এ লেখার শিরোনাম অনেক পাঠকের কাছে হেঁয়ালিপূর্ণ বলে মনে হতে পারে। আমার সেই পাঠকদের জন্য বিষয়টি একটু ব্যাখ্যা করছি। ইদানীং যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কৌশল প্রণেতারা এমনকি আরো কিছু পশ্চিমা দেশের নেতারা তাদের দেশের জনগণের সামনে বক্তব্য বিবৃতি দিতে গিয়ে এই প্রতিবাদী শ্লোগানটির মুখামুখি হচ্ছেন। শ্লোগানটির মর্মবাণী আমার কাছে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে হয়েছে। কারণ এইসব নেতারা বিশ্ব-ব্যাপী ইউক্রেনে, ফিলিস্তিনে এমনকি সাম্প্রতিকের দক্ষিণ ইয়েমেন বা তারও কিছু আগে আফগানিস্তান, ইরাকে গণহত্যায় গণ-দুর্ভোগে যে ইন্ধন বা তা বন্ধে যে নির্লজ্জ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন তাতে তারা এরকম একটি সম্ভাষণ পাওয়ারই যোগ্য – ‘শেইম অন ইউ’ তোমার লজ্জা থাকা উচিৎ অথচ তুমি নির্লজ্জ। তোমার জন্যই আজ পৃথিবীর এই দুর্দশা। তুমিই এর কারণ। সুতরাং তোমার লজ্জিত হওয়া উচিৎ অথচ তুমি নির্লজ্জ।
যুদ্ধ মানে শক্র শক্র খেলা
যুদ্ধ মানেই আমার প্রতি
তোমার অবহেলা।
কবি নির্মলেন্দু গুণের এ কবিতা যতবার পড়েছি, ততবারই মনে প্রশ্ন জেগেছে আসলে মানুষের প্রতি মানুষের অবহেলা জনিত কারণেই কি পৃথিবীতে মানুষ যুদ্ধে লিপ্ত হয়? মনে হয় মানুষের প্রতি মানুষের অবহেলা যুদ্ধের একটি অনুষঙ্গ মাত্র আসল কারণ নয়। আসল কারণ আধিপত্যের উদগ্র লালসা। আধিপত্যের এ লালসার মাঝে রয়েছে অর্থনৈতিক আগ্রাসন আর সামরিক প্রভুত্বের মানসিকতা। এই গতবছরের শেষ প্রান্তে ভারতে অনুষ্ঠিত হয় জি-২০ নেতাদের সম্মেলন। এ সম্মেলনের মূল শ্লোগান ছিল ‘বসুধা কুটুম্বা’। বসুধা কুটুম্বা’র সারর্মম হল, গোটা পৃথিবী একটি পরিবার। পরিবারের একের কষ্টে সব সদস্য যেন সমব্যথী হয় সেরকম। বাস্তবে এ পৃথিবীতে তাই কি ঘটছে? মোটেও না। তার প্রমাণ চলমান রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ। বার্লিন ওয়াল ভাঙার আগে যুক্তরাষ্ট্রের সেই সময়ের পররাষ্ট্র মন্ত্রী জেমস বেকার সোভিয়েৎ ইউনিয়নকে কথা দিয়েছিলেন। বার্লিন ওয়াল ভাঙা হলে ন্যাটো তথা যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপে আর রাশিয়ার দিকে এগুবে না। এই আশ্বাসে ১৯৬১ সালে নির্মিত বার্লিন ওয়াল নভেম্বর ১৯৮৯ সালে ভেঙে ফেলা হয়। ১৯৯১ সালে সোভিয়েতেরও পতন হয়। ইতোমধ্যে ‘ওয়ারশ প্যাক্ট’ এর ও অবসান হয়। রয়ে যায় যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ‘ন্যাটো’। এই ন্যাটোর ছত্রছায়ায় জেমস বেকারের সেই ওয়াদার বরখেলাপ করে যুক্তরাষ্ট্র ক্রমাগত রাশিয়ামুখি তৎপরতা অব্যাহত রাখে। রাশিয়া যতই ন্যাটোকে না আগানোর তাগাদা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র তথা ন্যাটো সেটি আমলে না নিয়ে বরং আরো আগ্রাসী ভূমিকা নিয়ে ইতোপূর্বের সোভিয়েত প্রভাব বলয়ের রোমানিয়া, পোল্যান্ড, চেকোশ্লোভাকিয়া ছাড়াও সোভিয়েতভুক্ত অঞ্চল লাটবিয়া, মনরোভিয়া, জর্জিয়া ইত্যাদিকে একে একে জোটভুক্ত করতে থাকে। রাশিয়া যতই ‘ডোন্ট প্রসিড মোর’ বলে সাবধান বাণী উচ্চারণ করেছে, ন্যাটো ততই এগিয়েছে অনেকটা তাচ্ছিল্যের মনোভাব নিয়ে। এই করতে করতে ন্যাটো একসময় রাশিয়ার নিকটতম প্রতিবেশী ইউক্রেনে ঢুকে পড়ে। ভ্লাদিমির জেলেনেস্কি’র মাধ্যমে ন্যাটো ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্য করার আয়োজন প্রায় সম্পন্ন করে। এমতাবস্থায় রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন তার সিদ্ধান্ত এবং পূর্ব হুশিয়ারী অনুযায়ী ইউক্রেন অভিযান শুরু করেন। ইউক্রেন যুদ্ধ এখন তৃতীয় বছরে। এ যুদ্ধ বন্ধের কোন কার্যকরী উদ্যোগ বা প্রস্তাব এখনও কোনও পক্ষ থেকে উত্থাপিত হয়েছে তা বিশ্ববাসীর নজরে আসেনি। বর্তমানে এ যুদ্ধের ফলশ্রুতি হিসাবে ৫০ (পঞ্চাশ) লক্ষের উপর ইউক্রেনীয় অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্ত্তুতে পরিণত। ৬০ (ষাট) লক্ষের উপর ইউক্রেনীয় ইউরোপের দেশে দেশে আশ্রয়প্রার্থী। বর্তমানে এক তৃতীয়াংশ ইউক্রেনীয় দারিদ্রসীমার নিচে বসবাস করছে। পৃথিবীর অন্যতম খাদ্যশস্য রপ্তানীকারক দেশ ইউক্রেনের চাষীরা রাশিয়ান ল্যান্ড মাইনের ভয়ে ঠিকমত চাষাবাদ করতে পারছে না। ইউক্রেনের শিক্ষাব্যবস্থা প্রায় বিপর্যস্ত।
এই যুদ্ধাবস্থা আমাদের জন্যও কম বিপর্যয় বয়ে আনেনি। আমাদের সে বিপর্যয় অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে। এটি দুটি ক্ষেত্রে আমাদের অর্থনীতিতে সবচেয়ে বেশি নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। প্রথমত জ্বালানি তেল। যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার উপর সর্বাত্মক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। সে নিষেধাজ্ঞা আরোপের ফলশ্রুতিতে ইউরোপিয় দেশ গুলি জা্বলানী উৎসের বিকল্প হিসাবে মধ্যপ্রচ্যের উপর তাদের চাহিদার চাপ বাড়িয়ে দেয়। উল্লেখ্য বাংলাদেশের জ্বালানী চাহিদার বড় অংশ পূরণ হয় মধ্যপ্রাচ্য থেকে। এদিকে ইউরোপিয় জ্বালানী চাহিদার প্রায় ষাট শতাংশই ইতিপূর্বে পূরণ হয়েছে রাশিয়া থেকে। চাহিদা বাড়ার সাথে সাথে মধ্যপ্রাচ্যে জ্বালানী তেলের দামও বেড়ে যায়। এই দাম বাড়ার খেসারত দিতে হচ্ছে আমাদের অর্থনীতিকে। অন্যদিকে তুরস্কের মধ্যস্থতায় রাশিয়া এবং ইউক্রেনের মধ্যে ইউক্রেনীয় খাদ্যশস্য রপ্তানির যে চুক্তি হয়েছে সে অনুযায়ী খাদ্যশস্য বাহী জাহাজগুলিকে প্রথমে খালি অবস্থায় একবার ইস্তাম্বুল বন্দরে গিয়ে কোনও যুদ্ধাস্ত্র নাই তার প্রত্যায়ন পত্র সংগ্রহ করতে হয়। খাদ্যশস্য বা পণ্য বোঝাই এর পর পুনরায় ঐ জাহাজকে ইস্তাম্বুল বন্দরে গিয়ে কোন ধরনের অবৈধ মালামাল নাই তার প্রত্যায়ন পত্র সংগ্রহ করতে হয়। আসা যাওয়ার এই সময় এবং প্রত্যায়ন সংগ্রহের অপেক্ষমান থাকা এসব কিছু মিলিয়ে একেকটি জাহাজকে লক্ষ লক্ষ ডলার অতিরিক্ত ব্যয়ভারের মুখামুখি হতে হচ্ছে। এই অতিরিক্ত ব্যয় আমাদের আমদানীকারকদেরই বহন করতে হয় যা শেষতক আমাদের মত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ঘাড়ে এসে চেপে বসে। পশ্চিমা বাঘা বাঘা অর্থনীতিবিদরা তাদের অর্থনীতির সমস্ত মারপ্যাচ বুঝেন আর দেখেশুনে মনে হয় আমাদের এই কষ্টের বোঝার কথা তারা কিছুই বুঝেন না এমনই অবোধ তারা। ইউক্রেন যুদ্ধের মূল লক্ষ্য ছিল রাশিয়াকে কাবু করা সেটা সামরিক এবং অর্থনৈতিক দুভাবেই। পুতিনের ‘স্মার্ট মুভ’এ পশ্চিমাদের সে পরিকল্পনা ভেস্তে তো গেছেই এখন বরং ইউক্রেনের অস্তিত্বই সংকটে। ইতিহাসের পাতা কিছুটা পিছনদিকে উল্টিয়ে দেখলে আমরা দেখব এই অর্থনৈতিক স্বার্থদন্দ্বে মানুষের যাত্রা পথ আরো বহুবার রক্তাক্ত হয়েছে।
১৮০০ শতকে তৎকালীন উপনিবেশবাদী বৃটেন আর সাম্রাজ্যবাদী জারতন্ত্রাধীন রাশিয়ার স্বার্থ সংঘাতের লীলা ভুমিতে পরিণত হয় আফগানিস্তান। বৃটেন আর রাশিয়ার আফগানিস্তানকে ঘিরে যে স্বার্থ সংঘাত তা ইতিহাসে ‘The Great Game ’ (দি গ্রেট গেইম) হিসাবে বিখ্যাত হয়ে আছে। রাশিয়ার মধ্য এশিয়ায় একের পর এক স্বাধীন ভূখণ্ড – অন্যদিকে বৃটেনের ভারতীয় উপ মহাদেশ দখল এই গ্রেট গেইমের জন্ম দেয়। বৃটেনের ভারতীয় উপনিবেশকে নির্বিঘ্নে শাসন করার নিমিত্তে রাশিয়ার যে কোন উচ্চাভিলাষের বিরুদ্ধে হিন্দুকুশ পর্বতমালাকে এক স্বাভাবিক প্রতিবন্ধক হিসাবে পাওয়ার আগ্রহ- আর রাশিয়ার বৃটেনের মধ্য এশিয়ার দিকে যে কোনও অভিযানকে ব্যর্থ করে দিতে আফগানিস্তানকে ব্যবহার করতে চাওয়ার মাঝেই এই অঞ্চলের তৎকালীন কৌশলগত গুরুত্ব নিহিত।
পল এবং এলিজাবেথ দুজন স্বামী স্ত্রী। এই দুজন চমৎকার একটি বই লিখেছেন। তারা তাদের বই ‘ইনভিজিবল হিস্ট্রি-আফগানিস্তান’স আনটোল্ড স্টোরি র দু জায়গায় দুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের অবতারনা করেছেন। প্রথম বিষয়টি হল ‘Since the 1950’s the CIA has played games with both reactionary, feudal landlords and wild – eyed Muslim fundamentalists . অর্থাৎ আমেরিকান কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সি আই এ সেই ১৯৫০ এর দশক থেকে আফগানিস্তানে প্রতিক্রিয়াশীলগোষ্ঠী, ভূস্বামী আর একরোখা মুসলিম মৌলবাদীদের নিয়ে বিভিন্ন ষড়যন্ত্রে মেতেছে’ । দ্বিতীয় প্রসঙ্গটি হল “From the dawn of the cold war onward, generation of conservative strategists have eyed Afghanistan as a launching pad first for the subversion of the USSR and then to check mate Russia in Central Asia.’ ‘স্নায়ু যুদ্ধের শুরু থেকে আমেরিকার রক্ষণশীল কৌশল প্রণেতারা আফগানিস্তানকে প্রথমত সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে পরিচালিত অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপের ভিত্তিভূমি বা উৎপত্তিস্থল হিসাবে এবং পরবর্তীতে মধ্য এশীয় অঞ্চলসমূহে রাশিয়াকে বাগে রাখার জন্য ব্যবহার করতে প্রচেষ্টা গ্রহণ করে’। আফগানিস্তানকে দখলে রাখার সোভিয়েত, বৃটেন বা যুক্তরাষ্ট্রের প্রচেষ্টার প্রতিটির পিছনে একটিই মুখ্য বিষয় কাজ করেছে সেটি হল স্ব স্ব অর্থনীতিকে শক্তিশালী এবং নিরাপরাধ রাখা।
সাম্প্রতিকের ইতিহাসে বৃটেন-রাশিয়া পরাস্ত হয়ে আফগানিস্তান থেকে বিদায় নিলেও এ থেকে যুক্তরাষ্ট্র কোনও শিক্ষা গ্রহণে ব্যর্থ হয়। এ শিক্ষা থেকে যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে এমনি এমনি বিরত রাখেনি হয়ত। তার ভূ-কৌশলগত স্বার্থ তাকে তা থেকে বিরত থাকতে প্রলুব্ধ করেছে নিশ্চিতভাবে। এ ভূ-কৌশলগত স্বার্থের দিকে দৃষ্টিপাত করলে বা এর পিছনের অন্তর্নিহিত তাৎপর্যটুকু বিশ্ল্লেষণ করলে এ অঞ্চলের প্রতি মার্কিন মনোভাব স্পষ্ট হবে। একদিকে উগ্রপন্থীদের উত্থান আর সামরিক শাসনের অশান্ত পরমানু শক্তির পাকিস্তান- অন্যদিকে ইরান-পারমানবিক শক্তি অর্জনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এই দুই দেশের মাঝে অবস্থান আফগানিস্তানের। আফগানিস্তানে একটি তাবেদার সরকার থাকলে এই কেন্দ্রভূমি থেকে আমেরিকা তার ভূ-রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য অর্জনে আনায়াস সুবিধা নিশ্চিত করতে পারবে। ভূ-রাজনৈতিক এই লক্ষ্যের মধ্যে থাকবে পাকিস্তানের পারমানবিক স্থাপনা সমূহের উপর কার্যকরী প্রভাব এবং সরাসরি নজরদারী বজায় রাখা, ইরানের উপর মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টির মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের তাবেদার সরকার সমূহকে আশ্বস্ত রাখা।
এই ইপ্সিত লক্ষ্য অর্জনে যুক্তরাষ্ট্র তার পশ্চিমা মিত্রদের সঙ্গে নিয়ে আফগানিস্তানে দীর্ঘ লড়াই চালিয়েছে। এর পরিণাম হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে নির্মম পরাজয়ের এক কালিমা ললাটে ধারণ করে আফগানিস্তান থেকে বিধায়। এ যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রকে যেমন চরম মূল্য দিতে হয়েছে তেমনি লক্ষ লক্ষ আফগান সাধারণ নাগরিককে একটানা বিশ বছর যাবত যুক্তরাষ্ট্রের আক্রমণের শিকারে পরিণত হয়ে জীবন দিতে হয়।
লেখক: কলামিস্ট; সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক।