সমঝোতা করে চলতে না পারলে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা দায়

এমিলি মজুমদার | মঙ্গলবার , ২১ মে, ২০২৪ at ৮:৩৯ পূর্বাহ্ণ

আমাদের দেশের আঙ্গিকে, বিয়ে এমন একটা রীতি বা প্রথা যার মাধ্যমে দুজন নারী পুরুষ যুগলে স্থায়ীভাবে একত্রে বসবাসের বৈধতা পায়। আমরা সবাই জানি বিয়ে শুধুমাত্র স্বামী স্ত্রীর মধ্যেই সম্পর্ক গড়ে তোলে না, দুটো পরিবারের সকল সদস্যের মাঝেও সম্পর্ক গড়ে তোলে, জড়িয়ে যায় সম্পর্কের বন্ধনে দুটো পরিবার। সম্পর্কগুলোর সৌন্দর্য বা গভীরতা নির্ভর করে উভয়পক্ষের মন মানসিকতার উপর। সত্যি কথা বলতে কী, সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে হলে প্রথমেই যা দরকার, তা হলো সহিষ্ণুতা। এদিক থেকে আমাদের ছেলেরা অনেক পিছিয়ে, সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে মেয়েদেরকেই অনেক কিছু ছাড় দিয়ে, অনাচার অবিচার অত্যাচার সহ্য করে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হয়। যে মেয়ের সহ্য ক্ষমতা যত বেশি সেই বউ তত লক্ষ্মীমন্ত, সে সংসার তত সুন্দর! ছেলেরা স্বেচ্ছাচারিতা করে বেড়ালেও পরিবারের সম্মানে আঁচ লাগে না, স্ত্রী যদি মুখ বুজে সব সহ্য করে নেয়। বর্তমান বিয়ে বিচ্ছেদের কারণগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে স্ত্রীর প্রতি স্বামীর আধিপত্যবাদী মনোভাব বিচ্ছেদের একটা বড় কারণ। আগে মেয়েরা উভয় পরিবারের সম্মানের কথা চিন্তা করে, আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে মুখ বুজে সব সহ্য করে নিত। আজকাল স্বাবলম্বী হওয়ার সাথে সাথে মেয়েদেরও সহ্যক্ষমতা স্বাভাবিকভাবেই কমেছে, অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে শিখেছে তারা। আত্মসম্মান সম্পর্কে কিছুটা সচেতন হয়েছে, নিজেদের মত করে তারা জীবন সাজাতে শিখেছে, এই কারণে সংঘাতও বেড়েছে, সম্পর্ক বা বিয়েগুলো টিকছে না।

অভিজ্ঞতা বলে, সম্পর্ক মজবুত এমনি এমনি হয় না, নতুন পরিবারটাকে আপন করে নিতে হয়। আর এই আপন করে নেয়ার কথা মুখে বলা যতটা সহজ, বাস্তবে তার চাইতে অনেক বেশি কঠিন। ছেলে মেয়ে উভয়েরই এ্যাডজাস্টমেন্টের মানসিকতা না থাকলে, সম্পর্কে ভালোবাসা, বিশ্বাস, সম্মান না থাকলে সে সম্পর্ক ঠুনকো হয়ে পড়ে। বিয়ের পর অন্য নারী কিংবা পুরুষের প্রতি আসক্তি হলো বিচ্ছেদগুলোর আরেকটা বড় কারণ। সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে পরকীয়াযেভাবে শাখা প্রশাখা বিস্তার করে চলেছে তাতে এই সমস্যার জন্য সম্পূর্ণ না হলেও ৯০ শতাংশ ক্রেডিট দেয়া যায় এই টাচ্‌ সর্বস্ব মুঠোফোনকে। প্রযুক্তির কল্যাণে খুব সহজেই মানুষ অস্থায়ী সম্পর্ক জড়িয়ে পড়ছে, অন্যদিকে স্থায়ী সম্পর্কগুলো ভেঙে পড়ছে তাসের ঘরের মত ।

বর্তমানে ঘটনা ঘটার আগেই সবাই সবকিছু জেনে যায়, এটা আরেকটা বড় সমস্যা। আগে মেয়েদের শ্বশুরবাড়ির কষ্টের কথা বাপের বাড়িতেও শেয়ার করতো না। অনেক বড় সমস্যার সমাধানও গোপনে ছেলে মেয়ে উভয় পরিবারের হস্তক্ষেপে সমাধান করা হতো। যুগ পাল্টেছে, এখন নিজের জীবন পুরোপুরি নিজের ইচ্ছেতেই চালাতে সকলে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। এতে অন্য কারো হস্তক্ষেপ পছন্দ করে না ঠিক, তবে রাখঢাকে এরা বিশ্বাসী নয়। স্বাভাবিকভাবেই লোক জানাজানি হলে সমস্যা আরো গভীর হয়, আর এসব কারণেই ডিভোর্সের সংখ্যা দিন দিন আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলেছে।

ডিভোর্স’ বা ‘বিবাহ বিচ্ছেদ’, কথাটা উচ্চারণের আগে ভাববার জন্য অনেকটা সময় দরকার। হুট করে সিদ্ধান্ত নেয়ার মত বিষয় এটা নয়। বিশেষ করে স্বামীস্ত্রী যখন পিতামাতা, অর্থাৎ সন্তান যখন আসে তাদের জীবনে। ডিভোর্স হলে সবচাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সন্তানেরা, কারণ এই সন্তানদের বাবা অথবা মা দুজনের মাঝ থেকে একজনকে বেছে নিতে হয়। এতে করে সন্তান স্বাভাবিক জীবনযাপন থেকে বঞ্চিত হয়, মানসিক চাপে থাকে সবসময়। চলতে ফিরতে শুনতে হয় নানান বাজে মন্তব্য মাবাবা সম্পর্কে! অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ব্রোকেন ফ্যামিলির সন্তান মানসিক দিক থেকে সুস্থ থাকতে পারে না। বিয়ে নিয়ে সবসময় সবার মনে একটা স্বপ্ন থাকে, থাকাটাই স্বাভাবিক। তবে আগে তার সাথে সাথে ছিল ভয়, সংশয়। কোন পরিবেশে যাবো, মানুষগুলো কেমন হবে, মানিয়ে চলতে পারবো কিনা! আর বর্তমানে গুরুত্বপূর্ণ ভাবনাবিয়ের আনুষ্ঠান, সাজসজ্জা, ফটোগ্রাফি ইত্যাদি ইত্যাদি এককথায় শো অফের প্রবণতা! যত দিন যাচ্ছে অনুষ্ঠানের সংখ্যাও তত বাড়ছে, সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বিবাহ বিচ্ছেদ!

নিজ পছন্দের বিয়ে বা পরিবারের পছন্দের বিয়ে যেটাই হোক না কেন, ভিন্ন পরিবেশে বেড়ে ওঠা দুজন মানুষ একসাথে বসবাস শুরু করা সহজ ব্যাপার নয়। এর জন্য দুজনকেই একে অপরের সাথে মানিয়ে চলার নিমিত্তে নিজের অনেক পছন্দ অপছন্দ ছাড় দিতে হয়, গ্রহণ করে নিতে হয় এমন অনেক কিছু যা তার অপছন্দের তালিকায় ছিল কাল পর্যন্ত! তবে এক্ষেত্রে মেয়েদেরকেই বেশি ছাড় দিতে হয়, কারণ বাবার বাড়ি ছেড়ে এসে স্বামীর বাড়ি তথা স্বামীর স্বজনদের আপন করে নিতে হয় তাকে। যুগ পাল্টেছে, বদলেছে আমাদের চিন্তাভাবনা। আমার এই ধ্যানধারণার সাথে অনেকেই হয়তো একমত হবেন না, বলবেন হয়তো সমঝোতা করে তো জীবন চলে না। আমি বলবো সময়ে সমঝোতা করে চলতে না পারলে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা দায়। একটা সময় প্রত্যেককেই সমঝোতা করে চলতে হয়, সময় দিতে হয় সম্পর্কের ভিত মজবুত করার জন্য।

সত্যি কথা বলতে কী বর্তমানে ঔদ্ধত্যে বাড়ছে ছেলেমেয়ে উভয়ের, সম্মান/শ্রদ্ধাবোধ কমছে দিনদিন। মানিয়ে চলার মানসিকতা কমছে আশঙ্কাজনক হারে। এর ফলশ্রুতিতে ডিভোর্সএর সংখ্যা বাড়ছে হু হু করে ক্যান্সারের মত। মান্যগণ্যতা কমেছে ছোট বড়র মাঝেও। বর্তমান প্রজন্মের সেন্স অরগানগুলো এখন বেশ নাজুক, একটুতেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছে যায়। শুধু ডিভোর্স নয়, যে কোনও প্রাণঘাতি ডিসিশন নিয়ে নিতে পারে এরা মুহূর্তেই। এর অন্যতম কারণ আত্মকেন্দ্রিক মনোভাব। এখন নিজের সম্মানের ক্ষেত্রে সবাই বেশ টনটনে, তবে অন্যের সম্মান ধুলোয় মেশাতে মুহূর্ত চিন্তা করে না। পরিবারের আর দশজনের কথা চিন্তা করার সময় নেই কারো। কিন্তু আমরা বিষয়গুলো আগে এমনভাবে ভাবতে পারিনি। পরিবার পরিজন সমাজের কথা ভেবে নিজের কষ্টগুলোকে হজম করেছি।

সম্পর্কটাকে অনেকে এখন অতটা গুরুত্ব সহকারে দেখে না। প্রেম হতেও যেমন সময় লাগে না, ব্রেকআপ উচ্চারণের সাথে সাথে একেবারে ‘হার্ডব্রেক’, খুব সহজেই বলে দেয়, অমুকের সাথে আমার, অথবা তমুকের সাথে অমুকের ব্রেকআপহয়ে গেছে। বিয়ে বিচ্ছেদও ঠিক তেমনি। ধুমধাম করে বিয়ে দেয়ার পর এক সপ্তাহ্‌, একমাস, তিন মাস কিংবা ছয় মাসেই বিচ্ছেদ! ভাবতেই গা শিউরে উঠে। একটা নতুন মানুষকে জানা বোঝা, তার পরিবারে নিজের একটা জায়গা করে নেয়া কি এতটাই সহজ? আমি বিয়ে পরবর্তী সময়টাই ধরছি, কারণ যে সময়টাতে ছেলেমেয়েরা প্রেম করে, তখন তাদের দুচোখে থাকে শুধু স্বপ্ন, থাকে শুধু ভালোবাসাবাসি অর্থাৎ একে অন্যের মন জুগিয়ে চলা! আগে ছেলেমেয়ে লুকিয়ে প্রেম করতো, কথা হতো ইশারায়, চিঠিতে! বছরের পর বছর কেটে যেত এভাবে। বর্তমানে সব বেশ খোলামেলা। অল্পসময়েই মনে করে চিরচেনা, সবচাইতে আপন! একে অপরকে এতটা জেনে যায় যে, বিয়ের পর নতুন করে আবিষ্কারের আর কিছু থাকে না! পশ্চিমা দেশগুলোর মত আমরাও এখন ব্রেকআপ, আমার এক্স, বয়ফ্রেন্ড, গার্লফ্রেন্ড ইত্যাদি শব্দগুলো নির্দ্বিধায় উচ্চারণ করতে পারি।

আগেকারদিনে বিবাহিতদের রাতে বিছানা ছিল শুধু স্বামীস্ত্রীর। সারাদিন ব্যস্ততার মধ্যে সময় কাটিয়ে নিজেদের প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় কথোপকথন আবদার খুনসুটি নালিশ ইত্যাদির জন্য একটা সময় প্রয়োজন, আর সে সময়টা হলো সব কাজ শেষ করার পর এই বিছানা। এখন মোবাইলদুজনের মাঝে বেশ ভালো জায়গা করে নিয়েছে। মোবাইল জিনিসটা আকারে ছোট বলে অনায়াসে দুই বালিশের মাঝখানে জায়গা করে নেয়। এই ‘একের ভেতর সব’ ছোট্ট যন্ত্রটা অবস্থানগত দিক থেকে দুই বালিশে তেমন দূরত্ব সৃষ্টি না করলেও, মানুষ দুজনের মধ্যে বেশ দূরত্ব সৃষ্টি করে চলেছে। সঙ্গী হিসেবে মোবাইলের কাছে স্বামী বা স্ত্রীর সম্পর্ক হার মেনেছে। ডিজিটাল বন্ধুদের এ্যাটেন্ড করতে করতে পাশের মানুষটা ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে।

জীবনসঙ্গী হচ্ছে সুখেদুঃখে, আনন্দে, শান্তিতেঅশান্তিতে নির্ভরতার স্থান। যাকে আবেগে জড়িয়ে ধরা যায়, কেঁদে নিজেকে হালকা করা যায়, পাশে থাকলে সাহস পাওয়া যায়। এমনকি প্রয়োজনে অন্যের রাগ সঙ্গীর ওপর মনের আশ মিটিয়ে ঝাড়া যায়। কিন্তু সম্পর্ক এই পর্যায়ে পৌঁছাবার জন্য বেশ কিছুটা সময় প্রয়োজন। সময়ের প্রয়োজন একে অপরকে বুঝবার জন্য, একের প্রতি অন্যের টান সৃষ্টির জন্য, একজনের কাছে অন্যজনকে প্রয়োজনীয় করে তোলার জন্য।

যত্নে লালন করতে হয় সম্পর্ক। বয়স বাড়ার সাথে সাথে সম্পর্কের রঙ বদলে যেতে থাকে। একটা বয়সের পর ভালোবাসার সম্পর্কেও দৈহিক আকর্ষণ গৌন হয়ে যায়। চাওয়া পাওয়া বদলে যায়। তবে ভিত মজবুত হয়, হারানোর ভয় কমে যায়। সময়ের সাথে সাথে রোমান্স কমে যায় ঠিকই, তবে মায়ার বাঁধন শক্ত হয়। একের প্রতি অন্যের আকর্ষণ দৃশ্যত না বুঝা গেলেও, কাজে কর্মে, একের প্রতি অন্যের টান, নির্ভরতা প্রকাশ পায়। তবে সবকিছুর জন্যই প্রয়োজন সময়ের, প্রয়োজন স্থিরতা আর সহিষ্ণুতার।

লেখক: প্রাবন্ধিক, গল্পকার।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসুস্থ মন- সুস্থ দেহ গড়ে তুলে সুন্দর জীবন
পরবর্তী নিবন্ধবাংলাদেশ বিমান : সেবার মান বাড়িয়ে যাত্রীদের আস্থা অর্জন করতে হবে