এই লেখাটি শুরু করতে গিয়ে আমেরিকান সাহিত্যিক কল্পকাহিনি লেখার পুরোধা পুরুষ Robert Anson Heinlein (রবার্ট এ্যানসন হেইনলেইন) এর একটি কথা এখানে উল্লেখ করতে চাই, তার প্রবাদতুল্য সেই বাক্যটি হল A generation which ignores history has no past—and no future. অর্থাৎ যে জাতি তার ইতিহাসের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করে সে জাতির যেমন কোন অতীত থাকে না তেমনি ভবিষ্যৎও। হেইনলেইনের কথাটি আমার কাছে গুরুত্ব পাবার কারণ হল সাম্প্রতিক সময়ে আমরা আমাদের জাতির গৌরবোজ্জ্বল অতীত ইতিহাস নিয়ে যে ভাবে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য হেলা ফেলা করেছি তা যেমন বেদনাদায়ক তেমনি ঔদ্ধত্যপূর্ণও বটে। আমাদের একথা মনে রাখতে হবে কঠিন বন্ধুর এক পথ পাড়ি দিয়ে আমরা ১৯৭১ সালে ত্রিশ লক্ষ শহীদ আর দুই লক্ষ মা বোনের ইজ্জত আব্রুর এক অকল্পনীয় আত্মত্যাগের মহিমায় সমুজ্জ্বল হয়ে স্বাধীনতার সোনালি সোপানে পৌঁছেছি।
অন্তর্বর্তী সরকারের শপথ গ্রহণের খুব সম্ভবত একদিন পর বিবিসি বাংলা আমার একটি সুদীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছিল। ঐ সাক্ষাৎকারের মূল প্রতিপাদ্য ছিল ‘বাংলাদেশের গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে চ্যালেঞ্জ সমূহ’। সেই সাক্ষাৎকারে যে বিষয়টি প্রধান চ্যালেঞ্জ হতে যাচ্ছে বলে আমি উল্লেখ করেছিলাম, তা হল অন্তর্বর্তী সরকারের সাপোর্ট বেইস। এর ব্যাখ্যায় আমি যা তুলে ধরেছিলাম তা হল, রাজনৈতিক দল যারা অন্তর্বর্তী সরকারকে শুরুতে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে দিন যেতে তারা অন্তর্বর্তী সরকারের কাঁধে বন্দুক রেখে নিজেদের শিকারে ব্রতী হওয়ার চেষ্টা চালাবে, সফল না হলে তারা সমর্থন প্রত্যাহার করে সরে পড়বে। এমতাবস্থায় অন্তর্বর্তী সরকারকে সমর্থন পাওয়ার জন্য সামরিক বাহিনীর দিকে হাত বাড়াতে হবে এবং সেটি হবে অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আমাদের অপেক্ষা করতে হবে তেমন পরিস্থিতি অন্তর্বর্তী সরকার কীভাবে সামাল দেয় তা দেখার জন্য।
সে অপেক্ষার পালা ২১ মে ২০২৫ ধরে নেওয়া যায় শেষ হয়েছে। এবং অন্তর্বর্তী সরকার এ সমর্থন আদায়ে সফল হয়েছে এখন সেকথা আর বলা যাবে না। কেন সে আলোচনায় যাওয়ার আগে নিচের ছোট্ট এই ভূমিকাটি মনে হয় অত্যাবশ্যকীয়।
সাধারণ কৃষক শ্রমিক, ছাত্র জনতার পাশাপাশি ১৯৭১ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর সদস্যরা মাতৃভূমির মমত্ববোধে উজ্জীবিত হয়ে বাঙালি জাতির মুক্তি অর্জনে জীবন বাজি রেখে রণাঙ্গনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। চট্টগ্রামে ৮ম ইস্ট বেঙ্গল, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল, জয়দেবপুরে ২ ইস্ট বেঙ্গল এবং যশোহর’এ ১ম ইস্ট বেঙ্গল বিদ্রোহ ঘোষণা করে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। এর পাশাপাশি নৌ এবং বিমান বাহিনীর সদস্যরাও অসংকোচে মাতৃভূমির মুক্তির লক্ষ্যে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
অকুতোভয় সামরিক বাহিনীর অনেক সদস্য সদূর পাকিস্তানের বন্দী শিবির থেকেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পালিয়ে এসে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। সুতরাং সংশ্লিষ্ট সবাইকে মনে রাখতে হবে বাংলাদেশ সামরিক বাহিনী ‘ফ্রিডম এট মিডনাইট’ এ পাওয়া স্বাধীনতার কোনো উত্তরাধিকার নয় যে সকাল বেলা পতাকা পরিবর্তন হল আর সেনাবাহিনীর ইউনিফর্মও। আমাদের সামরিক বাহিনী রক্তের উত্তরাধিকার। শত শহীদের রক্তে রঞ্জিত আমাদের সামরিক বাহিনীর গায়ে চড়ানো প্রতিটি কম্ব্যাট ড্রেস। একথা হয়ত অনেকেই জেনে শুনে অথবা আমাদের গৌরবের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বুকে ধারণ না করে, দুঃসাহস দেখিয়ে এসেছেন সেনানিবাস গুঁড়িয়ে দেয়ার, দুঃসাহস দেখিয়েছেন রাস্তায় শ্লোগান দিতে হাসনাত না ওয়াকার!
একজন তরুণ উপদেষ্টার উদ্দেশ্যশমূলকভাবে হঠাৎ প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনকালীন সময়ে সেনাপ্রধানের কথিত অভিমতকে জনসমক্ষে তুলে ধরা।
সামরিক বাহিনী মাঠে আছে ম্যাজিস্টেরিয়াল ক্ষমতা নিয়ে এমন প্রেক্ষাপটে কিছু অর্বাচীন দুঃসাহস দেখিয়েছে ‘মবোক্রেসির’ বা জননৈরাজ্য সৃষ্টির যা সামরিক বাহিনীর উপস্থিতিকে সাধারণ মানুষের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
এরই মাঝে নতুন আরো একটি ঘটনার উদ্ভব হয়, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার নিয়োগ দান। সেনা প্রধানের রাশিয়া সফরকালীন এ কাজটি সম্পন্ন হয়। তিনি এ যাবৎ প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা বিষয়ক হাই ভেল্যু সহকারী ছিলেন। বিষয়টি নিশ্চিতভাবে নানা প্রশ্নের জন্ম দেয় বলাবাহুল্য এটি সেনানিবাসেও। এরই মধ্যে নিয়োগ পাওয়া উপদেষ্টাকে ঘিরে রাখাইনে মানবিক করিডোর বিষয়টি প্রবলভাবে সামনে আসে। এ বিষয়টি আরো সংশয় এবং সন্দেহের উদ্রেক করে যখন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এবং মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব পরস্পর বিপরীত মুখী বক্তব্য সংবাদ মাধ্যমে উপস্থাপন করতে থাকেন। আমার অভিমত জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মহোদয় করিডোরকে যদিও তিনি এখন মানবিক প্যাসেজ বলছেন এসব যাই বলুন না কেন তিনি যদি এসব বাদ দিয়ে প্রস্তাব করতেন, আমাদের সামরিক বাহিনীর বিশ্বব্যাপী শান্তি স্থাপনের বিপুল অভিজ্ঞতা আর সুনাম রয়েছে, আমরা এ প্রেক্ষাপটে আমাদের সামরিক বাহিনীর সহায়তায় রাখাইনে শান্তি স্থাপনে কাজ করতে চাই, শান্তি স্থাপনের পর আমরা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সে শান্তির বাতাবরণকে কাজে লাগাতে চাই। তেমন কিছু না করে তিনি দেশের সার্বভৌমত্বের মত স্পর্শ কাতর বিষয়ে ঝুঁকি নিতে তৎপর হয়ে ওঠেন। তিনি আরাকান আর্মি’র মত ‘নন স্টেট এ্যাক্টর’দের সাথে কাজ করার আগ্রহ দেখাতে থাকেন। আমি জানি না একজন নিরাপত্তা উপদেষ্টা রাখাইনে এখনও যেখানে মায়ানমারের সার্বভৌমত্ব স্বীকৃত সেখানে প্রচণ্ড এক ঝুঁকির কথা তার বিবেচনায় এনেছেন কিনা। বিষয়টি সামরিক বাহিনী মোটেও পছন্দ করেনি, যার প্রতিফলন সেনা প্রধানের ২১ মে অফিসারদের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণে স্পষ্ট। তারা এটাকে একটি প্রক্সি ওয়ার এর মত ঝুঁকিপূর্ণ বিষয় হিসাবে বিবেচনায় নিয়ে এটা থেকে নিবৃত্ত থাকার সুস্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন।
চট্টগ্রাম বন্দর। বন্দর ও নৌ পরিবহন উপদেষ্টা বর্তমান থাকা অবস্থায় বন্দর নিয়ে প্রেস সচিব, বোর্ড অব ইনভেস্টের র্ন্বিাহী প্রধানের অতি উৎসাহ সচেতন মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এন সি টি (নিউ মুরিং কনটেইনার টার্মিনাল) সরকারি বিনিয়োগে লাভজনকভাবে সচল। এখানে বিদেশী অপারেটর আনার পরিবর্তে আমাদের দেশের যারা কর্মরত তাদের সক্ষমতার ঘাটতি থাকলে তা পূরণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা যেতে পারে, তা না করে গাছে পাকা আম পারার মত, আমার গাছে আম পেকেছে আমগুলি পেরে দেন, পেরে দিলে এর অর্ধেক আপনার আর অর্ধেক আমার মত হিসাব করলে চলবে না। চীনা একটি প্রবাদ এখানে প্রণিধানযোগ্য ‘কাউকে দাওয়াত করে মাছ খাওয়ানোর চেয়ে মাছ কীভাবে ধরতে হয় তা শিখিয়ে দেওয়া তার জন্য অনেক মঙ্গলজনক’। আমাদেরও কোন বিদেশী অপারেটর না ডেকে বরং আমাদের কর্মরত মানুষগুলিকে আরো দক্ষ এবং কর্মশীল করে তোলার মাধ্যমে নিজের দেশের অর্জিত অর্থ নিজের দেশে ধারণ করে অর্থনীতিকে বেগবান করার কথাও ভাবতে হবে। সেনা প্রধান একথাও স্পষ্ট করেছেন।
সংস্কার নিয়ে ইতিমধ্যে অসংখ্য সংস্কার কমিশন গঠিত হয়েছে। দশমাস যাওয়ার পরেও এসব কমিশনের অর্জন ভূমিষ্ট হয়নি। সংস্কার নিয়ে সেনাবাহিনীর পরামর্শ সরকার আমলে নেয়নি বলেও সেনা প্রধান উল্লেখ করেন। এখানে মনে রাখতে হবে ৫ আগস্ট জাতির এক মহা ক্রান্তিকালে জেনারেল ওয়াকার জাতির কাছে ওয়াদা করেছিলেন ‘আপনাদের জানমাল সবকিছুর নিরাপত্তার দায়িত্ব আমি নিচ্ছি’। সেই বিবেচনায় জেনারেল ওয়াকারের দিক থেকেও সংস্কারের বিষয়ে বিবেচ্য বিষয় থাকতে পারে।
রাজনৈতিক সমস্যা রাজনীতিবিদদেরই সমাধান করা যুক্তিসঙ্গত। এটা অন্তর্বর্তী সরকারের বাইরের কিছু পণ্ডিতজন এসে সমাধানের প্রচেষ্টা গ্রহণ অনাকাঙ্ক্ষিত। মনে রাখতে হবে আমাদের এ যাবৎ যা অর্জন তা রাজনৈতিক সরকারগুলির মাধ্যমে সেটা সামরিক হোক বা স্বৈরাচার হোক তাদের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে। ১৮ কোটি মানুষের ভাত কাপড়, শিক্ষাদীক্ষা, কৃষি, শিল্প, যোগাযোগ তথা সামগ্রিক অর্থনৈতিক অর্জন এসব রাজনৈতিক সরকারগুলিরই সম্মিলিত সাফল্য। ব্যতিক্রম ছাড়া একথা অনস্বীকার্য রাজনীতিবিদরাই দেশের প্রতি দেশের মানুষের প্রতি অনেক বেশি নিষ্ঠাবান–দায়বদ্ধ।
এই দায়বদ্ধতার প্রেক্ষাপটে একটি অনির্বাচিত সরকার যত প্রলম্বিত হবে, দেশের সামগ্রিক বিনিয়োগে, অগ্রগতিতে তত বেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে যা প্রকারান্তরে সমগ্র অর্থনীতিকে একটি প্রতিকূল স্রোতের মুখোমুখি করবে। বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তববতা তেমনই ইঙ্গিতবহ। এ থেকে পরিত্রাণে সেনাপ্রধান তার বক্তব্যে দ্রুত অর্থাৎ ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দিয়ে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা অর্পণের কথা বলে তার একটি ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছেন নিঃসন্দেহে। একই সাথে ওয়ান ইলেভেনের অভিজ্ঞতা করো জন্য সুখকর নয় সে কথাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন তিনি।
রবার্ট এ্যানসন হেইনলেইন (Robert Anson Heinlein)-এর কথা দিয়ে আমার লেখাটি শুরু করেছি, কথাটি আবারো পুনরুল্লেখ করছি ‘যে জাতি তার ইতিহাসের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করে সে জাতির যেমন কোন অতীত থাকে না তেমনি ভবিষ্যৎও’। গভীর বেদনা, উদ্বেগ এবং উৎকণ্ঠায় আমরা লক্ষ্য করেছি আমাদের অতীত সব অর্জনের প্রতি কী নির্মম এক অবজ্ঞা, অবহেলা! আমাদের মুক্তিযুদ্ধ আমাদের সংবিধান সবকিছু এক তাচ্ছিল্যের আবর্তে। রিসেট বাটন টিপে সব কিছু মুছে ফেলা! এটি কি এতই সহজ? রবীন্দ্রনাথের কবিতার সেই চিরন্তন প্রশ্ন :
‘বীরের এই রক্ত স্রোত মাতার এই অশ্রুধারা
সেকি ধূলায় হবে হারা?’
এ প্রশ্নের উত্তরও আমরা সেনাপ্রধানের বক্তব্যে পেয়েছি, মুক্তিযুদ্ধ, সার্বভৌমত্ব, সংবিধান এসব নিয়ে কোনো ছেলেখেলা নয়। পরিশেষে তাঁর বক্তব্যে তিনি সবাইকে স্মরণ করিয়েছেন, ‘আমাদের দেশের গরিব দুঃখী মানুষের রক্ত ঘামে আমাদের জীবিকা নির্বাহ হয়। এই দুঃখী মানুষের যেন কোনো দুঃখ না বাড়ে সে লক্ষ্যে আমাদের দৃঢ় অবস্থান বজায় রাখতে হবে’।
লেখক: কথা সাহিত্যিক, সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক।