সমকালের দর্পণ

মেজর মোহাম্মদ এমদাদুল ইসলাম (অব.) | রবিবার , ১৮ মে, ২০২৫ at ৪:৫৮ পূর্বাহ্ণ

পাকিস্তানভারত যুদ্ধবিরতি, কিছু অজানা তথ্য এবং এর থেকে কিছু শিক্ষণীয় দিক

এ প্রসঙ্গে আগের লেখায় প্রশ্নবোধক ছিল যুদ্ধ আসন্ন কিনা! প্রশ্নের উত্তর পাঠকরা ইতিমধ্যে পেয়ে গেছেন। ৭ মে ২০২৫ রাতের দ্বিতীয়ার্ধে ভারত পাকিস্তানের ৯ টি লক্ষ্যবস্ত্তুতে আক্রমণ পরিচালনা করে। এইসব লক্ষ্যবস্ত্তুর ৫টি পাকিস্তান শাসিত কাশ্মীরে বাকি ৪টি পাকিস্তানের অভ্যন্তরে। ভারত লক্ষ্যবস্ত্তু সমূহ মিলিট্যান্টদের প্রশিক্ষণ/আশ্রয়স্থল হিসাবে বর্ণনা করে হামলার যথার্থতা প্রমাণ করার প্রয়াস পায়। প্রকারান্তরে ভারতীয় প্রখ্যাত প্রতিরক্ষা বিষয়ক সাংবাদিক এবং ‘ফোর্স’এর সম্পাদক প্রবীণ সোনী, ‘দি ডন’ পত্রিকার বিখ্যাত কলামিস্ট জাহিদ হোসেনসহ অনেকেই এই লক্ষ্যবস্তু সম্বন্ধে প্রশ্ন তুলেছেন। তাদের প্রশ্ন মিলিট্যান্টরা কোন নির্দিষ্ট স্থানের স্থায়ী বাসিন্দা নয় বা নির্দিষ্ট স্থানে তারা প্রশিক্ষণ গ্রহণও করে না, তারা দ্রুত স্থান বদলায় ইংরেজীতে একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে ‘দি মিলিট্যান্ট হ্যাভ নো ফেইস’ মোদ্দা কথায় এটির সরল বাংলা হল মিলিট্যান্টদের কোন অবয়ব নাই। এর পরও এটা কারো অজানা নয় ২২ এপ্রিল ২৫ পহেলগামের বিয়োগান্তক ঘটনার পর ভারত মিলিট্যান্টদের উপর প্রতিশোধ গ্রহণের যে তোড়জোড় শুরু করে তাতে মিলিট্যান্টরা ভারতীয় আক্রমণের শিকার হওয়ার জন্য একটি নির্দিষ্ট স্থানে অপেক্ষা করে বসে থাকার কথা নয়। পরিচালিত আক্রমণ শেষে ফলাফল সেরকমই প্রমাণ করে, আক্রান্ত স্থানগুলি বেশিরভাগই মসজিদ, মাদ্রাসা এবং নিহতরা প্রায় সবাই সাধারণ নারীপুরুষ, শিশু।

প্রবাদ আছে ‘যারা যুদ্ধ চায় তারা যুদ্ধে যায় না / যারা যুদ্ধ চায় না তারা যুদ্ধে গিয়ে মরে /তারা জানে যুদ্ধ কী ভয়াবহ কত নির্মম! দুর্ভাগ্য যারা যুদ্ধে যাবে না তারাই যুদ্ধের আদেশ দেয় আর যারা যুদ্ধ চায় না তাদের যুদ্ধে যেতে হল। ভারতপাকিস্তানের যুদ্ধ এমন এক প্রেক্ষাপটে শুরু হয়।

৭ মে লক্ষ্যবস্ত্তুতে আঘাত হানতে ভারত তার বিমান বাহিনীর র্স্বাধুনিক যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে। প্রবীণ সোনী’র বিশ্লেষণ অনুযায়ী পাকিস্তানে লক্ষ্যবস্ত্তুতে আঘাত হানতে গিয়ে পাকিস্তানের দিক থেকে প্রত্যাঘাতের কিছু বিষয় বিবেচনায় নিতে ভারতীয় বিমান বাহিনীর কৌশল প্রণেতারা চরমভাবে ব্যর্থ হয়। যেমন ১৯৯৯ সালের কার্গিল সংঘর্ষের পর পাকিস্তান চীনের সাথে যৌথভাবে ‘আর্টিফিসিয়াল ইন্টিলিজেন্ট কম্পিউটিং সিস্টেম’ গড়ে তুলে, এই সিস্টেমের মাধ্যমে পাকিস্তান শক্রর গতিবিধি মুহূর্তে জেনে যেতে পারে। এটা ভারতীয়দের বিবেচনায় ছিল না, ফলশ্রুতি আগ্রাসী ভারতীয় বিমান বহর আকাশে উড়াল দিতেই পাকিস্তানী বিমান বাহিনী তা জেনে প্রত্যুত্তর দিতে উড়াল দেয়।

ভারতীয়দের আস্থার এবং অহংকারের যুদ্ধ বিমান রাফায়েল। ৯ বিলিয়ন ডলারের ৩৬ টি রাফায়েল ভারতকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দারুণ আস্থাশীল করে রেখেছিল। লাফায়েল ফ্রান্সের ডেসল্ট কোম্পানী কর্তৃক তৈরী। এ যুদ্ধ বিমান ফরাসীদের গৌরবের ধন। রাফায়েল তৈরীর সক্ষমতা ফ্রান্সকে আমেরিকার সাথে এফ ৩৫ যুদ্ধ বিমান তৈরীর যৌথ প্রকল্প থেকে বেরিয়ে আসতে উদ্বুদ্ধ করে। যুদ্ধ বিমান বিশেষজ্ঞ এবং ফরাসী কর্তৃপক্ষের এ পর্যন্ত ধারনা ছিল রাফায়েল এ্যারিয়েল ওয়ার ফেয়ার তথা আকাশ যুদ্ধে তথা ‘ডগ ফাইটে’ অজেয়। ৭ মে রাফায়েল’এর এ দর্প চুর্ণ হয়।

বিভিন্ন সূত্রের তথ্য অনুযায়ী ৭ মে রাতের মধ্যভাগে পাকিস্তানী লক্ষ্যবস্ত্তুতে হানা দেওয়ার জন্য ভারতীয় বিমান বাহিনীর রাফায়েল, মিগ এবং এস ইউ যুদ্ধবিমানগুলি আকাশে উড়াল দেওয়ার মুহূর্তে পাকিস্তান এয়ার ডিফেন্স তা জেনে যায়, সে অনুযায়ী পাকিস্তান বিমান বাহিনীর যুদ্ধ বিমান গুলি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণার্থে তড়িৎ ব্যবস্থা গ্রহণ করে। পারমানবিক শক্তিধর দুটি দেশ আকাশযুদ্ধে পৃথিবীর আধুনিকতম বিমানবহর নিয়ে পরস্পর মুখামুখি হয়।

ভারতীয় বিমান বাহিনীর কৌশল প্রণেতারা দুটি বিষয় অনুধাবনে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দেন। বিষয়গুলির প্রথমটি হল পাকিস্তানের ‘এ আই স্ট্রাটেজিক কম্পিউটিং সেন্টার’ এবং দ্বিতীয়টি হল চীনের তৈরী যুদ্ধ বিমান ‘জে এফ ১০ সি’ এর সক্ষমতা। ফলে ভারতকে অপ্রত্যাশিতভাবে আকাশ যুদ্ধে প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়। এর প্রথম কারণ অতি দ্রুততম সময়ে পাকিস্তানের পাল্টা অবস্থান যা ‘এ আই স্ট্রাটেজিক কম্পিউটিং সেন্টার’ এর কারণে। দ্বিতীয়টি ‘জে এফ ১০ সি’ এর রাডার এর পরিধি। ভারতীয়দের ধারণা ছিল পাকিস্তানী যুদ্ধ বিমানগুলির রাডার ১৫০ থেকে ২০০ কিঃ মিঃ, কার্যত ‘জে এফ ১০ সি’ এর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা যে ৩০০ কিঃ মিঃ এটি ভারতীয়দের আন্দাজেরও বাইরে ছিল। ফলে রাফায়েলের পাইলটদের ধারণা ছিল ১৫০ থেকে ২০০ কিঃ মিঃ হবে তাদের ‘কনটেস্টেট জোন’ অর্থাৎ যেখানে তারা শক্রপক্ষকে ঘায়েল করতে উদ্যোগী হবে। এটি ছিল রাফায়েলের পাইলটদের জন্য অজ্ঞানতা প্রসূত এক চরম ভুল। তারা তাদের অনুমিত কনটেস্টেট জোনে আসার আগেই ‘জে এফ ১০ সি’ এর মিসাইল ‘পি এল ১৫ই’ এর শিকারে পরিণত হয়।

ভারত রাফায়েল বা তার বিমান খোয়ানোর বিষয়টি স্বীকার বা অস্বীকার কোনটিই না করে নিরুত্তর থাকে, তবে রাতারাতি রাফায়েলের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ‘ডেসল্ট’ এর শেয়ারের দাম পড়ে যাওয়া এবং ‘জে এফ ১০ সি’ এর নির্মাতা প্রতিষ্ঠান কোম্পানী ‘চেংদু’র শেয়ার দরে উল্ফন প্রমাণ করে ‘রাফায়েল’ ‘জে এফ সি১০’ এর হাতে মার খেয়েছে।

এখন পুরা পশ্চিমা বিশ্বের অস্ত্র এবং সমর বিশেষজ্ঞরা রাফায়েল কীভাবে ভূপাতিত হল এবং জে এফ সি ১০ তথা চাইনীজদের সমরাস্ত্র উৎপাদনে অত্যাধুনিক কলাকৌশল প্রয়োগের বিষয়টি নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণে মগ্ন।

ভারতপাকিস্তানের যুদ্ধ বিরতি নিয়ে হঠাৎ আমেরিকার তোড়জোড় এবং তা নিশ্চিত করণে আমেরিকার ভূমিকা নিয়েও এখন সচেতন বোদ্ধা থেকে সাধারণ মানুষ সবার মধ্যেই প্রবল আলোচনা চলছে। আমেরিকান সংবাদ মাধ্যম সি এন এন সূত্রে জানা যায় আমেরিকানরা অত্যন্ত সংবেদনশীল কিছু তথ্য পাওয়ার পর যুদ্ধ বিরতি নিয়ে তড়িঘড়ি মাঠে নামে। তবে সেই সংবেদনশীল তথ্যের বিষয়ে আমেরিকানরা মুখ খোলেননি। আমেরিকান ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভ্যান্স যুদ্ধ বিরতি নিয়ে প্রথম কথা বলেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদির সাথে। এটি বিবেচনায় নিলে অনেকটা নিশ্চিত হওয়া যায় সংবেদনশীল তথ্য পাকিস্তানের দিক থেকে পাওয়া। তা হলে সেটি কি কোন পারমানবিক যুদ্ধের? এটি ভবিষ্যৎ এ হয়ত কোন একদিন জানা যাবে।

ভারতপাকিস্তানের এ কয়দিনের যুদ্ধে সত্যিকারের যুদ্ধের পাশাপাশি দুটি দেশ ব্যাপক প্রচার যুদ্ধেও লিপ্ত ছিল। ইংরেজীতে একটি প্রবাদ চালু আছে ‘দি ফাস্ট কেজোয়ালিটি অব ওয়ার ইজ দি ট্রুথ’ এর সহজ অর্থ হল যুদ্ধে প্রথম বলি সত্য। তবে জনগণের মনোবল এবং সমর্থনের জন্য এ বলির প্রয়োজন হয় ক্ষেত্র বিশেষে। সানজু প্রখ্যাত চাইনীজ সমর বিশারদ যুদ্ধ যাত্রার পূর্বে এমন প্রচার প্রচারণা চালানোর জন্য বলেছেন, যাতে শক্র যুদ্ধ যাত্রার পূর্বেই যুদ্ধ করার মনোবল হারিয়ে বসে। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে জার্মান জেনারেল গোয়েবলস প্রচার প্রপাগান্ডায় এতই খ্যাতি অর্জন করেন যা তাকে রীতিমত ‘লিজেন্ডে’ পরিনত করে। ভারত পাকিস্তানও এবার এ প্রচার কৌশলে তাদের ব্যাপক মনোনিবেশ করেন।

এ কৌশলের পিছনে নিশ্চিতভাবে কাজ করেছে স্ব স্ব সৈনিকদের মনোবল বৃদ্ধি, জনগণের সমর্থন আদায় একই সাথে শক্রুর উপর প্রভাব বিস্তার। এ প্রসংঙ্গে ভারতপাকিস্তানের যুদ্ধ থেকে আমাদের যা শিক্ষণীয় বা বিবেচ্য তার একটি সংক্ষিপ্তসার তুলে ধরছি

সময়ে এগিয়ে আসার মত কৌশলগত দিক থেকে নির্ভরযোগ্য সক্ষম আন্তঃরাষ্ট্রীয় সমঝোতা গড়ে তোলা।

সৈন্য সংখ্যার চেয়েও সৈন্যদের কঠোর অনুশীলন, আধুনিক সমরাস্ত্র বিজ্ঞানে প্রশিক্ষিত করা।

বিপুল অস্ত্র ভাণ্ডারের চেয়েও আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগে নির্মিত সমরাস্ত্রের মওজুদ গড়ে তোলা।

এ আই সহ স্ট্র্যাটেজিক কম্পিউটিং সেন্টার সহ আধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা।

একটি সুদক্ষ এবং সমন্বিত আন্তঃবাহিনী প্রচার কাঠামো প্রস্ত্তুত রাখা। ভারত পাকিস্তানের এ কয়দিনের যুদ্ধকালীন প্রচারসম্প্রচারে এ বিষয়টির গুরুত্ব আরো বেশি করে সামনে এসেছে। উদাহরণ হিসাবে যুদ্ধ চিত্র পাকিস্তানী আন্তঃবাহিনী যে ভাবে মানচিত্রের উপর অংকন করে, রাফায়েলের পাইলটের ভয়েস রেকর্ড সহ আন্তঃজার্তিক সংবাদ মাধ্যমের প্রতিনিধিদের সামনে তুলে ধরেছে এবং বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে তার পাশাপাশি ভারতীয়রা তাদের পররাষ্ট্র সচীবকে মাঝে রেখে তাদের দিকের বক্তব্য তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছেন তা ছিল অনেকটা অনুজ্জল। ফলশ্রুতিতে পাকিস্তানী বক্তব্যই বিশ্ব প্রচার মাধ্যমে অনেকটা প্রাধান্য পেয়েছে।

তবে স্বস্তির বিষয় হল পারমানবিক শক্তিধর দুটি দেশ শেষ পর্যন্ত যুদ্ধের সর্বনাশা খেলা থেকে আপাত বিরত হয়েছে।

লেখক: কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট; সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধবিশ্ব জাদুঘর দিবস ২০২৫ : চট্টগ্রামে নগর জাদুঘরের প্রয়োজনীয়তা