সমকালের দর্পণ

মেজর মোহাম্মদ এমদাদুল ইসলাম (অব.) | রবিবার , ৬ অক্টোবর, ২০২৪ at ৬:২১ পূর্বাহ্ণ

গাজায় গণহত্যার একবছর হাসাননাসরুল্লাহ’র হত্যাকাণ্ড

. “ভারতীয় পূর্বাঞ্চলের প্রদেশ সমূহ, ভারত বাংলাদেশ চলমান সর্ম্পক” এই শিরোনামের লেখাটির তৃতীয় পর্ব ইতিমধ্যে আমার পাঠকরা নিশ্চয়ই পড়েছেন। লেখাটির আরো অনেকগুলো পর্ব রয়েছে, আশা করি এ লেখাটির পর আবার তা পাঠকদের সামনে উপস্থাপন করব। এ লেখাটি লেখার তাগাদাটা অনুভব করি মধ্যপ্‌্রাচ্যে ইসরাইলী হামলায় হিজবুল্লাহ নেতা হাসাননাসরুল্লাহ নির্মম হত্যাকান্ডের শিকারে পরিণত হওয়ার প্রেক্ষাপটে। মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে ক্রমবর্ধমান ইসরাইলী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড প্রতিরোধ গড়ে তোলায় যে কয়জন সাহসী মানুষ জীবন বাজি রেখে লড়ছিলেন তার মধ্যে হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরুল্লাহ অন্যতম।

৭ অক্টোবর ২০২৪ ইসরাইলে ফিলিস্তিনি গেরিলা দল হামাসের আক্রমণের এবং সেই থেকে ইসরাইল কর্তৃক গাজায় গণহত্যা শুরু। আগামী পৃথিবীর প্রজন্মের পর প্রজন্মের জন্য এ গণহত্যা নির্মম নৃশংস নিষ্ঠুরতার এক বিষণ্ন ক্যানভাস হয়ে থাকবে এ আমি নিশ্চিত। এ প্রেক্ষাপটে আমি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছি না আগামী বিশ্ব ইতিমধ্যেই গাজায় ইসরাইলী বর্বরতার শিকার নিরীহ নিরপরাধ ৪৫০০০ (পঁয়তাল্লিশ) হাজার মানুষের হত্যাকাণ্ডকে কীভাবে ন্যায্য বলে বিবেচনা করবে

আমি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছি না গাজায় ইতিমধ্যে হত্যাকাণ্ডের শিকার ১৬০০০ (ষোল) হাজার শিশুর অকাল অকারণ হত্যাকাণ্ডকে আগামী বিশ্ব কিভাবে ন্যায্য বলে বিবেচনা করবে

ইসরাইলের গাজায় লক্ষ মানুষকে দারিদ্রের কষাঘাতে ক্রমাগত মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়াকে আগামী বিশ্ব কিভাবে ন্যায্য বলে বিবেচনা করবে হাসপাতাল, স্কুল বিশ্ববিদ্যালয়, মসজিদ র্গীজায় নির্বিচার বোমাবর্ষণ করে ধূলিস্যাত করাকে আগামী বিশ্ব কিভাবে ন্যায্য বলে বিবেচনা করবে আমি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছি না।

আমি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছি না গাজার সমগ্র জনগোষ্ঠীকে নিরাপদ এলাকায় স্থানান্তরের নামে একবার এ অঞ্চলে আরেকবার ঐ অঞ্চলে টেনে হিঁছড়ে নিয়ে যাওয়াকে আগামী বিশ্ব কিভাবে ন্যায্য বলে বিবেচনা করবে।

নিরাপদ অঞ্চল বলে ঘোষিত এলাকায় আশ্রয় নেওয়া মানুষগুলির উপর নির্বিচারে বোমাবর্ষণে হত্যা করা আগামী বিশ্ব কিভাবে ন্যায্য বলে বিবেচনা করবে। আমি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছি না গাজার মানুষের বিদ্যুৎ, পানি, খাবার, চলাচল ইত্যাদি বন্ধ করে দেওয়াকে আগামী বিশ্ব কিভাবে ন্যায্য বলে বিবেচনা করবে। যুদ্ধের নির্মমতায় আহত মানুষদের চিকিৎসা দিতে যাওয়া ৫০০ (পাঁচ শত) চিকিৎসক এবং চিকিৎসা কর্মীকে অবলীলায় হত্যা করাকে আগামী বিশ্ব কিভাবে ন্যায্য বলে বিবেচনা করবে। আমি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছি না গাজার অসহায় মানুষদের খবর বিশ্ববাসীকে জানাতে গিয়ে অসংখ্য সংবাদ কর্মীর মৃত্যুকে আগামী বিশ্ব কিভাবে ন্যায্য বলে বিবেচনা করবে

আমি কোন যুক্তিই খুঁজে পাচ্ছিনা যে, পশ্চিমা বিশ্বের ইসরাইলকে ক্রমাগত অস্ত্রসজ্জিত করণ এবং সে অস্ত্রে অবলীলায় নিরীহ মানুষ মারাকে মানবাধিকারের কোন সংজ্ঞায় আগামী বিশ্ব নায্য বলে বিবেচনা করবে। আমি কোন যুক্তিই খুঁজে পাচ্ছিনা বছরের পর বছর একদিকে আক্রমণের নির্মমতা অন্যদিকে ফিলিস্তিনীদের স্বীয়ভূমি থেকে উচ্ছেদ করে ইসরাইলীদের পুনর্বাসন আগামী বিশ্ব কিভাবে ন্যায্য বলে বিবেচনা করবে।

লক্ষ লক্ষ টন ধ্বংস স্ত্তূপের নীচে আটকাপড়া মানুষগুলোকে উদ্ধার করতে না পারার/উদ্ধার করতে না দেওয়ার বিষয়টি আগামী বিশ্ব কিভাবে ন্যায্য বলে বিবেচনা করবে তা আমি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছি না।

জাতিসংঘে এক সময়ের মার্কিন স্থায়ী প্রতিনিধি পরবর্তীতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রার্থী হওয়ার দৌড়ে হেরে যাওয়া নিকি হেলি যখন ইসরাইলে গিয়ে সেখানে দূর পাল্লার গোলার গায়ে লেখেন “কিল দেম অল” তখন সেখানে র্নিবিচারে সবাইকে হত্যার কথাই বুঝান, এ বিষয়টি আগামী বিশ্ব কিভাবে ন্যায্য বলে বিবেচনা করবে তা আমি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছি না

যুদ্ধ মানুষকে নিঃস্ব্ব করে নিশ্চিহ্ন করে। যুদ্ধ মানুষের প্রতি মানুষের অসম্মান। এবোধ যখন মানুষের মাঝে জাগ্রত হয় না তখন মানুষ হত্যার মাঝে বিজয় অনুভব করে। ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু তেমনই একজন প্রতিশোধ পরায়ন মানুষ। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বক্তৃতা দিতে গিয়ে (যদিও তার বক্তৃতার সময় গুটি কয়েক গণহত্যা সমর্থনকারী ব্যতীত কেউ উপস্থিত ছিলেন না) নেতানিয়াহুর আস্ফালন আগামী বিশ্ব কিভাবে ন্যায্য বলে বিবেচনা করবে তা আমি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছি না

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যারা ইসরাইলের মূল মদতদাতা, সেই র্মাকিন যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন, ফ্রান্স, মিশর, সৌদি আরব সহ অন্যান্য প্রভাবশালী দেশ যখন গাজায় যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব দেন এবং সমর্থন করেন তা না মানার ইসরাইলের দৃষ্টতা প্রর্দশন করার বিষয়টি আগামী বিশ্ব কিভাবে বিশ্বাসযোগ্য বলে বিবেচনা করবে তা আমি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছি না

হিন্দরেপ, ছয় বছরের মেয়েটি তার বাবা মা ভাইয়ের সাথে নিরাপদ আশ্রয়ে যাচ্ছিল। ইসরাইলী বিমান হামলায় পথিমধ্যে সে বাবা মা ভাই সবাইকে হারায়। আহত এই অবোধ মেয়েটি এরপরও ১২(বার) দিন বেঁচে ছিল তারপরও সে উদ্ধার হয়নি, চিকিৎসা না পেয়ে অবশেষে ওপারে বাবা মা ভাইয়ের কাছে পাড়ি জমায়, পৃথিবীর মানুষের এই নিষ্ঠুরতা আগামী বিশ্ব কিভাবে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ নয় বলে বিবেচনা করবে তা আমি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছি না

গাজার শিশুদের আজ খেলার মাঠে যাওয়ার সুযোগ নাই, শিক্ষার অধিকার নাই, মায়েরা সন্তানের জন্ম দিচ্ছে যেন মৃত্যুর জন্য, গাজার মানুষেরা পাঁচ ওয়াক্তের পরিবর্তে এখন ছয় ওয়াক্ত নামাজ আদায় করেন, পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ আর এক ওয়াক্ত জানাজা। নিষ্ঠুরতার এই জীবনাচরণ আগামী বিশ্ব কিভাবে বিবেচনা করবে তা আমি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছি না

আমি বুঝে উঠতে পারছিনা গাজার অসহায় মানুষদের ব্যাপারে মানুষের বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্বে নৈতিকতার অবক্ষয় আর মানবিক মূল্যবোধের অপমৃত্যু কোন সংজ্ঞায় আগামী বিশ্ব নায্য বলে বিবেচনা করবে

একদিকে যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব অন্যদিকে ইসরাইলকে সকল অন্যায়ে নিঃশর্ত সমর্থন, মারণাস্ত্র সহ সকল আর্থিক সহায়তা প্রদান পশ্চিমাদের এ দ্বিচারিতা আগামী বিশ্ব কিভাবে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ নয় বলে বিবেচনা করবে তা আমি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছি না

এরই মধ্যে ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ইসরাইলীরা হিজবুল্লাহ নেতা হাসাননাসরুল্লাহ’কে হত্যা করে। হাসাননাসরুরুল্লাহ’র পূর্বসূরি ছিলেন আব্বাস আল মুসাভি। মুসাভি ’কে ও ১৯৯২ সালে ইসরাইলীরা দক্ষিণ লেবাননে তার স্ত্রী এবং পাঁচবছর বয়সী শিশু পুত্র সহ হত্যা করে। মুসাভিকে হত্যার পর হিজবুল্লাহ’ প্রতিরোধ যুদ্ধ থেকে সরে আসেনি বরং হাসাননাসরুল্লাহ’র নেতৃত্বে আরো তীব্র করেছে। মধ্যে প্রাচ্য জুড়ে হিজবুল্লাহ’ ই একমাত্র প্রতিরোধ বাহিনী যারা ২০০৬ সালে লেবানন থেকে ইসরাইলীদের পিছু হটতে বাধ্য করেছিল। এখন হাসাননাসরুল্লাহ’র জায়গায় হয়ত দেখা যাবে হাসেম সাফি আল দিন’এর মত নেতা নেতৃত্বে এসে মধ্যপা্রচ্যের ইসরাইল বিরোধী প্রতিরোধ যুদ্ধকে আরো তীব্রতর করে তুলবে।

ইসরাইলীরা ২০০৪ সালে হুইল চেয়ারে চলাফেরা করা হামাস নেতা শেখ আহাম্মদ ইয়াসিন’কে হত্যা করেছিল। এ ঘটনায় হামাস থেমে থাকেনি ইয়াসিন’এর উত্তর সূরি হিসেবে খালেদ মিশাল, ইসমাইল হানিয়া, ইয়াহিয়া সিনাওয়াত্রার মত আত্মদানে নির্ভিক নেতারা নেতৃত্বের অগ্রভাগে চলে এসেছেন।

এখন ইসরাইলের সামনে প্রশ্ন আসবে এত হত্যা, এত ধ্বংস, এত নির্মমতা আর নিষ্ঠুরতার পরও কি তার টিকে থাকার, নিরাপত্তার নিশ্চয়তা সে অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে? উত্তর নিশ্চয়ই না। তা হলে বুঝতে হবে ইসরাইল ভবিষ্যৎ এ আরো আরো মারাত্মক প্রতিরোধের মুখে পড়তে যাচ্ছে।

লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট; সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধদুরের দুরবিনে