চিকেন নেক বা শিলুগুড়ি কড়িডোর। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তোড়ে ৫ আগস্ট ২৪ বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তন হয়। এ নিয়ে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার এবং ভারতীয় সরকারের মাঝে সম্পর্কের কিছুটা শীতলভাব পরিলক্ষিত হয়। ৭ আগস্ট ২০২৪ ভারতীয় এনডিটিভি’র সাথে এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অনেকটা সতর্কবাণী উচ্চারণের মত করে বলেন “India’s north-east, West Bengal and Myanmar will be affected if Bangladesh becomes unstable” অর্থাৎ বাংলাদেশ অস্থিতিশীল হলে তা ভারতীয় পর্ূ্বাঞ্চল, পশ্চিমবঙ্গ এবং মায়ানমারকেও অস্থিতিশীল করে তুলবে। এই প্রেক্ষাপটে আমার শিরোনামের লেখাটি শুরু করেছিলাম।
২৬ মার্চ ২০২৫ বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা চীন সফরে যান। এই সফরের এক পর্যায়ে ২৮ মার্চ এক অনুষ্ঠানে তিনি উল্লেখ করেন “The Seven State of India, the eastern part of India are called the Seven Sisters. They are land locked region of India. They have no way to reach out to the ocean. Bangladesh is the guardian of the ocean for the region”. অর্থাৎ ভারতীয় র্পূ্বাঞ্চলের সাতটি প্রদেশকে সেভেন সিস্টার্স হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়। এই রাজ্যগুলি ভূমি বেষ্টিত, এদের সরাসরি সাগরে প্রবেশের সুযোগ নাই। এই অঞ্চলে বাংলাদেশই সাগর পথের নিয়ন্ত্রক। এটি অপার একটি সম্ভাবনার আধার। এ অঞ্চলে বিনিয়োগ চাইনীজ অর্থনীতির জন্য অবারিত একটি সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে।
প্রফেসর ইউনুসের এ বক্তব্যের পরপর ভারত জুড়ে তাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সুশীল সমাজ, থিং ট্যাংক তথা চিন্তাবিদরা রাজনৈতিক, কূটনৈতিক, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের সমস্ত রীতিনীতি ছাড়িয়ে যে সব মন্তব্য বিবৃতি প্রদান করেছেন তা দুদেশের ভবিষ্যৎ পথ চলাকে কখনো মসৃণ করবে বলে প্রতীয়মান হয় না। এ বিষয়গুলি আলোচনা করার আগে যে প্রেক্ষাপটটিকে প্রফেসর ইউনুস হয়ত তার বিবেচনায় নিয়েছিলেন সে বিষয়গুলি আলোচনা করতে চাই।
ভারতীয় উত্তর পূর্বাঞ্চলের অর্থনীতি ভারত বিভক্তি এবং ভারতীয় উত্তর পূর্বাঞ্চলে ভারতে অন্তর্ভুক্তি এ অঞ্চলকে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বেশ বেকায়দায় ফেলে দেয়। এই পুরা অঞ্চলটি ভূমি বেষ্ঠিত হয়ে পড়ে। এতে করে কলকাতা চট্টগ্রাম হয়ে এ অঞ্চলের বহুদিনের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করে। ভারত বিভক্তির পূর্বে ডিব্রুগড় কলকাতা হয়ে জাহাজ চলাচলে যেখানে সময় লাগত ৮ দিন, ভারত বিভক্তির পর সেখানে গৌহাটি কলকাতা জাহাজ চলাচলে সময় লাগে ২৫ দিন। ভারত বিভক্তির পূর্বে কলকাতা আগরতলার দূরত্ব ছিল বর্তমান বাংলাদেশের ভিতর দিয়ে ৩৭৫ কিঃমিঃ সেখানে এখন ঘুরপথে সে দূরত্ব হয়েছে ১৭০০ কিঃ মিঃ, এতে অর্থ এবং সময় দু দিক থেকে ভারত তার পূর্বাঞ্চলকে নিয়ে রয়েছে দারুণ বিপাকে। পথের বন্ধুরতাও এক্ষেত্রে পরিস্থিতিকে আরো কঠিন এবং আর্থিক ক্ষতির মুখে ঠেলে দিয়েছে। গৌহাটি থেকে কলকাতায় আসতে ৯ টনের একটি ট্রাক ১১০০ কিঃ মিঃ পাড়ি দিতে ভাড়া নেয় ২০,০০০(বিশ হাজার) রুপি। আর চেন্নাই থেকে কলকাতা আসতে পাড়ি দিতে হয় ১৬০০ কিঃমিঃ ভাড়া দিতে হয় ১৬,০০০ রুপি।
১৯৪৭ এর ভারত বিভক্তি ভারতীয় পূর্বাঞ্চলকে ভারত থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন করার এই বিষয়টি আঁচ করেই হয়ত সে সময় ভারতীয় উপমহাদেশকে ভারত, পাকিস্তান এবং আসাম বেঙ্গল এই তিনটি অভিধায় ভাগ করার প্রস্তাব করা হয়েছিল। আসামের বরদুলুই আর শ্যামাপ্রসাদরা আসাম বেঙ্গলে মুসলমানরা সংখ্যা গরিষ্ঠ হয়ে যাবে সেই আশঙ্কায় এটি মেনে নেয়নি যার পরিনতি এখন পূর্বাঞ্চলের ‘সেভেন সিস্টার্স’ এর সাথে ভারতের মূল ভূ–খণ্ডের যোগাযোগ ভরসা এক সরুপথ যার নাম ‘চিকেন নেক বা শিলিগুড়ি কড়িডোর’। পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়ি হয়ে ভারতীয় পূর্বাঞ্চলের সাথে সংযোগ রক্ষাকারী এই কড়িডোর দৈর্ঘে ৬০ কিঃমিঃ আর প্রস্থে ২০ কিঃমিঃ –দীর্ঘ কোথাও কোথাও ১৭ কিঃমিঃ এর এ করিডোর। এর এক পাশে বাংলাদেশ অপর পাশে নেপাল। পূর্বে ভূটান এবং চীন। শিলিগুড়ি কড়িডোর থেকে মাত্র ৬০ কিঃমিঃ দূরে চীনের অবস্থান।
শিলিগুড়ি কড়িডোরের ভূ–কৌশলগত গুরুত্ব এই কড়িডোর ‘সেভেন সিস্টার্স’কে ভারতের মূল ভূ খণ্ডের সাথে সংযুক্তি প্রদান করেছে। কোনো কারণে শিলিগুড়ি কড়িডোর বন্ধ হয়ে গেলে তা ভারতের মূল ভূ–খণ্ডের সাথে এই অঞ্চলের সড়ক যোগাযোগ বিপন্ন করবে। ১৯৬২ সালে চীন–ভারত যুদ্ধে চীন ভারতকে এই হুমকিটি দিয়েছিল। শিলিগুড়ি করিডোরের এই ভূ–কৌশলগত অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে ভারতীয় কৌশল প্রণেতারা শিলিগুড়ি কড়িডোর’এর নিরাপত্তায় ভাগডোগরা এবং হাসিমারা’র দুটি বিমান ঘাঁটিতে অত্যাধুনিক বিমান বহর নিয়োজিত রেখেছেন।
শিলিগুড়ি কড়িডোর’ নিয়ে ১৯৬২ সালে চীনের দিক থেকে যে আশঙ্কা ছিল ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ও ভারতীয়দের আশঙ্কা ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের দিক থেকে আক্রমণ করে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী শিলিগুড়ি কড়িডোর’ বন্ধ করে উত্তর পূর্বাঞ্চলের সাথে ভারতের যোগায়োগ বিচ্ছিন্ন করার প্রয়াস পাবে, সেটি হয়নি। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে তার পূর্বাঞ্চলের বিদ্রোহ নির্মূলে এবং শিলিগুড়ি কড়িডোর’ নিয়ে ভারত অনেকটা নির্ভার হয়। তবে পরবর্তীতে তার এই নির্ভারতা স্থায়ী হয়নি। চীন–পাকিস্তানের দিক থেকে ক্রমাগত বৈরী মনোভাব এবং সময়ে পরিবর্তীত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের দিক থেকে চীন পাকিস্তানের অবস্থানের দিকে ঝুঁকে পড়া ভারত তার পূর্বাঞ্চলের নিরাপত্তা ঝুঁকির মাত্রা বৃদ্ধি হিসাবে গণ্য করে। বর্তমান চলমান তেমন এক পরিস্থিতিতে চীনে প্রফেসর ইউনুস’এর ২৮ মার্চ এর বক্তব্যের জের ধরে ভারতীয় বিভিন্ন মহল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং পত্র পত্রিকায় যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন তার কয়েকটি এখানে উল্লেখ করলে দু দেশের সর্ম্পক যে কোন পর্যায়ে নেমেছে তা আন্দাজ করা যাবে। এসব বক্তব্য বিবৃতি এক কথায় অশোভন, আপত্তিকর কূটনৈতিক শিষ্টাচার র্বহির্ভূত একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সরাসরি হস্তক্ষেপের সামিল। যেমন ‘দি জয়পুর ডায়ালগ’ নামক এক পডকাস্টে ‘ইন্ডিয়া রেডি টু স্ট্রাইক বাংলাদেশ’ শিরোনামে কর্নেল অজয় রায়না নামক অবসরপ্রাপ্ত এক সেনা কর্মর্কতা অনেকটা উপহাসের সুরে বলেন, ইউনুস মিয়া আমাদেরকে পূর্ব ভারতকে ল্যান্ডলক থেকে মুক্তি দেওয়ার পথ খুলে দেওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছেন, এখন আমাদের ফেনী হয়ে চট্টগ্রাম দখলের সুযোগ করে দিয়েছেন। একই পডকাস্টে’র আরেকটি এপিসোডে অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল আর এস এন সিং ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিচ্ছিন্নতাবাদ উস্কে দেওয়ার সুপারিশ করেছেন। ত্রিপুরা মোথা পাটিীর প্রদ্যুত মানিক্য আরো কিছুটা আগ বাড়িয়ে বলেন ‘Time to India to make a route to the Ocean by supporting our Indigenous people who once rule Chittagong, so we are no longer dependent on an ungrateful regime’
“India’s biggest mistake was to let go of the port in 1947 despite the hill people living there wanting to be a part of the Indian union” প্রদ্যুত মানিক্যের এসব মন্তব্যের মূল কথা হল পার্বত্যাঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠিগুলিকে সাহায্যের মাধ্যমে পূর্ব ভারতের সাগরে যাওয়ার পথ করে নেওয়ার এখনই সময়, একটি অকৃতজ্ঞ শাসকগোষ্ঠির উপর নির্ভশীল থাকার কোনো প্রয়োজন নাই। ১৯৪৭ সালে ভারতের বড় ভুল ছিল চট্টগ্রাম বন্দর হাতছাড়া করা সেই সময় পাহড়ীরা ভারতীয় ইউনিয়নে যোগ দিতে চেয়েছিল।
প্রদ্যুত মানিক্যের এসব বক্তব্য থেকে এ অঞ্চলের নৃতত্ত্ব, ভূমিরূপ সম্পর্কে তার অজ্ঞেনতাই নিধারুনভাবে প্রকাশিত হয়েছে।
বাংলাদেশে এক সময়ের ভারতীয় হাই কমিশনার শ্রী পংকজ শরন প্রফেসর ইউনুসের সেভেন সিস্টার্স নিয়ে বক্তব্যের উপর মন্তব্য করতে গিয়ে ‘দি ট্রিবিউন’ পত্রিকার অন লাইন ভার্সনে এক সাক্ষাৎকারে বলেন ‘ভারতের পূর্বাঞ্চলের মানুষের দুর্দশায় তার (ইউনুস) মনে যে সহানুভূতি তা বাংলাদেশের উপর দিয়ে ট্রানজিট পেতে ভারতকে সহায়তা করবে’। ‘গার্ডিয়ান অব ওসান’ এর মাধ্যমে প্রফেসর ইউনূস কি বুঝিয়েছেন তা পংকজ শরনের কাছে বোধগম্য নয় বলে তিনি মন্তব্য করেছেন, কারণ বে অব বেঙ্গলে ভারতীয় উপকূল রেখা রয়েছে ৬,৫০০ (ছয় হাজার পাঁচ শত) কিঃ মিঃ এবং এ অঞ্চলে ভারতের পাঁচটি শক্তিশালী নৌ ঘাঁটি রয়েছে।
ভারতীয় সংসদে প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস পার্টির মুখপাত্র পবন খেরা প্রফেসর ইউনুস এর মন্তব্যের উপর তার দলের প্রতিক্রিয়া জানাতে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন ‘বাংলাদেশ সরকারের এ উদ্যোগ আমাদের ঘিরে ফেলার আয়োজন, এটি বি জে পি সরকারের পররাষ্ট্র নীতির চরম ব্যর্থতা’। একই সাথে পবন খেরা প্রফেসর ইউনুস এর মন্তব্যেরও কড়া সমালোচনা করেন। উপরোক্ত সমস্ত মন্তব্য, বিবৃতি এবং অবস্থান বিবেচনায় নিয়ে নির্মোহ বিশ্লেষণ করলে এ কথা বলা যাবে না যে, বাংলাদেশ ভারতের সম্পর্ক খুব একটা ইতিবাচক পথে আগাচ্ছে।
লেখক: প্রাবন্ধিক, কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট; সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক।