১২ দিন চলার পর আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ২৪ জুন ন্যাটো সম্মেলনে যোগ দিতে নেদারল্যান্ডের দি হ্যাগ এ যাওয়ার পূর্বে ইসরাইল –ইরানের যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করেন। তবে যুদ্ধ বিরতি কতদিন স্থায়ী হয় তা এখন বিশ্ববাসী দেখার অপেক্ষায়।
আমেরিকার কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইরান বিষয়ক অধ্যাপক হামিদ দাবশি’র বক্তব্য থেকে আজকের এই লেখাটির শিরোনাম। পারমাণবিক জ্বালানী ‘সমৃদ্ধকরণ আলোচনাযোগ্য নয়’ ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী’র এ বক্তব্যে থেকেই হয়ত ইসরাইল এবং আমেরিকা ইরান আক্রমণের খোড়া যুক্তি খুঁজে নেয়। তারা ইরানের শান্তিপূর্ণ এবং বেসামরিক কাজে ইরান তার পারমাণবিক কর্মসূচি পরিচালনা করার অধিকার রাখে সে বিষয়টি হয়ত একবারও বিবেচনায় নেয়নি। এমন এক প্রেক্ষাপটে একদিন হাতে রেখে তাড়াহুড়া করে কানাডর জি–৭ সম্মেলন থেকে মার্কিন প্রেসিডেন্টের ফিরে আসা ইত্যাদি থেকে বিশ্ববাসী একধরনের আশংকা এবং অস্বস্থিতে ছিলেন। ইসরাইল–ইরান যুদ্ধের মোড় কোন দিকে নিতে যাচ্ছে! আমেরিকা কি ইরান আক্রমণ করবে? এমন এক ভাবনা সচেতন মানুষদের পেয়ে বসেছিল।
অন্যদিকে যুদ্ধ চলমান অবস্থায় পৃথিবীর মননশীল মানুষেরা একটি ক্ষীণ আশার আলোও দেখতে পাচ্ছিলেন। সে আলোর ক্ষীণ রেখা বিচ্ছুরিত হচ্ছিল জেনেভা থেকে। জেনেভায় ২০ জুন ইরানী পররাষ্ট্র মন্ত্রীর সাথে যুক্তরাজ্য্র, ফ্রান্স এবং র্জামানীর পররাষ্ট্র মন্ত্রীরা আলোচনায় বসেছিলেন।
এমন আশা নিরাশার মাঝে পৃথিবীর আশাবাদী, যুদ্ধবিরোধী মানুষদের একেবারে নিকষকালো অন্ধকারে ছুঁড়ে দিয়ে ২১ জুন ২০২৫ আমেরিকা ‘অপারেশন মিডনাইট হ্যামার’ নাম দিয়ে ইরান আক্রমণ শুরু করে। এই হামলায় অংশ নিতে আরিজোয়ানার হোয়াইটম্যান এয়ার বেইস থেকে ৭ টি বি ৫২ বোমারু বিমান আকাশে উড়াল দেয়। প্রতিটির বুকে ছিল ৩০০০০ (ত্রিশ হাজার) পাউন্ড ওজনের ২ টি করে জি বি ইউ–৫৭/বি বাংকার বাস্টার বোমা। উল্লেখ্য বি ৫২ এই বোমারু বিমান ৭০০০০ (সত্তুর হাজার) পাউন্ড পর্যন্ত বোমা বা সমরাস্ত্র নিয়ে লক্ষ্যবস্ত্তুর উদ্দেশ্যে উড়াল দিতে পারে। আটলান্টিক মহাসাগর এবং মেডিটেরিায়ন হয়ে বিমানগুলি মধ্যপ্রাচ্যের আকাশে প্রবেশ করে। এসময় আমেরিকার বি ৫২ বোমারু বিমানগুলি দীর্ঘ ১৮ ঘন্টা উড়াল সময় পার করে। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে বিমানগুলি আকাশে দুবার জ্বালানীও নেয়। এইসব বিমান ভোর রাতে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা ফ্্রাদো, নাথানজ এবং ইস্পাহানে তাদের বয়ে আনা ১৪টি বোমা বর্ষণ করে। এ হামলার পূর্বে ইরানের উদ্দেশ্যে অবস্থানরত যুদ্ধ জাহাজগুলি থেকে ইরানের বর্ণিত পারমাণবিক স্থাপনাগুলিকে লক্ষ্য করে ৭৫ টি গাইডেড টমাহক মিসাইল ছোঁড়ে, এগুলির উদ্ধেশ্য ছিল স্থাপনাগুলির বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে নিস্ক্রিয় করা। এ হামলায় আমেরিকা বিভিন্ন ধরনের ১২৫ টি যুদ্ধ বিমান অংশগ্রহণ করে।
হামলান্তে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এ মিশনে অংশগ্রহণকারীদের সাফল্যে তাদের আমেরিকার সাহসী সন্তান হিসাবে অভিনন্দিত করেন। আমেরিকা এবং ইসরাইলী প্রেসিডেন্টরা পরস্পরের সাফল্যে পরস্পরকে অভিনন্দিত করেন। এখানে ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী নাথানিয়াহুর সাফল্য বিশেষভাবে উল্লেখ্য তা হল, শেষ পর্যন্ত আমেরিকাকে তিনি যুদ্ধে টেনে আনতে পেরেছেন, আর ট্রামের সাফল্য তিনি মিথ্যার আশ্রয়ে ইরানকে আলোচনার টেবিলে রেখে ইসরাইলকে ইরান আক্রমণে সহায়তা করতে সফল হয়েছেন। কিন্ত্তু আসলেই তারা কি সফল হয়েছেন? উত্তর না।
কারণ তারা ‘এপিক বিট্রায়েল’ বা ঐতিহাসিক এক বেইমানি বা মোনফেকিতে নিজেদের জড়িত করেছেন। এটা পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যম থেকে পাওয়া, আমার ব্যক্তিগত কোন আক্রোশ বশবর্তী শব্দ চয়ন নয়। আমেরিকা এবং ইসরাইলী প্রেসিডেন্টর ঐতিহাসিক এই বেইমানি বা মোনফেকির উদাহরণগুলো একে এক তুলে ধরছি।
ইরান–আমেরিকা পরমাণু বিষয়ে আলোচনা চলমান ছিল। আলোচনা ৫ম পর্ব পেরিয়ে ৬ষ্ঠ পর্ব নির্ধারিত ছিল ১৫ জুন। আলোচনায় কোন অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে তেমনটি কোন পক্ষই বলেনি। এরই মাঝে ৬ষ্ঠ আলোচনা শুরু করার দুদিন আগে অর্থাৎ ১৩ জুন অর্তকিতে ইসরাইল ইরান আক্রমণ করে বসে। এ হল প্রথম মোনাফেকি!
ইরান– ইসরাইল যুদ্ধ চলমান। এর মাঝে ২০ জুন জেনেভায় যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং র্জামানীর পররাষ্ট্র মন্ত্রীদের সাথে ইরানী পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কানাডার জি–৭ সম্মেলন থেকে একদিন আগে ফিরে এসে ২১ জুন ইরানী পারমাণবিক স্থাপনায় আক্রমণ পরিচালনা, অথচ ডোনাল্ট ট্রাম্প আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য ২০ দিন সময় ঘোষণা করেছিলেন।এ সময় পার হওয়ার আগেই আমেরিকা ইরান আক্রমণ করে বসে। এ হল দ্বিতীয় মোনাফেকি।
আমেরিকান বিখ্যাত চিন্তাবিদ নোয়াম চমস্কি রোমান সাম্রাজ্য এবং গ্রীকদের পতন’ এর কারণ উল্লেখ করতে গিয়ে বলেছেন, অবিচার–অন্যায়–শঠতা–দুর্নীতি ইত্যাদি এসব সাম্রাজ্য আর সভ্যতার পতন ত্বরান্বিত করেছিল। একই পথে বর্তমান যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইলের যাত্রা। এদের পতনও অনিবার্য।
অথচ ১৯৪৫ সালে আমেরিকার সানফ্রানসিসকোতে দ্বিতীয় বিশ্ব–যুদ্ধোত্তর বিষন্ন বির্পযস্ত বিশ্ব নেতারা অনেক আশা আর আস্থা নিয়ে ইউনাইটেড নেশনস’ গঠন করেছিলেন। তাদের সে সময়ের লক্ষ্য তথা অভিপ্রায় ছিল যুদ্ধের ধ্বংস লীলার বিরুদ্ধে এশিয়া আফ্রিকা এবং ল্যাটিন আমেরিকার কোটি মানুষের ক্ষুধা, দারিদ্র্য, নিপীড়ন, ইত্যাদি দূর করে মানুষের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা। দুর্ভাগ্য সে পথে বর্তমান বিশ্ব ত হাঁটছেই না বরং নানা অঞ্চলে যুদ্ধেও বিষবাস্পে পৃথিবী কলুষিতই হচ্ছে। আজকের আমেরিকা বা ইসরাইল ইরান আক্রমনের পূর্বে ইরানকে ত নয়ই এমনকি এ আক্রমণের ব্যাপারে জাতি সংঘকে কোন ধরনের পরোয়া করেনি। তারা (আমেরিকা – ইসরাইল) ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় আক্রমণ পরিচালনার পূর্বে আই এ ই এ (ইন্টারন্যাশনাল এ্যাটমিক এর্নাজি এজেন্সি), জাতিসংঘের এই সংস্থাকেও সামান্য ধর্তব্যের মধ্যে আনেনি। তারা একবারও ভাবেনি, ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা আক্রান্ত হলে তার থেকে পারমাণবিক বিকিরন বা রেডিয়েশন ছড়াতে পারে। এটি আমেরিকা – ইসরাইল’এর তৃতীয় মোনাফেকি।
আমেরিকার ইরানী পারমাণবিক স্থাপনা আক্রমণের পর প্রতিক্রিয়ায় ইরান কাতারস্থ আমেরিকান বিমান ঘাঁটি লক্ষ্য করে মিসাইল আক্রমণ পরিচারনা করে। এ পরিচালনার পূর্বে ইরান আক্রমণের বিষয়টি আমেরিকানদের অবহিত করে। এ বিষয়টি ইরানকে নৈতিকতার দিক থেকে অনেক উচ্চে তুলে ধরে এবং ইরানের জন্য এটি নৈতিক বিজয়ও বটে। ইরানের এ নৈতিকতার বিষয়টি ডোনাল্ট ট্রাম্প প্রশংসা করতে বাধ্য হন। এ যুদ্ধের মাধ্যমে ইরানের অনেক সবল এবং দুর্বল দিক বেরিয়ে আসে।
ইরানের দুর্বল দিক : ‘যুদ্ধের প্রথম মুহূর্তে অনেক সেনা কমান্ডার হারানো। নিজেদের অভ্যন্তরে প্রবল গোয়েন্দাবৃত্তির উপস্থিতি। দুর্বল আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। সময়ে প্রক্সিদের নির্লিপ্ততা। বন্ধু দেশগুলির যথেষ্ট সর্মথনের অনুপস্থিতি।’
ইরানের সবল দিক : ‘অভাবনীয় দ্রুততার সাথে হারানো কমান্ডারদের স্থলাভিষিক্তকরণ। শত প্রতিকূলতায়ও মিসাইল আক্রমণ পরিচালনা করা। ইসরাইল আমেরিকার, আইরন ডোম, ডেভিড স্লিং, এ্যারো ১ বা এ্যারো ২ যে দুর্ভেদ্য সে ভুল ভেঙ্গে দিয়ে ইসরাইলের উপর ক্রমাগত মিসাইল আক্রমণ। সর্ব্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনির অবিচল এবং দৃঢ় নেতৃত্ব। তার অনুপস্থিতে পূর্বসূরির মনোন্নয়ন। যুদ্ধ বিরতির শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নিজেদের আক্রমণ সক্ষমতা বজায় রাখতে পারা। সাধারণ জনগণের সমর্থন এবং আস্থা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অনুকূলে রাখতে পারা।’
সর্বশেষ দি হেগে ন্যাটো সম্মেলনের ফাঁকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে সাংবাদিকদের মুখামুখি হতে দেখা যায় সেখানে সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে ন্যাটোর সেক্রেটারী জেনারেল ট্রাম্পকে “অপারেশন মিডনাইট হ্যামার” নাম দিয়ে ইরান আক্রমণ শুরু করার জন্য এক অনন্য সাহসী সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী প্রেসিডেন্ট হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন, তিনি এও বলেন অন্য প্রেসিডেন্ট হলে এটা সম্ভব হত না। অবশ্য ইতিপূর্বে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী, জার্মান চ্যান্সেলর আমেরিকান প্রসিডেন্টের ইরান আক্রমণকে সর্মথন দিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন। অন্যদিকে খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সিনেটে সিনেটর বার্নি স্যার্ন্ডাসের মত বিবেকবান অনেকেই কংগ্রেসের অনুমোদন ছাড়া ইরান আক্রমণকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প’ এর সংবিধান লংঘন বলে অভিহিত করেছেন। তবে বিশ্বব্যাপী আমেরিকার বিরুদ্ধে সাধারণ লক্ষ মানুষের যে প্রতিবাদ তা অবিস্মরণীয়। লন্ডন, প্যারিস, করাচি, সিডনী, নিউইর্য়ক, কলকাতা, জার্কাতা ইত্যাদি শহরে শহরে অকুন্ঠ কন্ঠে মানুষের যে প্রতিবাদ তা থেকে অবচেতনে কোন এক অজানা গুণির যুদ্ধ কি তা সংজ্ঞায়িত করতে যা উল্লেখ করেছেন তার পুনরাবৃত্তি করার ইচ্ছে সংবরণ করতে না পারার মাঝে এ লেখা শেষ করছি।
War is a place where young
People who don’t know each
Other and don’t hate each other
Kill each other, by the decision of
Old people who know each other
And hate each other but don’t kill
Each other
এর অর্থ দাড়ায় :
যুদ্ধ এমন এক ব্যাপার যেখান যুদ্ধমান তরুণ প্রাণ
একজন আরেক জনকে চিনে না।
তারা একে অপরকে ঘৃণাও করে না।
অথচ কিছু জীবন সায়হ্নের মানুষের
সিদ্ধান্তে তারা একে অপরকে হত্যা করে,
যুদ্ধের সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী মানুষগুলি
একে অপরকে জানে, একে অপরকে ঘৃণা করে,
তবে তারা একে অপরকে হত্যা করে না।
এ দৃশ্য আমি আমেরিকার ওয়াশিংটন ডিসিতে– ভিয়েৎনাম, কোরিয়ান, ইরাক ওয়ার মেমোরিয়ালগুলিতে দেখেছি, এখানে ঝরে পড়া আমেরিকান তরুণের নাম অংকিত রয়েছে যারা স্বদেশ ছেড়ে বিদেশ বিভূঁইয়ে জীবন বিলিয়ে দিয়েছে অন্যের জীবন নিতে গিয়ে যাদের সাথে এদের কোনো ঘৃণার সম্পর্ক ছিল না।
(চলবে)
লেখক : প্রাবন্ধিক, কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট; সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক