সম্প্রতি আন্তর্জাতিক সংগঠন রিসসো কোসেই কাই–এর আমন্ত্রণে ৩৫ জনের একটি দল জাপান ভ্রমণে যাই। বিভিন্ন বিষয়ে আমাদের গাইড করার জন্য সমসময় সহযোগিতায় ছিলেন আরকেকে বাংলাদেশ–এর শিক্ষা বিষয়ক প্রধান কাঞ্চন বড়ুয়া ও ইয়ুথ প্রধান অনুজ বড়ুয়া।
দীর্ঘ জার্নি শেষ করে বিমান যখন অবতরণ করার ঘোষণা দিলেন হঠাৎ খেয়াল করলাম বিমানের জানালায় আলোর রেখা, মুগ্ধ নয়নে অবলোকন করলাম সূর্যোদয়ের দৃশ্য। আহা! জাপান যেনো সূর্যোদয় দিয়ে স্বাগত জানালো আমাদের। মনটা স্নিগ্ধ আনন্দে ভরে গেলো। জাপানের স্থানীয় সময় ৬ টা ৩০ মিনিটে আমরা নিগাতা বিমান বন্দরে পৌঁছে যাই। আরকেকে বাংলাদেশ–এর দায়িত্বরত ব্রাঞ্চ প্রধান মরি মাসানুবু আগে থেকে অপেক্ষা করছিলেন নিগাতা বিমান বন্দরে। তিনি উষ্ণ অভ্যর্থনায় আমাদের জাপানে স্বাগত জানায়।
জাপানিরা খুব সুশৃঙ্খল জাতি। সময় এবং শৃঙ্খলা সেখানে অভাবনীয়। মিনিট নয়, সেকেন্ড ধরে সবাই চলাফেরা করেন। সবকিছু গণিতের অঙ্কে হিসেব করা। কর্মব্যস্ত মানুষ ছুটছে পাগলের মতো, কিন্তু কোথাও কোনো বিশৃঙ্খলা নেই। প্রায় তিনকোটি মানুষের শহর টোকিওতে মিনিটে মিনিটে ট্রেন বা বাস গন্তব্যে যাচ্ছে। কোথাও কোনো হৈ চৈ নেই। সবাই সচেষ্ট কীভাবে অন্যকে বিরক্ত না করে বা কষ্ট না দিয়ে চলা যায়। পথে টোকিও টাওয়ার জাপানের এক অনন্য স্থাপনা।
ঘুরে আসলাম শিনজুকি গার্ডেন। অসংখ্য দেশি বিদেশি পর্যটকে পরিপূর্ণ ছিলো পার্ক এর পরিবেশ। এই পার্কে ৯০০ চেরি গাছ জুড়ে সাকুরা ফুল ফুটে আছে। কী অপূর্ব শোভা পুরো পার্ক জুড়ে। মনে হচ্ছিল যেনো এক স্বর্গীয় আনন্দ ছুঁয়ে আছে চেরি ফুলের সাদা গোলাপি সৌন্দর্যে…। সত্যি খুবই সৌভাগ্যবান মনে হচ্ছে নিজেকে এমন একটি দুর্লভ ফুল ছুঁয়ে দেখার সুযোগ পেলাম। রেইনবো ব্রিজ টোকিও– ৭টি ব্রিজ একত্রে করে এই ব্রিজ তৈরি করা হয়েছে। দৃষ্টিনন্দন টোকিও’র ফুজি টিভি এলাকা ওদাইবা। পর্যটক মুখরিত টোকিও’র সবচেয়ে বড় আর্টিফিশিয়াল আইল্যান্ড ওদায়বা। জাপানের জনপ্রিয় ঐতিহ্যবাহী টেলিভিশন স্টেশন ফুজি টিভির অফিসটা এখানেই। প্রতিদিন হাজারো পর্যটকের ভিড়ে মুখরিত থাকে দৃষ্টিনন্দন এই এলাকা। জাপানের সবচেয়ে বড় মিডিয়া গ্রুপ এটি। প্রতিটি কদমে পাবেন অধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়া। মানুষের সততা ও সহযোগিতার মনোভাবেও আপনি মুগ্ধ হবেন।
আসাকুসা টেম্পল –
আসাকুসার স্ক্র্যাম্বল ক্রসিং পেরিয়ে পৌঁছালাম সেনসোজি টেম্পলে। এই প্রথম চোখে পড়লো বিশাল আকারের লণ্ঠন, সে সত্যিই বিশাল একটি লাল, একটি কালো। মন্দিরের গেটের মাঝখানে ঝোলানো।
ভেতরে ঢুকতে দেখা গেলো দুদিকে সারি দিয়ে নানান দোকান, খাবারের, মিষ্টির, ঘর সাজানোর, চিনামাটির বাসন, ব্যাগ, ছাতা, খেলনা, আইস–ক্রিম, কি নেই, একদম মেলা মনে হচ্ছিল। এই বিহারটি ৬৪৫ খ্রিস্টাব্দে সম্পন্ন হয়, এটি টোকিওর প্রাচীনতম মন্দির। আমাদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিলো কারণ সেদিন ছিলো জাপানে রৌদ্রময় দিন। বেশ আনন্দের সাথে আমরা উপভোগ করলাম ফুজি পর্বত এর অসাধারণ সৌন্দর্য। মনে হচ্ছিল পর্বতটি সাদা মেঘের সাথে মিশে এক অপূর্ব মায়াময় করে রেখেছে চারপাশের পরিবেশ।
নিগাতা শহরের ছোট্ট সুগানামা গ্রামে আমাদের রিসসো কোসেই কাই এর প্রতিষ্ঠাতার জন্মস্থান। আমরা টোকিও জশশ হেড কোয়াটার থেকে রওয়ানা দিয়ে চারপাশের অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে বরফের পাহাড়ের ভেতর দিয়ে বেশ কয়েকটি টানেল পার করে সবশেষে ১১ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি টানেল পার হয়ে বরফাচ্ছাদিত শহর জাপানের নিগাতা প্রবেশ করলাম। এই প্রথম এমন বরফের পাহাড় দেখার অপূর্ব অনুভূতি সত্যি প্রকাশ করার কোনো ভাষা নেই।
জশশ বর্তমান প্রেসিডেন্ট আমন্ত্রিত সকল দেশ এর নাম উচ্চারণ করে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন। যখন প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ এর নাম বললেন আমরা সবাই দাঁড়িয়ে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললাম শুভ সকাল। বাংলাদেশ থেকে জাপান ভ্রমণে এসে আমরা ভীষণ আনন্দিত। আমরা বাংলাদেশকে সবার সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি দেশীয় পোশাক পরিধানের মাধ্যমে।
দীর্ঘ ১১ দিন ভ্রমণে জাপানকে যতটুকু দেখেছি প্রতিমুহূর্ত বিস্ময়ে বিমুগ্ধ অভিভূত হয়েছি। জাপানের সভ্যতা সংস্কৃতি প্রযুক্তি ও মানুষের অসাধারণ বিনয়ী আচরণ প্রশংসনীয়। প্রাকৃতিক সম্পদ না থাকা সত্ত্বেও কেবল জনগণের সৃজনশীলতা ও আন্তরিক প্রচেষ্টায় কীভাবে একটা সুন্দর প্রযুক্তি সমৃদ্ধ দেশ গড়ে তোলা যায় সেটা যদি আপনি দেখতে চান তাহলে জাপান একটি অনন্য উদহারণ। ১৮টি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজসহ সাগর আর পাহাড়ের অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য জাপান ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য স্বর্গপুরী। তাই সময় পেলে অবশ্যই কাছ থেকে দেখে আসবেন সূর্যোদয়ের দেশ জাপানকে।