ত্রিপুরা :
অন্যান্য বিষয়ের চাপে শিরোনামস্থ লেখাটি প্রকাশের ধারাবাহিকতায় বেশ কয়েক সপ্তাহ ব্যত্যয় ঘটে। সাম্প্রতিকের কিছু ঘটনাবলী এ লেখার শিরোনামের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে পড়াতে পুনরায় এ ধারাবাহিকতায় প্রত্যাবর্তন। সুধি পাঠক যারা লেখাটি নিয়ে অনুসন্ধিৎসু ছিলেন তাদের জন্য নিবেদন এবার এ লেখার ধারাবাহিকতা বজায় রাখার প্রয়াশ থাকবে।
ত্রিপুরা ভারতের স্বাধীনতা পূর্ব সময়েও স্বাধীন সত্তা আর স্বীয় বৈশিষ্ট্য নিয়ে পৃথিবীর বুকে প্রতিষ্ঠিত ছিল। ১৫ অক্টোবর ১৯৪৯ সালে ত্রিপুরা ভারতীয় প্রজাতন্ত্রে যোগদান করে। ১ জুলাই ১৯৬৩ ত্রিপুরা ভারতীয় ইউনিয়ন টেরিটরির মর্যাদা লাভ করে। ১৯৭২ সালের ২১ জানুয়ারি ত্রিপুরা ভারতীয় প্রজাতন্ত্রে একটি পূর্ণাঙ্গ রাজ্য হিসাবে মর্যাদা লাভ করে।
ত্রিপুরা নিয়ে লিখব এটা আগেই নির্দিষ্ট ছিল, তবে মায়ানমারের চিন স্টেট এবং ভারতের অরুণাচলের পরে। কিন্ত্তু ২ ডিসেম্বর ২০২৪ ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলার কুঞ্জবনে অবস্থিত বাংলাদেশের সহকারী হাই কমিশন উগ্র উচ্ছৃঙ্খল কিছু মানুষের হাতে আক্রান্ত হয়। বৃটিশ সংবাদ মাধ্যম বি বি সি’ বাংলা জানায় হামলাকারীরা ‘হিন্দু সংঘর্ষ পরিষদ’ এর সদস্য। এই সংঘর্ষ পরিষদ বিশ্ব–হিন্দু পরিষদ (বি এইচ পি) এর সাথে সম্পর্কিত। ত্রিপুরার বাংলাদেশের সহকারী হাই কমিশন অফিস আক্রান্ত হওয়ার আগে একইদিন সহকারী হাই কমিশন থেকে মাত্র ২০০ মিটার দূরে আক্রমণকারীরা সমাবেশে মিলিত হয়। তখনই সেখানকার আইন শৃংঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সহকারী হাই কমিশন আক্রান্ত হতে পারে তা আঁচ করে ঘটনা প্রতিরোধে যথাযথ নিবারণমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারতেন, তারা সে কাজটি করেননি। বরং অনেকটা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছেন বলে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম জানিয়েছে। এ বিষয়টি দূতাবাস সংক্রান্ত ১৯৬১ সালের জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত জেনেভা কনভেনশনের সুস্পষ্ট লংঘন। ঘটনার জন্য বাংলাদেশ তার গভীর উদ্বেগ এবং ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। ভারত ইতিমধ্যে এ ঘটনার জন্য ত্বরিৎ দুঃখ প্রকাশ করেছে।
আশ্চর্য্যের বিষয় হল এরই মধ্যে ত্রিপুরা হোটেল মালিক সমিতি নাকি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে তারা কোনো বাংলাদেশীকে তাদের হোটেলে আতিথ্য গ্রহণ করতে দেবেন না।
এর বাইরেও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে গত কয়েকদিন বাংলাদেশ বিরোধী বিক্ষোভ সংঘটিত হওয়ার খবর প্রচারিত হচ্ছে। এর মাঝে ফেনীর পরশুরামের বিলোনীয়া স্থলবন্দর ঘিরে সনাতনী হিন্দু সমাজের নামে বিক্ষোভ হয়, কলকাতায় ২৮ নভেম্বর ‘বঙ্গীয় হিন্দু জাগরণ’ নামের ব্যানারে একদল লোক বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রর্দশন করে। তবে এদিন ভারতের ক্ষমতাসীন বি জে পি দলের পশ্চিম বাংলার অন্যতম নেতা বাবু সুভেন্দু অধিকারীর বক্তব্য ছিল চরম বাংলাদেশ বিরোধী এবং তীব্র আক্রমণাত্মক।
মমতা ব্যানার্জি যিনি বরাবরই ধর্মান্ততার বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেন, আসামের অসহায় লক্ষ মানুষকে যখন শিবিরে নেওয়া হচ্ছিল সেদিন মমতা ব্যানার্জির প্রচণ্ড গর্জনে ফেটে পড়েছিলেন ‘আসামের অসভ্যতা বন্ধ করা হউক’ ‘আমি আমার জীবনের শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে আসামের অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াব’। সেই থেকে শ্রীমতি মমতা ব্যানার্জিকে আমি সব সময় শ্রদ্ধার আসনে স্থান দিয়ে এসেছি। এই মমতা ব্যানার্জি যখন তাদের সংসদে দাঁড়িয়ে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তায় ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে বাংলাদেশে শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠানোর উদ্যোগ নিতে বলেন, তখন মনে হয় ভারত–বাংলাদেশ সর্ম্পক সৌহার্দ্যের একেবারে তলানীতে গিয়ে পৌঁছেছে। এ ধারণা থেকেই ২৮ নভেম্বর ’২৪ নিউয়র্ক টাইমস তাদের অন লাইন সংস্করণে প্রতিবেদনের শিরোনাম করে ‘বাংলাদেশ–ভারত ঃ একসময়ের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক এখন তিক্ত’। তিক্ততার বহিঃপ্রকাশ।
এরই মধ্যে বাংলাদেশ আগরতলা মিশনের ভিসা কার্যক্রম স্থগিত করেছে। কূটনৈতিক মাধ্যমে প্রতিবাদ জানানোর চূড়ান্ত ব্যবস্থা হিসেবে ঢাকাস্থ ভারতীয় দূতাবাসের হাই কমিশনারকে পররাষ্ট্র দপ্তরে তলব করে ভারতীয়দের আচরণের ব্যাপারে ঢাকার মনোভাব জানিয়েছেন। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান বাংলাদেশের ব্যাপারে কোনো দেশের অযাচিত হস্তক্ষেপের ব্যাপারে জাতীয় ঐক্যমত্যের আহ্বান জানিয়ে ৪ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ এবং আরো কয়েকটি দল বাদে অন্য সব দল নিয়ে তার কার্যালয়ে বৈঠক করেছেন। সব কিছু মিলিয়ে এই মুহূর্তে ভারত বাংলাদেশ সম্পর্ক শুধু তিক্ত নয় উত্তেজনাপূর্ণও বটে।
এখানে উল্লেখ্য যে ত্রিপুরীরা বর্তমানে সাম্প্রদায়িকতার ঘোলাজলে অবগাহন করে বাংলাদেশের সহকারী হাই কমিশন আক্রমণ করেছে এরাই কিন্ত্তু এক সময়ে বাংলাদেশকে তাদের আশ্রয়স্থল ভাবত। সত্তরের দশকে যখন ত্রিপুরার সাধারণ মানুষ যখন অনুধাবন করতে শুরু করেছে কেন্দ্র তাদের চাওয়া পাওয়ার দিকে কোনো গুরুত্ব দিচ্ছে না তখন তাদের মধ্যে অসন্তোষ দানা বাঁধতে থাকে। এরই ফলশ্রুতি ত্রিপুরী একদল যুবকের ‘সেঙকারক’ নাম ধারণ করে ভারত সরকারের প্রতি প্রথম বিদ্রোহের দাবানল প্রজ্বলন করে, এটি ১৯৬৭ সালের ঘটনা। ‘সেঙকারক’ এর পথ ধরে ১৯৭১ এ গঠিত হয় ‘ত্রিপুরা উপজাতি জন সমিতি’ বা টি ইউ জে এস। তবে ত্রিপুরায় সত্যিকারের বিদ্রোহের দাবানল ছড়ান বিজয় কুমার রাঙ্গখোয়াল তার ‘ত্রিপুরা ন্যাশনাল ভলান্টিয়ার’ বা টি এন ভি গঠনের মাধ্যমে। টি এন ভি গঠিত হয় ১৯৮৮ সালে। ১৯৮৮ সালে তখন আমি খাগড়াছড়ি ব্রিগেড সদর দপ্তরে কর্মরত। খাগড়াছড়িতে অনেক সচেতন ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর বাস, তাদের মাধ্যমে বিজয় রাঙ্গখোয়ালের নানা দুঃসাহসিক অভিযানের কথা কানে আসত। সেই সব শুনে শুনে আমার কাছে বিজয় রাঙ্গখোয়াল তখন সত্যিই এক বীরের নাম।
রাঙ্গখোয়ালের সাথে দ্বিমতের সূত্রে গঠিত হয় পর পর আরো দুটি ইনসার্জেন্ট গোষ্ঠী। এরা যথাক্রমে ‘ন্যাশনাল লিবারেশন ফোর্স ত্রিপুরা’ বা এন এল এফ টি, অপরটি ‘অল ত্রিপুরা টাইগার্স ফোর্স’ বা এ টি টি এফ।
টি এন ভি, এন এল এফ টি বা এ টি টি এফ সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে যত না সাফল্য প্রদর্শন করতে পেরেছে তার থেকে অধিক শক্তিক্ষয় ঘটিয়েছে নিজেদের মাঝে আত্মঘাতি সংর্ঘষ আর নিজেদের সংহারে। ফলে এরা ক্রমশই দুর্বল হয়েছে। সরকারি বাহিনীর অভিযানে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে অনেক সময়। বাংলাদেশের জঙ্গলার্কীণ পাহাড়ি অঞ্চলেও অনুপ্রবেশ করেছে সময়ে সময়ে। এদিক থেকেও তথা যেখানে আশ্রয় নিয়েছে সেখান থেকেও তারা কখনো জোরালো তেমন কোনো মদদ পায়নি। ফলশ্রুতি ত্রিপুরার ইনসার্জেন্ট গোষ্ঠীগুলি একদিকে তাদের মতাদর্শের দ্বন্দ্বে যেমন দুর্বল হয়েছে তেমনি তাদের পিছনে সাহায্যের হাত বাড়ানোর তেমন কাউকে তারা খুঁজে পেতেও ব্যর্থ হয়ে কেবল বিলীন হওয়ার পথে হেঁটেছে।
এই সুযোগের পুরা সৎব্যবহার করেছে ভারতের ক্ষমতাসীন দল বি জে পি। তারা উত্তর পূর্ব ভারতের অন্যান্য রাজ্যের মত এখানেও ধর্মীয় একধরনের উগ্রবাদ ছড়িয়ে নিজেদের অবস্থানকে সুসংহত করেছেন। এরই ফলশ্রুতি ‘ত্রিপুরা ন্যাশনাল ভলান্টিয়ার’ বা টি এন ভি, ‘ন্যাশনাল লিবারেশন ফোর্স ত্রিপুরা’ বা এন এল এফ টি, ‘অল ত্রিপুরা টাইগার্স ফোর্স’ বা এ টি টি এফ এক সময় বুঝতে পারে সমঝোতা তথা আত্মসমর্পণ চুক্তি ছাড়া গত্যন্তর নেই। এই প্রেক্ষিতে ৪ মার্চ ২০২৪ ত্রি–পক্ষীয় একটি শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকেন ভারতীয় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ, ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী মানিক শাহ, এন এল এফ টি’র প্রধান বিশ্ব মোহন দেববর্মা, এ টি টি এফ প্রধান অলিন্দ্র রেয়াং। চুক্তি অনুযায়ী ৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ভারতীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ’র উপস্থিতিতে ‘ন্যাশনাল লিবারেশন ফোর্স ত্রিপুরা’ বা এন এল এফ টি, ‘অল ত্রিপুরা টাইগার্স ফোর্স’ বা এ টি টি এফ এর বিপুল সংখ্যক সশস্ত্র সদস্য অস্ত্র সমর্পণ করে। আত্মসমর্পণকারীদের পুনর্বাসনে ভারত সরকার ৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সম পরিমাণ অর্থ বরাদ্ধ ঘোষণা দেয়।
এ ভাবেই ত্রিপুরার প্রায় দীর্ঘ ৩৪ বছরের ইনসার্জেন্সি তথা বিদ্রোহ অবস্থার অবসান ঘটে। ‘ন্যাশনাল লিবারেশন ফোর্স ত্রিপুরা’ বা এন এল এফ টি, ‘অল ত্রিপুরা টাইগার্স ফোর্স’ বা এ টি টি এফ এর সশস্ত্র সদস্য অস্ত্র সমর্পণ করার সাথে সাথেই ত্রিপুরা রাজ্য সরকার ত্রিপুরাকে বিদ্রোহ তথা সন্ত্রাস মুক্ত ঘোষণা করে। ভারতীয় কৌশল প্রণেতারা অত্যন্ত সুক্ষ্ম এবং সুকৌশলে ত্রিপুরায় যেভাবে বাংলাদেশ বিরোধী মনোভাব উস্কে দিচ্ছেন তা আমাদের নীতি কৌশল প্রণেতাদেরও বিবেচনায় রাখতে হবে, কারণ আমাদের পার্বত্যাঞ্চলে বিশেষ করে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায় অনেক ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে।
লেখক: প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট; সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক।