পাশ্চাত্য তথা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের মাঝে ১৯৪৭ এ ট্রুম্যান ডকট্রিন এর বদৌলতে শুরু হওয়া স্নায়ূ যুদ্ধ ১৯৯১ সালে সমাপ্তি ঘটে। এই স্নায়ূযুদ্ধ মানব জাতির ইতিহাসে কী লজ্জার ক্ষত চিহ্ন রেখে গেছে তা জার্মানী সফরে গিয়ে আমি হাড়ে হাড়ে উপলব্দি করেছি। বার্লিন শহরের মাঝ বরাবর সু–উচ্চ দেওয়াল। দেওয়ালের এ পাড়ের মানুষ ওপাড়ের মানুষকে দেখে না অথচ এরা একই জার্মান বংশোদ্ভুত, একই আত্মীয়তা বন্ধনে আবদ্ধ। স্নায়ূযুদ্ধের নির্মমতার বিচ্ছিন্নতার দেওয়াল মানুষকে এভাবেই তার আপনজন থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল।
স্নায়ূযুদ্ধ অবসানের পর ফ্রান্সিস ফুকুমাইয়ার মত রাজনৈতিক তত্ত্ববিদ–আশাবাদী মনীষীদের ধারনা ছিল এতদিনের দ্বিধাবিভক্ত পৃথিবী পারস্পরিক দ্বন্দ্ব সংঘর্ষ পরিহার করে বিশ্ব হয়ে একই ছায়াতলে দাঁড়াবে। ফুকুমাইয়ার মত আরো অনেকের আশা ছিল একবিংশ শতাব্দীর পৃথিবী হবে শান্তির একটি এককেন্দ্রীক বলয়। এই শতাব্দী মানুষের জন্য বয়ে আনবে শান্তি আর সমৃদ্ধির অমিয় ধারা।
আশাবাদী মানুষদের সব আশাকে নিরাশার অমানিশায় ডুবিয়ে ১১ সেপ্টেম্বর ২০০১ আল কায়দার আমেরিকার টুইন টাওয়ার আক্রমণের মাধ্যমে বিশ্বে নতুন করে সংঘাত সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। এ সংঘাত তার বিস্তৃতি আর প্রকারভেদে কখনো আন্তঃরাষ্ট্রীয়, কখনো রাষ্ট্র অভ্যন্তরে, কখনো ‘ওয়ার অন টেরর’ কখনো বহুজাতি সম্পৃক্ততায় ‘ডের্জাট স্ট্রম’ কখনো ‘আরব বসন্ত’ ইত্যাদি নামে।
ঐসব যুদ্ধে লক্ষ মানুষের বেঘোরে জীবন গিয়েছে। ধ্বংস হয়েছে দেশে দেশে অজস্র স্থাপনা, বিরান হয়েছে জনপদের পর জনপদ। তবুও মানুষ মুখ ফিরায়নি যুদ্ধ থেকে। যুদ্ধ আসলে মানুষের প্রতি মানুষের অপমান। একবিংশ শতাব্দীর সভ্যতাদর্পী মানুষ, মানুষ মারার জন্য মানুষকে প্রশিক্ষিত করছে, মারণাস্ত্র তৈরী করছে, মানুষকে শিক্ষা, চিকিৎসা, খাদ্য, আশ্রয় বঞ্চিত করে যুদ্ধের পিছনে অর্থ বিনিয়োগ করছে। এ লজ্জার। এ নিদারুন বর্বরতা। মানুষের এই উন্মত্ততা আদিমতাকেও হার মানায়। আদিম মানুষরা হানাহানিতে লিপ্ত হলেও অন্যকে বঞ্চিত করে সে হানাহানি কখনো আয়োজিত হয়নি। তারা নিজ নিজ শক্তিতে লড়েছে। অন্যকে বঞ্চিত করে আদিমরা কখনো সংঘাতে জড়ায়নি।
অথচ আমরা যদি পৃথিবীর গত শতাব্দী এবং চলমান এই শতাব্দীর কিছু কিছু যুদ্ধের দিকে নজর দিই তা হলে বুঝব মানুষ মানুষের প্রতি কী নির্মম ভয়াবহ আচরণ করেছে।
১৯১৪ থেকে ১৯১৮ তে শেষ হওয়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ৪ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল, এর মাঝে প্রায় ২ কোটি সামরিক, বাকীরা বেসামরিক মানুষ। অজস্র মানুষের এই মৃত্যু– দুর্ভোগ বিশ্ব নেতারা বিশেষ করে ইউরোপিয়রা অচিরেই ভুলে যায়। তারা এই প্রথম বিশ্ব যুদ্ধ থেকে আরো ভয়াবহ এবং বিশাল ব্যাপ্তিতে দ্বিতীয় বিশ্ব–যুদ্ধে নিজেদের জড়িয়ে ফেলে। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের ভয়াবহতার ভয়াল রূপ পৃথিবীর মানুষ অসহায় হয়ে কেবল দেখেছে। ১৯৩৯ এ শুরু হয়ে ১৯৪৫ এ শেষ হওয়া এই যুদ্ধে ৭ কোটি ৫০ লক্ষ মানুষ নিহত হয়। এর মাঝে ২ কোটি সামরিক আর বাকীরা বেসামরিক। বেসামরিকদের অনেকেই ক্ষুধা আর গণহত্যার শিকারে পরিণত হয়ে, এর মাঝে কত অবুঝ শিশু আর মায়েরা ছিল তা ভাবলেও গা শিউরে উঠে। দ্বিতীয় বিশ্ব–যুদ্ধের শেষ প্রান্তে এসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাপানের নাগাসাকি এবং হিরোশিমা’য় পারমাণবিক বোমাবর্ষণ এবং তার ভয়াহতা পৃথিবীর মানুষ কখনো ভুলতে পারবে বলে মনে হয়নি। তখনকার মানুষের এধারনা এখনকার মানুষেরা ভুল প্রমাণ করেছে অবলীলায়। যুদ্ধ থেমে থাকেনি। যুদ্ধের বিভীষিকায় জ্বলেছে ভিয়েৎনাম, উত্তর–দক্ষিণ কোরিয়া, কাম্বোডিয়া। আমেরিকান সিভিল ওয়ার, চাইনীজ সিভিল ওয়ার, রাশিয়ান সিভিল ওয়ার, ইউরোপে তিরিশ বছরব্যাপী যুদ্ধ ইত্যাদিতে মানুষের প্রতি মানুষের নির্মমতা–নৃশংসতা মানুষ ভুলেছে অবলীলায়। সাম্প্রতিকের ইরান– ইরাক, ইরাকের উপর ডেজার্ট স্ট্রম নাম দিয়ে আমেরিকার নেতৃত্বে ধ্বংস লীলা, আফগানিস্তানে দীর্ঘ ২০ বছর ব্যাপী পাশ্চাত্যের চালানো নির্মম আক্রমণ, তিউনিসিয়া, সিরিয়া, লিবিয়ার উপর আরব বসন্তের নামে বর্বরতা, ইয়েমেন যুদ্ধ – সভ্যতাদর্পী পাশ্চাত্যের সামনে যুদ্ধের ফলশ্রুতি দুর্ভিক্ষের নির্মম আঘাতে লক্ষ মানুষের মৃত্যু এ পৃথিবীর দৃশ্যপটে একের পর এক ঘটেছে।
এরই মাঝে ইসরাইল পরিচালিত গাজায় চলমান গণহত্যা আগামী প্রজন্মের মানুষকে নিঃসন্দেহে ভাবাবে, মানুষের প্রতি মানুষের নির্মম বর্বরতার এইসব কাহিনী মানুষকে লজ্জিত করবে।
শিরোনামের সম্ভাবনা নিয়ে এবার বিস্তৃত আলোচনায় আসি।
২০১৪ সালে ইউক্রেনে রাশিয়া বিরোধী আন্দোলন ‘ডিগনিটি’র ফলশ্রুতিতে রুশ পন্থি’ সরকারের পতন এবং ইউক্রেন বর্ডারে ন্যাটো পরিচালিত সামরিক মহড়া ‘ডিফেনন্ডিং ইউরোপ’ এর প্রতিক্রিয়ায় রাশিয়া ক্রিমিয়া দখল করে নেয়। পরবর্তীতে রাশিয়ার উদ্যোগে ক্রিমিয়ায় অনুষ্ঠিত এক গণভোটের মাধ্যমে ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার অংশ করে নেওয়া হয়। এরই মাঝে ন্যাটোর রাশিয়াকে বিবেচনায় রেখে পূর্বমুখী নানা উস্কানিমূলক তৎপরতা রাশিয়াকে ইউক্রেনে অভিযান পরিচালনায় অনেকটা বাধ্য করে। রাশিয়াকে এ যুদ্ধে জড়ানোর পিছনে ন্যাটো তথা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ একটি উদ্দেশ্য হয়ত কাজ করে থাকতে পারে। এ উদ্দেশ্য হল ৯০ এর দশকে যেভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নকে আফগান যুদ্ধে জড়িয়ে তাকে দুর্বল করা হয়েছিল এবং পরর্বতীতে পতন ঘটানো হয়েছিল ঠিক একই কায়দায় বর্তমান রাশিয়াকে কাবু করা। পুতিনের হিসেবে এ বিষয়টি নিঃশ্চয়ই আছে।
এতদসত্ত্বেও ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ রাশিয়া ইউক্রেনে বিশেষ সামরিক অভিযান পরিচালনার শুরু করে। এ যুদ্ধের সময়কাল বর্তমানে ২ বছর পেরিয়ে গেছে। ইতিমধ্যে রাশিয়া ইউক্রেনের প্রায় ১৮ শতাংশ ভূমি দখলে নিয়েছে। ন্যাটো তথা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানী, ফ্রান্স, পোল্যান্ড, নদোরল্যন্ড এবং বৃটেন র্স্বোতভাবে ইউক্রেনকে সামরিক এবং আর্থিক সহায়তা প্রদান করে যাচ্ছে। পাশাপাশি পশ্চিমারা রাশিয়ার উপর নানা অর্থনৈতিক অবরোধও আরোপ করে চলেছে। তবে এসব অর্থনৈতিক অবরোধ রাশিয়াকে খুব একটা কাবু করেছে বলে মনে হয় না। যুদ্ধের মাঠেও রাশিয়ার সাফল্য পশ্চিমাদের মাঝে ইউরোপের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা শংকার জন্ম দিয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে ইউক্রেনিয় প্রেসিডেন্ট জেলেনেস্কির পশ্চিমাদের কাছে দীর্ঘদিনের চাওয়া দূর পাল্লার কামান, কার্যকরী আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, এবং যুদ্ধ বিমান ইত্যাদি ইউক্রেনকে সরবরাহ করা হয়েছে। এই সরবরাহের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এযাবৎ ইউক্রেনকে তার সরবরাহকৃত অস্ত্রের মাধ্যমে রাশিয়ার অভ্যন্তরে কোনো ধরনের হামলার উপর যে নিষেধাজ্ঞা ছিল তা প্রত্যাহার করে নেয়।
বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট পুতিন ঘোষণা করেন ‘রাশিয়ার অস্থিত্বের উপর যে কোনো হামলা মোকাবেলা করতে তার অস্ত্র ভাণ্ডারে যা কিছু আছে তা ব্যবহার করতে তারা পিছপা হবে না’। এরই মাঝে প্রয়োজনে রাশিয়ানরা পারমানবিক অস্ত্র ব্যবহারের সম্ভাবনার কথাও জানিয়ে দেয়। শুধু জানানোর মাঝে রাশিয়নরা থেমে থাকেনি তারা পারমাণবিক অস্ত্রের নিয়োজনে দুটি ড্রিল তথা মহড়ার কাজও সম্পন্ন করে রেখেছে। রাশিয়া তার মিত্র বেলারুশেও পারমাণবিক অস্ত্রের সমাবেশ ইতিমধ্যে সম্পন্ন করে রেখেছে। রাশিয়া ভবিষ্যৎ এর যুদ্ধ পরিকল্পনা মাথায় রেখে উত্তর কোরিয়ার সাথে একটি সামরিক সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এই চুক্তিতে বলা হয়েছে একদেশ আক্রান্ত হলে অন্যদেশ তার সাহয্যে এগিয়ে যাবে। চীনের সাথেও রাশিয়া ‘সীমাহীন বন্ধুত্বের’ সর্ম্পকে আবদ্ধ। ইরান রাশিয়াকে তার হাজারো ড্রোন সরবরাহ করে চলেছে। পুতিন গত সপ্তাহে সবাইকে চমকে দিয়ে আজারবাইজানও সফর করে এসেছেন এবং নিঃসন্দেহে বাকুকে তার পাশে পাওয়ার ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করে এসেছেন।
ইতিমধ্যে ৬ আগস্ট ২০২৪ ইউক্রেনীয় সৈন্যরা, রাশিয়ার জন্য অপ্রত্যাশিতভাবে রাশিয়ার ‘কুরস্ক’ অঞ্চলের প্রায় ৪০ মাইল অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ে। এ যেন ‘রাশিয়ান ভালুক’ কে খোঁচা দেওয়ার মত। রাশিয়ার জন্য নিঃশ্চিতভাবে এটি অপমানজনক। এরই প্রতিক্রিয়ায় রাশিয়া কিয়েভের উপর তার আক্রমন তীব্র করে তোলে। সংকট ঘনীভূত করার উপলক্ষ হিসাবে ইউক্রেন ড্রোন এবং দূর পাল্লার কামান ব্যবহার করে কুরস্ক অঞ্চলের তিনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্রিজ ধ্বংস করেছে। বলাবাহুল্য এ দূর পাল্লার কামান পাশ্চাত্য ইউক্রেনকে সরবরাহ করেছে। এর বাইরে নেদারল্যান্ড থেকে ইউক্রেন ইতিমধ্যে ১৬টি এফ সিক্সটিন অত্যাধুনিক যুদ্ধ বিমান পেয়েছে।
এসব বিবেচনায় নিয়ে রাশিয়া তার পূর্ব্বাঞ্চল থেকে তাদের স্পেশাল ইউনিট গুলিকে ফ্রন্ট লাইনে আনা শুরু করেছে।
ন্যাটো তথা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি ক্রমাগত তার দূরপাল্লার অস্ত্র সমূহ ইউক্রেনকে সরবরাহ করে তবে একথা নিঃশ্চিতভাবে বলতে পারি পৃথিবী পারমাণবিক যুদ্ধের র্স্বনাশা এক পথে হাঁটা শুরু করেছে। আর এ যুদ্ধ শুরু হলে দীর্ঘদিন পারমাণবিক যুদ্ধের ওপর গবেষণারত এ্যানি জ্যাকভশনের মতে পারমাণবিক যুদ্ধের প্রথম ৭২ মিনিটে পৃথিবীর ৬০ শতাংশ মানুষের মৃত্যু ঘটবে। পরিতাপের এবং শংকার বিষয় এ যুদ্ধ শুরুর বোতাম টিপবেন মাত্র একজন মানুষ।
লেখক: প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট; সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক।