এই উপমহাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় বাংলাদেশে দুর্গাপূজা প্রধান উৎসব রূপে গণ্য হয়ে আসছে। এ পূজা শুধুমাত্র বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, সমপ্রদায়ের গণ্ডি পেরিয়ে দুর্গোৎসব আজ জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে। জাতি–ধর্ম–বর্ণ নির্বিশেষে সর্বজনীন এ দুর্গোৎসবকে ঘিরে সবার মধ্যে গড়ে ওঠে এক সৌহার্দ্য–প্রীতি ও মৈত্রীবন্ধন। অনাদিকাল ধরে এ দেশের হিন্দু সমপ্রদায় আশ্বিনের শুক্লা–পঞ্চমী তিথি থেকে দশমী পর্যন্ত সিংহ বাহিনী দেবী দুর্গার দশভুজা প্রতিমার মাধ্যমে বিশ্বের মহাশক্তির আরাধনা করে আসছে। এবার পূজা হচ্ছে কার্তিক মাসে। দেবী দুর্গা সব দেব–দেবীর সমন্বিত পরমা শক্তি। তিনি শুভ শক্তিরই প্রতীক। ঈশ্বর সর্বশক্তিমান, তাই তিনি ইচ্ছা করলে যে কোনো কাজ যে কোনো সময়ে সম্পাদন করতে পারেন এবং যে কোনো রূপ ধারণ করতে পারেন। ঈশ্বরের রূপ দু’টি– একটি সাকার, অন্যটি নিরাকার। সাকার রূপের নাম দেবতা এবং তাঁর নিরাকার রূপের নাম ব্রহ্ম। ঈশ্বরের নিরাকার রূপটি নির্দিষ্ট হলেও আকার রূপটি নির্দিষ্ট নয়। ভক্ত যদি ভক্তির সাথে যেকোনো বাস্তব, অবাস্তব ও কাল্পনিক কিংবা অন্য কোনো রূপে তাঁকে আরাধনা করে তবে সেই রূপেও ঈশ্বর ভক্তকে কৃপা করতে পারেন। ঈশ্বরের রূপ তাই মুখ্য নয়, ভক্ত কোন আকৃতিতে তাঁকে আরাধনা করল এটা কোনো বিষয় নয়। এক্ষেত্রে ভক্তের ভক্তি, শ্রদ্ধা ও উদ্দেশ্যই অধিক গুরুত্বপূর্ণ। হিন্দুরা প্রধানত দু’টি রূপে তাঁকে আরাধনা করে। এর একটি প্রেমিক রূপে, অন্যটি মাতৃরূপে। ঈশ্বরের মাতৃ রূপের নাম দুর্গা। তিনি দুর্গতি নাশ করেন বলে ‘দুর্গা‘। আবার দুর্গম নামক অসুরকে বধ করেছেন বলেও ‘দুর্গা’। অবশ্য তিনি মহিষাসুরকে সংহার করেছেন বলে মহিষাসুর মর্দিনী এবং জগতের শক্তি ও মায়ার আধার বলে মহামায়া–মহাশক্তি। বিভিন্ন গুন ও রূপের উপর ভিত্তি করে অবশ্য তাঁকে চণ্ডী, কালী, তারা, কাত্যায়নী, উমা প্রভৃতি নামে ও সম্বোধন করা হয়। তবে রূপ তাঁর যতই বৈচিত্র্যময় হোক না কেন, দুর্গার মূল পরিচয় শক্তির দেবী হিসেবে। তিনি ঈশ্বরের শক্তির প্রতীক। বিশ্বের সব শক্তির উৎস হিসেবে তাঁকে কল্পনা করা হয়। দেবীকে আবাহন : হাজারো কন্ঠের মধ্যে বাঙালিদের মনে একটি আনন্দনের প্রতীক্ষা, দেবীকে আবাহন। তিনি সবার মনকে আনন্দে ভরিয়ে দেন। তাই তিনি আনন্দময়ী। তিনি সবার দুর্গতি নাশ করেন তাই তিনি দুর্গা। যিনি দুর্গা, তিনিই পার্বতী, তিনিই উমা। এরকম ১০৮টি বিশেষণে তিনি ভূষিত। এ জন্যই কিনা জানি না, শ্রী রাম চন্দ্র ১০৮ টি নীলপদ্ম দিয়ে অকালে দেবীর পুজো করেছিলেন। আমরা শ্রীরাম চন্দ্রের সেই অকালকেই কাল ধরে দেবী দুর্গার পূজো করে আসছি। আর কালের দুর্গা পূজো হয়ে গেছে এখন বাসন্তী পুজো। শরৎ কালে শারদীয় যে পুজো অনুষ্ঠিত হয় সেটা হলো অকাল বোধন। অকালে অর্থাৎ বসন্ত কালের পরিবর্তে শরৎ কালে এ পুজো আয়োজন করা হয় বলে একে অকাল বোধন বলা হয়। বোধন শব্দের অর্থ জাগ্রত করা। নিদ্রিত সময়কালে কোন দেবতাকে জাগ্রত করার নামই হলো অকাল বোধন। অকাল বোধনে পূজা করেছিলেন ত্রেতাযুগের ভগবান শ্রীরাম। দশানন বীর বিক্রমশীল রাবনের লঙ্কাপুরী থেকে সীতা মা কে উদ্ধারের জন্য রাম অকালে এ পুজোর আয়োজন করেছিলেন। ভগবান রামের এ ঘটনা চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য অকাল বোধনই শারদীয় পূজোর প্রচলন ঘটেছে এবং এ পুজো পরিণত হয়েছে হিন্দুদের জাতীয় উৎসবে। সত্যযুগে রাজ্যহারা সুরথ রাজা এবং গৃহত্যাগী সমাধি বৈশ্য তাদের মনস্কামনা পুরনের জন্য দেবী দুর্গার পুজো করেছিলেন বাংলাদেশের মেধা নামক ঋষির আশ্রমে। যা বর্তমানে মেধস মুনির আশ্রম নামে পরিচিত। দ্বাপরযুগে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ভীষ্মপর্বে ভগবান শ্রী কৃষ্ণ অর্জুনসহ পঞ্চ পান্ডবদের এদেবীর স্তব স্ততির জন্য পরামর্শ দিয়েছিলেন। বিভিন্নকালে এ দেবী যুগের প্রয়োজনে বিভিন্ন নামে তিনি পূজিতা হয়েছেন! সবাইকে শারদীয় শুভেচ্ছা।