কার করলাম যেন আমার নতুন করে জন্ম হলো।
নিজের জায়গাজমি খুঁজে পেলাম। নিজের ধরনে লিখবার পদ্ধতি খুঁজে বের করলাম। বের করলাম চিন্তা প্রকাশের নিজস্ব পথ। আর এখন তো এই পরিণত বয়সে এসে মনে হচ্ছে অনুভব করছি আমাকে কেউই সত্যিকার অর্থে অতিমাত্রায় প্রভাবিত করতে পারেননি। কারণ, জীবনের স্বাভাবিক নিয়মে স্বয়ং জীবনই লেখককে প্রভাবিত করবে।
তুমি যা করতে চাইবে, চিন্তা করতে চাইবে, যার যার সঙ্গে মিশতে চাইবে- এই সমস্ত কিছুর উপর জীবন প্রবল প্রভাব বিস্তার করবেই। তবে, এটা অস্বীকারের কোনও উপায় নেই যে আমার লেখার উপর কোনও না কোনও লেখকের প্রভাব তো পড়েছেই। কীভাবে অস্বীকার করি! প্রভাব তো পড়েছেই, এবং সেই লেখকের নাম নিকোলাই গোগোল।
তাঁর লেখা আমার বিশেষ প্রিয়। তাঁর গভীর অন্তর্দৃষ্টি আমাকে আক্রান্ত করেছে। বছর কয়েক আগে, গোগোলের একটি গল্প-সংকলনের আলোচনা লিখতে গিয়ে, তাঁকে ফিরে পড়ছিলাম যখন, নিজেকে বারবার বলছিলাম যদিও লোকটি আমার একশ বছর আগে বেঁচেছিল, তারপরও কীভাবে যেন সে আমার নিজস্ব কিছু কৌশল চুরি করতে পেরেছিল!
আপনি গল্পের ভেতর নিজেকে প্রবেশ করিয়ে দেন কেন?
সিঙ্গার: একথা তো একদমই সত্য যে সমস্ত সাহিত্যকর্মই আত্মজৈবনিক। আজ কিংবা আগামীকাল যে ‘তুমি’ লিখছো কিংবা লিখবে, তখন তুমি আসলে নিজেকেই লিখবে। তুমি যদি এমন কাউকে নিয়ে লিখো যাকে তুমি ঘৃণা করো, তাকে ঘৃণা করে কিছু লিখছো মানেই নিজেকে প্রকাশ করছো। এটাই আত্মপ্রকাশ। পাঠক যদি বুঝতে পারে কাকে তুমি ঘৃণা করো, তাহলে খুব সহজেই সে জানতে পারবে কাকে তুমি ভালোবাসো। প্রকৃতপক্ষে, সব কিছুকেই আমরা আমাদের আত্মা দিয়ে, চোখ দিয়ে, নিজস্ব চিন্তা দিয়ে, চিন্তার ভিন্নতা দিয়ে দেখে থাকি।
কোন লেখাগুলো আপনি বারবার পড়েন, পড়েছেন?
সিঙ্গার: একজন লেখককে সব ধরনের বইই তো পড়তে হয়। যখনই পড়াটাকে খুব আনন্দের সঙ্গে যাপন করতে চাই, আমি সোজা চলে যাই ঊনিশ শতকের মহৎ রচয়িতাদের কাছে। আমার জন্ম বিশ শতকে, কিন্তু সেটা একেবারে ঊনিশ শতকের কাছাকাছি সময়। এই শতকের লেখকরাই সত্যিকারের গল্পকথক।
তাঁরা কেউই সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী কিংবা মনঃসমীক্ষণবিদ নন। তলোস্তয়, বালজাক, দস্তইয়েভস্কি এবং ডিকেন্সের মতো মহৎদের কাছে আমি বারবার ফিরে যাই। আমার কেন যেন মনে হয়- অতিমাত্রায় সমাজবিদ্যা, মাত্রাতিরিক্ত মনোবিদ্যা, বিপুলসংখ্যক টিকা, মন্তব্য, ভাষ্য, বিবরণী, সাহিত্যের গুরুতর ক্ষতি করেছে।
আপনার মূল লেখালেখির মধ্যে যখন শিশুসাহিত্য নিয়ে কাজ করেন, তখন আপনার মনোজাগতিক অবস্থা কেমন থাকে?
সিঙ্গার: এ-প্রসঙ্গে বলতে চাই, আমার লেখালেখির পদ্ধতিগুলো আমি যখন প্রাপ্তমনস্কদের জন্য লিখছি, তখন যেমন, ঠিক তেমনই ছোটদের জন্য লেখার বেলাতেও সমান প্রযোজ্য। আমার বেলায় একটি গল্প লেখার জন্য তিনটি শর্ত পূরণ জরুরি। প্রথমটি হলো- একটি নকশা তৈরি করা। আমি সেই লেখকদের কথা বিশ্বাস করি না, যারা বলেন- তাঁরা জীবনের খণ্ডাংশ নিয়ে লেখেন।
এরকম লিখলে তাঁরা লেখার টেবিলে গিয়ে বসবেন আর তাঁদের কলমগুলো লেখকের অভিরুচি সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে আপনা আপনি লিখতে শুরু করবে! সাধারণ ক্ষেত্রে কলম কখনোই একটা ভালো কিছু সৃষ্টির তালে থাকে না। সুতরাং, লেখাজোকার ক্ষেত্রে এটাই আমার প্রথম শর্ত নকশা তৈরি করা। দ্বিতীয় শর্তটি হচ্ছে গল্পটি লিখবার জন্য আমার অনমনীয় আকাঙ্ক্ষা বা তীব্র তাড়না। মাঝেমাঝেই আমি পুরো একটি গল্প একটানে লিখে ফেলতে চাইলেও তীব্র তাড়নার অভাবে লেখাটি আর শেষ করতে পারি না। থেমে যেতে হয়। একারণেই এ-শর্তটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমার অবশ্যই থাকতে হবে সেই দৃঢ় বিশ্বাস, সেই মায়া, মোহ, বিভ্রম বা অলীকতা, যাকে লেখালেখির কুহক বলা যায়। লেখার টেবিলে, আমিই একমাত্র ব্যক্তি, কেবল আমিই পারি আমার গল্পটি লিখে ফেলতে।
দৃঢ় বিশ্বাস ছাড়া, মায়া-বিভ্রম-অলীকতা ছাড়া আমি কখনোই কাঙ্ক্িষত লেখাটি লিখতে পারব না। আমি যদি এই আস্থার উপর বিশ্বস্ত হই যে- এই হলো আমার গল্প, তাহলেই আমি লিখতে পারব।
আজকের দিনের শিশুসাহিত্যে, কোন বিষয়গুলোর উপর গুরুত্ব দেওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?
সিঙ্গার: এই যে-সময়ে আমরা বেঁচে আছি, এখন কেউ কেউ আমি জানি না তারা কারা এমনসব নিত্যনতুন পচনের, দূষণের, বিকৃতির জন্ম দিচ্ছেন যে এ-সময়ে বেঁচে থাকা লোকদের মনে হচ্ছে হয়তো এসব বিকৃতিই ভালো, উত্তম কিছু।
আরও দেখতে পাচ্ছি আমাদের সন্ততিদের ধ্বংস করে ফেলবার নানা আয়োজন চলছে। একটা বিশেষ শক্তি শিশুদের অন্ধকারের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। সময়টা একদম বদলে গেছে। যদিও আমি একথা বিশ্বাস করি না যে- একজন লেখক লিখতে বসবেন আর ছোটদের জন্য লিখে ফেলবেন হিতোপদেশমূলক কিছু কাহিনি। আজকের সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমধর্মী সময়ে বাস করে আমরা লেখকরা এটাই দেখাতে চাইব যে আমাদের আদরের সন্তানরা সেটাকেই বেছে নিচ্ছে যেখানে তাদের জন্য উপযুক্ত ধারণাসমূহ লিপিবদ্ধ আছে। টেন কমান্ডমেন্টস (ঈশ্বরকর্তৃক প্রদত্ত বিধানসমূহ) এবং এই সম্পর্কিত আরও কিছু লেখাপত্র- এসবই তাদের জন্য প্রযোজ্য।
ঈশ্বরের সেই দশটি বিধান আজকের দিনেও সমান প্রসঙ্গিক, যা আজ থেকে চার হাজার বছর আগেও প্রাসঙ্গিক ছিল আমরা আমাদের মা বাবাকে শ্রদ্ধা করব; অবশ্যই অন্যের সম্পদ লুট করব না, হত্যা করব না; আমি খুব স্বাধীনচেতা, স্বেচ্ছাচারী- এমন কিছু করব না। বড়দের জন্য লেখার চেয়ে শিশুসাহিত্য রচনাকালে নৈতিকতার বিষয়টি নিয়ে লেখককে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবেই।
একই সঙ্গে আমি ধর্মপ্রচারমূলক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে। একজন লেখক এমনভাবে তার পাঠকদের জন্য লিখছেন যেন জনৈক পাদ্রি গির্জার বেদি থেকে ধর্মের নসিহত করছেন- এ পথ কিছুতেই আমার পথ নয়। লেখক এমন একটি লেখা লিখুন, যে-লেখাটিতে সত্যিকার অর্থে নীতিজ্ঞান নিহিত থাকবে, ইঙ্গিতের মতো।