সমকালের দর্পণ

ভারতীয় পূর্বাঞ্চলের প্রদেশ সমূহ : ভারত - বাংলাদেশ চলমান সম্পর্ক - ২

মেজর মোহাম্মদ এমদাদুল ইসলাম (অব.) | রবিবার , ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ at ১০:৫৭ পূর্বাহ্ণ

এই শিরোনামের উপর প্রথম কিস্তি প্রকাশিত হয় গত ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪। সেই লেখায় নাগাল্যান্ডের ওপর কিছুটা আলোকপাত করা হয়েছিল। আজ নাগাদের উপর আরো বেশ কিছু তথ্য উপাত্ত তুলে ধরে নাগাদের সশস্ত্র আন্দোলনের উপর আলোচনার প্রয়াস পেয়েছি। এ প্রসঙ্গে ন্যাশনাল সোশালিস্ট কাউন্সিল অব নাগাল্যান্ডের প্রত্যয়দীপ্ত ঘোষণা পত্রটির দিকে আমি পাঠকদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাই। এ ঘোষণা পত্রটি ১৯৮০ সালের ৩১ জানুয়ারী মূইভা, আইজাক সিসি সু, খাপলাঙ এর সম্মিলিত স্বাক্ষরে প্রচারিত হয়। ষোঘণা পত্রটির মূল সুর আর স্তম্ভগুলি ছিল

জাতীয় অস্থিত্ব : আমরা একথা অকুন্ঠ চিত্তে ঘোষণা করছি নাগা ভূমি সেটি যেখানেই হউক তার প্রতি ইঞ্চির উপর নাগাদের প্রশ্নবিহীন র্সা্বভৌম প্রতিষ্ঠিত থাকবে অন্য কারো নয়।

রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান : আমরা নিঃশঙ্ক চিত্তে দৃঢ়ভাবে জনগণের র্সা্বভৌমত্ব এবং জনগণের একছত্র আধিপত্যে এবং নাগা ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট কাউন্সিল এ গণতন্ত্র চর্চায় অঙ্গীকারাবদ্ধ।

অর্থনৈতিক ব্যবস্থা : আমরা সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠায় অতন্দ্র। কারণ সমাজতান্ত্রিক অর্থ ব্যবস্থাই মানুষের প্রতি মানুষের শোষণের অবসান ঘটিয়ে সাম্য প্রতিষ্ঠা করে।

ধর্ম : আমরা অবিচলিতভাবে স্রষ্টায় আস্থা স্থাপন করছি এবং যীশু খ্রীষ্টকে মানব মুক্তির উপলক্ষ হিসাবে ঘোষণা করছি, নাগাল্যান্ড খ্রীষ্টানদের জন্য। তবে অন্য ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হবে না। কারো ওপর কোনো ধরনের ধর্ম চাপিয়ে দেওয়া থেকে সবাইকে কঠোরভাবে নিবৃত্ত রাখা হবে।

উপরোক্ত ঘোষণা বাস্তবায়নের উপায় : শান্তিপূর্ণ উপায়ে নাগাদের অধিকার আদায়ের স্বপ্ন আমরা দেখিনা। একমাত্র অস্ত্র এবং অস্ত্রই আমাদের রক্ষা কবচ এবং আমাদের জনগনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করবে।

এর বাইরেও নাগা স্বাধীনতাকামীদের পুরোধা পুরুষ ড. ফিজো তার জাতিতাত্বিক ঘোষণায় উল্লেখ করেন “Nagas are not Indians, just as Indians are not Nagas” অর্থাৎ নাগারা যেমন ভারতীয় নয় তেমনি ভারতীয়রাও নাগা নয়। ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট ন্যাশনাল কাউন্সিল অব নাগাল্যান্ড এর ঘোষণাপত্রের “অস্ত্র এবং অস্ত্রই নাগাদের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে পারে” ড. ফিজোর দর্শন জাতিগত এই বৈপরীত্য এবং দূরত্বকে সামনে রেখে নাগারা নাগাল্যান্ডে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে ক্রমাগত যুদ্ধে রত থাকে।

নাগাদের এ প্রানপন সংগ্রামে ছেদ নামে ১৯৭১ সালে। উত্তর পূর্ব ভারত নিয়ে গবেষক এবং বিখ্যাত লেখক নির্মল নিবেদন তার বই “নর্থ ইস্ট ইন্ডিয়া দি ইথনিক এক্সপ্লোশন” এ উল্লেখ করেছেন The birth of Bangladesh crippled the Naga bases in that territory and profoundly affected the future raids of the Mizo’s. The leaders of the Mizo revolt barely escaped with their life and limb. …the Nagas lost the base forever after the conversion of East Pakistan into Bangladesh. অর্থাৎ বাংলাদেশের জন্ম এই অঞ্চলের নাগাদের ঘাঁটি গুলিকে যেমন বিপন্ন করে তেমনি ভারতের বিরুদ্ধে ভবিষ্যৎ মিজো আক্রমণকেও গভীরভাবে সংকটে ফেলে। পূর্ব পাকিস্তান বাংলাদেশ হওয়ার পর বিদ্রোহী মিজো নেতারা জানপ্রাণ নিয়ে পালিয়ে বাঁচে আর নাগারা চিরদিনের জন্য তাদের ঘাঁটি গাড়ার সুযোগ হারায়।

ভূকৌশল গত এ আমূল পরিবর্তনেও নাগারা তাদের লক্ষ্য অর্জনে দমে যায়নি। যদিও শিলং চুক্তির মাধ্যমে ১৯৭৫ সালে ভারতীয় সংবিধানের অধীনে নাগারা স্বতন্ত্র নাগাল্যান্ড অর্জন করে। এতদসত্তেও ১৯৯১ সালে এসে নাগারা পুনরায় স্বাধীনতার দাবিতে অস্ত্র হাতে তুলে নেয়। এ প্রেক্ষাপটে নাগা ন্যাশনাল কাউন্সিল (এন এন সি) যেমন “কাদাউ গ্রুপ” এবং “আধিনও গ্রুপ” এ দ্বিধা বিভক্ত হয় তেমনি ন্যাশনাল সোশালিস্ট কাউন্সিল অব নাগাল্যান্ড (এন এস সি এন)ও দ্বিধাবিভক্ত হয় এন এস সি এন (এম) এবং এন এস সি এন (খাফলাং) এ। নাগারা নানা দল উপদলে বিভক্ত হলেও তারা তাদের স্বাধীনতার দাবিতে নাগাল্যান্ডের বাইরে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেও নিজেদের দাবির কথা তুলে ধরতে সোচ্চার হয়।

২৭ জুলাই ১৯৯৩ জেনেভায় আর্ন্তজাতিক মানবাধিকার কমিশনের এক সভায় এন এস সি এন (এম) এর সভাপতি তার বক্তব্যে তিনি উল্লেখ করেন ৩০ লক্ষেরও অধিক নাগা যারা ১ লক্ষ স্কোয়ার কিলোমিটার জুড়ে ভারত এবং মায়ানমার সেনাবাহিনীর যাতাকলে জীবন যাপন করছে আমি তাদের কথা বলতে এই বিশ্ব সংস্থার সামনে হাজির হয়েছি। তিনি তার বক্তেব্যে উল্লেখ করেন :

Nagaland was never and is never a part of India nor that of Burma either by conquest or consent. The Indo-Naga issue is (thus) neither a question of separation nor seccssion from India but it is a case of resistance against invasion of Nagaland by India and Burma and a case of recognition of the inalienable right of the self-existance of the Naga people. অর্থাৎ নাগাল্যান্ড না অতীতে না বর্তমানে কখনোই না সম্মতিক্রমে বা বিজয়ের মাধ্যমে ভারত বা বার্মা’র অংশ ছিল। অতএব নাগাল্যান্ডের বিষয়টি ভারত বা বার্মার কাছ থেকে পৃথক বা বিচ্ছিন্ন হওয়ার বিষয় নয় বরং তাদের দ্বারা দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার বিষয় এবং নাগাদের আত্বনিয়ন্ত্রনের অলঙ্ঘনীয় অধিকারের স্বীকৃতির বিষয়। এ বিষয়টিকে সামনে রেখে সময়ে সময়ে নাগা স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী ভারতীয় নাগাল্যান্ড, মনিপুর, অরুনাচল এবং মায়নমার নাগা অধ্যূষিত অঞ্চল নিয়ে বৃহত্তর নাগাল্যান্ড গড়ার ডাক দিয়ে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে।

এন সি এন তাদের ঘোষণা পত্রে উল্লেখ করে :

No nation is ever rescued by high sounding empty slogans. It is arms that save a nation. We are revolutionary patriots; we shall hold on to our guns fast. He who lays down his gun, lays down his freedom. This is the Gospel truth about our politics. বাগাড়ম্বর আর বড় বড় শ্লোগানের মাধ্যমে কোন জাতি তার ঈপ্সিত লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হয়নি। অস্ত্রই কেবল একটি জাতিকে রক্ষা করে। আমরা দেশপ্রেমিক বিপ্লবী; আমরা আমাদের ঈপ্সিত অর্জনে অস্ত্র তুলে নেব। যে বা যারা অস্ত্র সমর্পণ করেছে তারা তাদের স্বাধীনতা বিসর্জন দিয়েছে। আমাদের রাজনীতিতে এটিই ধ্রুবসত্য। এ দ্রুব সত্যকে বুকে ধারণ করে নাগারা ক্রমাগত যুদ্ধ করে এসেছে। এ যুদ্ধে তাদের আত্মত্যাগ ইতিহাসে অনন্য এক দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। এখানে উল্লেখ্য শুরুতে নাগারা তাদের স্বাধীনতার আন্দোলন ভারতীয় র্পূ্বাঞ্চলে সীমাবদ্ধ রাখলেও পরবর্তীতে মায়ানমারের নাগা অধ্যূষিত অঞ্চলকেও তারা তাদের সংগ্রামে অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। আমার বিবেচনায় এ বিষয়টি ছিল নাগাদের জন্য কৌশলগত আত্মঘাতি এক সিদ্ধান্ত। নাগা আন্দোলনে মায়ানমারের নাগাদের অন্তর্ভুক্তির ফলে নাগারা মায়ানমারেরও রোষানলে পড়ে, ফলশ্রুতিতে নাগারা মায়ানমারে এ যাবতকালের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হারায়। শুধু আশ্রয়স্থল নয় বরং নাগারা ভারত এবং মায়ানমারের যৌথ সামরিক অভিযানেরও শিকারে পরিণত হয়। ২০১৬ সালে ভারতীয় সামরিক বাহিনী এবং মায়ানমারের সামরিক বাহিনীর নাগাদের বিরুদ্ধে যৌথ র্সাজিক্যাল অপারেশন তারই প্রমাণ।এতসব কিছুর পরও নাগারা তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নে সশস্ত্র আন্দোলনে কখনো স্তিমিত হলেও তা পুনরায় আরো শক্তি সঞ্চয়ের মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে আঘাত করেছে নতুন উৎসাহে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী নাগাদের এতদঞ্চলে ঘাঁটি হারানো আর কৌশলগত ভুলে মায়ানমারের সাথে বৈরীতা দুটিই নাগাদের প্রতিকূলে গেছে এবং ভারতের অনূকুলে। ভারত বাংলাদেশ এবং মায়ানমারের নাগাদের বিরুদ্ধে তার জন্য সৃষ্ট অনুকূল হাওয়ায় বসে তার র্পূ্বাঞ্চলের জন্য কৌশল প্রনয়ন করেছে। এই কৌশলের মূল কেন্দ্র নাগাদের হারানো আশ্রয় যেন তারা আর কোন অবস্থায় ফিরে না পায়। এ লক্ষ্য অর্জনে ভারত যেমন মিজো নাগাদের উপর কঠোর নজরদারী করে এসেছে তেমনি আমাদের র্পা্বত্যাঞ্চলের ওপরও তার শ্যেন দৃষ্টি রেখেছে। একই সাথে বাংলাদেশ সরকারের সাথেও একটি বোঝাপরার সর্ম্পক ভারত বজায় রাখতে সচেষ্ট থেকেছে। এ বোঝা পরায় যখনই কোন ধরনের অস্বস্থির সৃষ্টি হয়েছে তখনই ভারতকে তা তার পূর্বাঞ্চলকে নিয়ে শংকায় ফেলেছে। অবস্থা দৃষ্টে মনে হয় বাংলাদেশ ভারতের বর্তমান চলমান সম্পর্ক তেমনই একটি অবস্থায় উপনীত। (চলবে)

লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট; সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধদূরের দুরবিনে