একটি জাতির ইতিহাসে কিছু মাহেন্দ্রক্ষণ থাকে, যা প্রতিটি জাতিসত্তা স্বযত্নে হৃদয়ে ধারণ করে এবং স্ব–গৌরবে উদযাপন করে। বাঙালি জাতির ইতিহাসে ১৬ ডিসেম্বর তেমনই একটি গৌরবান্বিত দিন। এদিন ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ এর গণঅভ্যূত্থান, ১৯৭০ সালের র্ন্বিাচন আর ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধের রক্তস্নাত পথ চলাকে একত্রে বুকে ধারণ করে সারা বিশ্বকে স্ব–গৌরবে জানান দিয়েছিল আমরা বিজয়ী জাতি–আমরা স্বাধীন। এ বিজয় অর্জনে আমাদের যে আত্মত্যাগ তা স্বাধীনতা সংগ্রামে পৃথিবীর ইতিহাসে ত্যাগের মহিমায় দেদীপ্যমান হয়ে থাকবে চিরকাল।
আমাদের এ উপ–মহাদেশে বহু জাতিসত্তা রয়েছে। শৌর্যে বীর্যে কীর্তির মহিমায় তারা অনেকেই বিরল অভিধায় অভিষিক্ত। যেমন এ উপ–মহাদেশে পাঞ্জাবী, মারাঠী, গুজরাটি, রাজপুত, সিন্ধি, বালুচ, নাগা, মিজো, ত্রিপুরী, মনিপুরী, অহমীয়া, তামিল ইত্যাদি। এই সব জাতিসত্তার কেউ স্বতন্ত্র অভিধায় অভিষিক্ত হয়ে স্বাধীন সত্তায় বিরাজিত নয়। অথচ এইসব জাতি সত্তার প্রত্যেকেরই স্ব স্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ধারা রয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে ব্যতিক্রম আমরা বাঙালিরা। ১৬ ডিসেম্বরের বিজয়ের মাধ্যমে আমরা একটি স্বাধীন সত্তা নিয়ে পৃথিবীর বুকে বিদ্রোহী কবির দীপ্ত উচ্চারণের মত ‘আমি চির উন্নত মম শির’ বলে এখন স্বাধীন জাতি হিসেবে বিচরণ করছি। আমরা পৃথিবীর রাষ্ট্র সত্তায় সম্মানের সাথে আজ আসীন। আমরা আমাদের অদম্য স্পৃহায় পৃথিবীর দেশে দেশে যেখানেই সংঘাত যেখানে হানাহানি সেখানেই শান্তি স্থাপনে অগ্রণী, এ কর্মকাণ্ডে আমরা নেতৃত্বে। অথচ এক সময়ে জাতি হিসাবে আমাদের সামরিক সক্ষমতা নিয়ে আমরা তাচ্ছিল্যের শিকারও ছিলাম।
আমাদের জাতিসত্তার এ অভিযাত্রা এ দীর্ঘ পথ পরিক্রমা নরুলদীনের কবি সৈয়দ শামসুল হক তার ‘আমার পরিচয়’ কবিতায় যে অন্যন্য দ্যোতনায় আর মমত্বে তুলে ধরেছেন তার কিছু অংশ এখানে তুলে ধরার লোভ সংবরণ করা আমার জন্য দুরূহ–
‘তেরশত নদী শুধায় আমাকে, কোথা থেকে তুমি এলে?
আমি তো এসেছি চর্যাপদের অক্ষরগুলো থেকে
আমি তো এসেছি কৈবর্তের বিদ্রোহী গ্রাম থেকে
আমি তো এসেছি র্সা্বভৌম বারোভূঁইয়া থেকে
আমি তো এসেছি ‘কমলার দীঘি মহুয়ার পালা থেকে
আমি তো এসেছি তিতুমীর আর হাজি শরীয়ত থেকে
আমি তো এসেছি গীতাঞ্জলি ও অগ্নিবীনার থেকে।
এসেছি বাঙালি ক্ষুদিরাম আর সূর্যসেনের থেকে
এসেছি বাঙালি জয়নুল আর অবন ঠাকুর থেকে।
এসেছি বাঙালি রাষ্ট্রভাষার লাল রাজপথ থেকে
এসেছি বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর থেকে।
আমি যে এসেছি জয়বাংলার বজ্্রকণ্ঠ থেকে
আমি যে এসেছি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ থেকে।
আমাদের পূর্বপুরুষদের সুবর্ণ এ পথ বেয়ে আমরা এসেছিলাম ১৯৭১ সালে। ৭১ সালের প্রেক্ষাপট কবি নির্মলেন্দু গুণের অমর কবিতা ‘স্বাধীনতা এই শব্দটি কি ভাবে আমাদের হল’ এতে বর্ণিত হয়েছে হৃদয় ছোঁয়া বর্ণনায়। তারও কিছু অংশ পাঠকদের জন্য তুলে ধরছি আমাদের জাতির সেই সময়ের প্রেক্ষাপটকে ধারণ করতে সহায়তার জন্য।
কপালে কব্জিতে লাল সালু বেঁধে
এই মাঠে ছুটে এসেছিল কারখানা থেকে লোহার শ্রমিক,
লাঙল জোয়াল কাঁধে এসেছিল ঝাঁক বেঁধে উলঙ্গ কৃষক
পুলিশের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে এসেছিল প্রদীপ্ত যুবক।
হাতের মুঠোয় মৃত্যু, চোখে স্বপ্ন নিয়ে এসেছিল মধ্যবিত্ত
নিম্ন মধ্যবিত্ত, করুন কেরানী, নারী, বৃদ্ধ, বেশ্যা, ভবঘুরে
আর তোমাদের মত শিশু পাতা কুড়ানীরা দল বেঁধে
একটি কবিতা পড়া হবে, তার জন্য কী ব্যাকুল
প্রতীক্ষা মানুষের ‘কখন আসবে কবি?’ ‘কখন আসবে কবি?’
শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে
রবীন্দ্রনাথের মত দীপ্ত পায়ে হেঁটে
অতঃপর কবি এসে জনতা মঞ্চে দাঁড়ালেন
তখন পলকে দারুন ঝলকে তরীতে উঠিল জল
হৃদয়ে লাগিল দোলা, জন সমুদ্রে জাগিল জোয়ার
সকল দুয়ার খোলা। কে রোধে তাঁহার ব্রজকণ্ঠ বানী?
গণ সূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তার অমর কবিতাখানি
‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’।
সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের।
১৯৭১ সালের মার্চ থেকে দীর্ঘ নয় মাস বাঙালি জাতি সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। গ্রামের মজুর, ছাত্র –শিক্ষক, কৃষক, শ্রমিক নির্বিশেষে। ঐ যুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ শহীদ দুই লক্ষ মা বোনের সম্ম্রম হারানোর বেদনা এ জাতিকে অনন্ত কাল বয়ে বেড়াতে হবে।
কবি শামসুর রাহমান তার ‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে হে স্বাধীনতা’ কবিতায়ও তুলে এনেছেন স্বজন হারানোর বেদনার্ত এক কাব্যর এক জায়গায় উল্লেখ করেছেন
তুমি আসবে বলে হে স্বাধীনতা
শহরের বুকে জলপাই রঙের ট্যাংক এলো
দানবের মত চিৎকার করতে করতে
তুমি আসবে বলে হে ষ্বাধীনতা
ছাত্রাবাস বস্তি উজার হল। রিকয়েরলেস রাইফেল
আর মেশিন গান খই ফোটালো যত্রতত্র।
ট্যাংক, মেশিন গান আর রাইফেল, মাইনের আঘাতে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে অনেকে পা পাড়িয়েছেন, অনেকে গুলিতে পঙ্গু হয়েছেন, মা তার সন্তান হারিয়েছেন, বোন তার স্বামী হারিয়েছেন, সন্তান তার বাবাকে হারিয়েছেন, এভাবে হারনোর বেদনায় আকণ্ঠ নিমজ্জিতদের তখন জিজ্ঞেস করা হলে সন্তান হারানো মার উত্তর ছিল স্বাধীনতা আমার হারানো সন্তান, স্বামী হারানো বোনকে জিজ্ঞেস করা হলে তার উত্তর স্বাধীনতা আমার হারানো স্বামী, ভাই হারানো বোনকে জিজ্ঞেস করা হলে তার উত্তর ছিল স্বাধীনতা আমার হারানো ভাই। সে দিনের সেই মাহেন্দ্রক্ষণের এমনই ছিল অনুভূতি।
কবি শামসুর রাহমান তার ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতায়, স্বাধীনতাকে দেখেছেন সাবলীল প্রাণবন্ত অন্যান্য এক বোধ থেকে। তিনি তার অন্তর্জাত অনুভূতি থেকে রচনা করেছেন
স্বাধীনতা তুমি
রবিঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান।
স্বাধীনতা তুমি
কাজী নজরুল ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো
মহান পুরুষ, সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কাঁপা
স্বাধীনতা তুমি
শহীদ মিনার অমর একুশে ফেব্রুয়ারীর উজ্জ্বল সভা
স্বাধীনতা তুমি
পতাকা শোভিত শ্লোগান মুখর ঝাঁঝালো মিছিল।
১৬ ডিসেম্বর আমাদের আত্মত্যাগের মহিমায় সমুজ্জ্বল হয়ে আমরা বিজয় ছিনিয়ে আনি।
আমার এ লেখাটি প্রকাশিত হচ্ছে ১৫ ডিসেম্বর। গতকাল ১৪ ডিসেম্বর এই দিন ১৯৭১ আমরা হারিয়েছি আমাদের মেধায় মননে অর্জনে অনন্য একদল সোনার মানুষকে। বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করে পঙ্গু করার লক্ষ্যে সেদিন এ মানুষগুলিকে ঘর থেকে রাতের অন্ধকারে তুলে নিয়ে নির্মম নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছিল। বর্বরোচিত এ হত্যাকাণ্ডের যারা শিকারে পরিণত হয়েছিলেন তাদের মধ্যে অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক আবুল খায়ের, ডা. ফজলে রাব্বি, ডা. আলীম চৌধুরী, অধ্যাপক মোফজ্জল হায়দার চৌধুরী, শহীদুল্লাহ কায়সার, অধ্যাপক গিয়াসুদ্দিন আহাম্মেদ, অধ্যাপক রশিদুল হাসান, ডাঃ গোলাম মুর্তুজা, সাংবাদিক সিরাজুদ্দিন হোসেন, নাজমুল হক, নিজামুদ্দিন, সেলিনা পারভীন অন্যতম। ত্রিশ লক্ষ শহীদ আর দু লক্ষ মা বোনের সাথে শহীদ এইসব বুদ্ধিজীবীদেরও আজ সশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরণ করি।
লেখক: প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট; সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক।