গাজায় গণহত্যার প্রায় এক বছর হতে চলেছে। কিন্ত্তু এ হত্যাকাণ্ড বন্ধের লোক দেখানো কোন উদ্যোগই এ পর্যন্ত সফল হয়নি। ৭ অক্টোবর ২০২৩ এ হামাসের ইসরাইলীদের ওপর পরিচালিত আক্রমণের অজুহাতে এ যাবত ৪০,০০০(চল্লিশ হাজার) এর বেশি মানুষকে গাজায় ইসরাইল হত্যা করেছে। ধ্বংসস্ত্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছে আরো বহু হাজার। আহত লক্ষাধিক। গাজার মানুষের সব মানবাধিকার আজ ভূলুণ্ঠিত। গাজায় এখন খাদ্যের জন্য, পানীয়ের জন্য, চিকিৎসার জন্য, ঔষধের জন্য, আশ্রয়ের জন্য নিত্য হাহাকার। এরই মধ্যে গাজার মানুষদের তিন থেকে চারবার নিজেদের আশ্রয়স্থল পরির্বতন করে নতুন আশ্রয়স্থলে যেতে হয়েছে। এটি ইসরাইলী সেনাবাহিনীর আদেশে। পৃথিবীর সভ্যতাধর্পী শক্তিধর দেশগুলি নির্বিকার। আরব দেশগুলি চোখ বুঝে আছে। আন্তর্জাতিক আদালত রায় দিয়েছে কিন্ত্তু রায় কার্যকরণে অসহায়। সেখানে এখন আলো নাই, শিক্ষা নাই, চলাচলের স্বাধীনতা নাই। মায়েরা সন্তান জন্ম দিয়ে নিহত সেই সন্তানকে আবার কবরও দিচ্ছেন, বলা হয় গাজার মানুষেরা এখন প্রতিদিন ছয় ওয়াক্ত নামাজ আদায় করেন। দৈনিক ফরজ পাঁচ ওয়াক্ত আর আরেক ওয়াক্ত জানাজা। কী নির্মম, কী অমানবিক!
ইসমাইল হানিয়া, হামাসের প্রধান। হানিয়ার জন্ম গাজার উদ্বাস্ত্তু শিবিরে। পড়া লেখা গাজা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৮৭ সালে প্রথম ফিলিস্তিনি ইন্তেফাদা’র সময় তিনি হামাসে যোগ দেন। হানিয়া ছিলেন হামাসের প্রতিষ্ঠাতা শেখ আহাম্মদ ইয়াসিন’এর ভাবশিষ্য। গত ১০ এপ্রিল গাজায় ইসরাইলী হামলায় তার তিন ছেলে হাজেম, আমির, মোহম্মদ এবং এরও পূর্বে আরো এক ছেলে তিন মেয়ে আর চার নাতি শহীদ হন। ইসমাইল হানিয়া গাজায় যুদ্ধ বিরতি চুক্তি সম্পাদনে হামাসের পক্ষে প্রধান আলোচক। এ উদ্দেশ্যে আজ দোহা কাল কায়রো করে সাম্প্রতিক সময়ে উড়ে বেরিয়েছেন। কাতার ইউনির্ভাসিটির ফিলিস্তিন বিষয়ক বিশেষজ্ঞ আদিব জিয়াদেহ হানিয়া সম্পর্কে বলেছেন “ তিনি আরব সরকার গুলির সাথে হামাসের রাজনৈতিক যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছেন, তিনি হামাসের একই সঙ্গে রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক ফ্রন্ট”। ৩০ জুলাই ২০২৪ ইসমাইল হানিয়া ইরানের নব নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মাসুদ সেজেশকিয়ান’এর দায়িত্ব গ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগদান শেষে তেহরানের উত্তরাঞ্চলে রাষ্ট্রীয় অথিতি ভবনে অবস্থান করছিলেন। এখানেই ৩০ জুলাই দিবাগত রাত দু’টায় ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে তাকে হত্যা করা হয়। হত্যাকান্ডটি ইসরাইল দ্বারা সংগঠিত এটি বিশ্ববাসী নিশ্চিত। মৃত্যুকালে হানিয়ার বয়স হয়েছিল ৬২ বছর। তেহরানে হানিয়া হত্যাকাণ্ডের একদিন আগে লেবাননের রাজধানী বৈরুতে একই ধরনের আক্রমণের মাধ্যমে হিজবুল্লাহ’র শীর্ষ সামরিক নেতা ফুয়াদ শোকর’কেও ইসরাইলীরা হত্যা করে। ফুয়াদ শোকর হিজবুল্লাহ’র শীর্ষ নেতা হাসান নসরুল্লাহ’র সামরিক উপদেষ্টা হিসাবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। ইসরাইলীরা শোকর’কে সম্প্রতি ইসরাইল দখলীকৃত গোলান হাইটে এক রকেট হামলায় ১২ ইসরাইলী কিশোর নিহত হওয়ার জন্য দায়ী করে আসছিল।
১ এপ্রিল ২০২৪ ইসরাইল দামেক্সসে ইরানের কনস্যুলেট আক্রমণ করে। সেই আক্রমণে ইরানের ইসলামী রেভ্যুলুশনারী গার্ডের কুদস ব্রিগেডের দুজন গুরুত্বপূর্ণ কমান্ডার জেনারেল মোহাম্মদ রেজা জাহেদি এবং তার ডেপুটি জেনারেল মোহাম্মদ হাদিসহ সাতজন সেনা সদস্য নিহত হন।
১ আগস্ট ২০২৪ ইসরাইলী সেনাবাহিনী সূত্র নিশ্চিত করেছে তারা ১৩ জুলাই এক আক্রমণে হামাসের সামরিক কমান্ডার মোহাম্মদ দায়েফ’কে ও হত্যা করেছে। ইতিপূর্বে ৩ জানুয়ারি ২০২০ সালে ইরাকের বাগদাদ আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে ইরানিয়ান গার্ড রেজিমেন্টের শীর্ষ কমান্ডার জেনারেল কাসেম সোলায়মানী’কে মিসাইল আক্রমণের মাধ্যমে হত্যা করা হয়।
এটি বলার অপেক্ষা রাখে না, বাগদাদ, বৈরুত এবং সর্বশেষ তেহরান প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসরাইল আন্তর্জাতিক সমস্ত রীতিনীতি ভঙ্গ করে অন্যদেশের র্সা্বভৌমত্বের উপর আঘাত হেনেছে। এবং এ কাজে ইসরাইলকে দুর্বিনীত দুঃসাহসী করেছে পাশ্চাত্যের অকুণ্ঠ সমর্থন। এখন এটি স্পষ্ট ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু তার ক্ষমতায় থাকাকে দীর্ঘায়িত করার জন্য গাজায় যুদ্ধ বিরতি চায় না, ইসমাইল হানিয়া যিনি হামাসের পক্ষ হয়ে যুদ্ধ বিরতির প্রধান আলোচক তাকে হত্যার মাধ্যমে একথা দিবালোকের মত আরো পরিষ্কার।
ইসমাইল হানিয়ার হত্যাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়ায় মধ্যপ্রাচ্যে এখন নানা পক্ষের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া অনেকটা নিশ্চিত। ইরানের জন্য বিষয়টি আরো অবশ্যম্ভাবী। এর কারণ হানিয়া নিহত হয়েছেন তেহরানে, যখন তিনি রাষ্ট্রীয় অতিথি। মধ্যপ্রাচ্য এবং দুনিয়ায় ইরান একটি শক্তিধর দেশ হিসাবে স্বীকৃত। ইরান একথা ভুলে থাকবে না। ইরান অতিথি, আত্মমর্যাদা এবং র্সা্বভৌমত্বের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে ইসরাইলে আঘাত হানবে এটি নিশ্চিত। ইরান এ পদক্ষেপ নিলে ইতিমধ্যে ইসরাইলকে হুমকি দেওয়া তুর্কিরাও নিশ্চুপ থাকবে তা মনে হয় না। ইরান প্রতিশোধ পরায়ন হলে তার প্রক্সি হুতি এবং হামাস যারা ইতিমধ্যেই ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত আছে তারা আরো সক্রিয় হবে। ইরাকের ইসলামী রেসিসটিন্স গ্রুপ, সিরিয়ার সৈন্যবাহিনীও নিশ্চুপ বসে থাকবে না। তবে ইরানের হয়ে এ মুহূর্তে ইসরাইলের বিরুদ্ধে সবচেয়ে কার্যকর এবং উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হিজবুল্লাহ। হিজবুল্লাহ সম্প্রতি পরপর তাদের বেশ কয়েকজন কমান্ডার ইসরাইলের হাতে নিহত হওয়াতে এমনিতেই ইসরাইলের প্রতি প্রতিশোধ গ্রহণের স্পৃহায় মত্ত। এ প্রেক্ষাপটে হিজবুল্লাহ’র ব্যাপারে পাঠকদের কিছু ধারণা দেওয়া প্রয়োজনবোধ করি।
হিজবুল্লাহ বা “পার্টি অব গড” যার সহজ বাংলা স্রষ্টার দল। এ দল ৮০’র দশকে যখন ইসরাইলী আগ্রাসনে লেবানন টালমাটাল তখন তার প্রতিবাদে জন্ম নেয়। ইসরাইলের লেবাননের উপর দখলদারিত্বের অবসান ঘটানোর লক্ষ্যেই মূলত হিজবুল্লার জন্ম। ইমাদ মুগনিয়া, হাসান নসরূল্লাহ এবং আব্বাস আল মুসাভি হিজবুল্লাহ গঠনের মূল কারিগর। তাদের অনুপ্রেরণার কেন্দ্রস্থল হল ইরানে আয়াতুল্লা খোমেনির নেতৃত্বে ইসলামী বিপ্লব। গঠনের পর থেকে দলটি ইরানের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের মাধ্যমে তার ব্যাপ্তি এবং শক্তি অর্জনে সক্ষম হয়।
সামরিক বিশেষজ্ঞদের ধারনা হিজবুল্লাহর বর্তমান সামরিক সদস্য ১০০০০০(এক লক্ষ)। এরা যেমন সুপ্রশিক্ষিত তেমনি সুসংগঠিতও। বলা হয়ে থাকে বিশ্বে বর্তমানে বিভিন্ন সরকারি বাহিনীর বাইরে হিজবুল্লাহ’র মত এত শক্তিশালী এবং সুশৃংখল সামরিক বাহিনী আর দ্বিতীয়টি নেই। ইসরাইলী এবং মার্কিন গোয়েন্দা সূত্রের তথ্য অনুযায়ী হিজবুল্লাহ’র বর্তমানে শুধু মিসাইল মওজুদই রয়েছে প্রায় ১৫০০০০(দেড় লক্ষ) ।
সম্প্রতি সারা বিশ্বের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার বিস্ময় ইসরাইলী আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এ্যারো ২, এ্যারো ৩, আমেরিকান প্যাট্রিয়ট আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, ডেভিট স্লিং নামক আকাশ প্রতিরক্ষা সর্ব্বোপরি নিশ্চিদ্র “আয়রন ডোম” এর যাবতীয় সুরক্ষার অনিশ্চিদ্রতাকে ভুল প্রমাণিত করে হিজবুল্লাহ ইসরাইলের উত্তরাঞ্চলে কার্যকরী আঘাত হানতে সক্ষম হয়। এতে করে পুরা পাশ্চাত্য নড়েচড়ে বসে।
শুধু আয়রন ডোম নয় ইসরাইলের আকাশ প্রতিরক্ষার যাবতীয় ব্যবস্থাকে ফাঁকি দিয়ে হিজবুল্লাহ’র ড্রোন হাইফা বন্দর, ইসরাইল অধিকৃত গোলান হাইট সহ যাবতীয় সামরিক বেসামরিক স্থাপনার ছবি নিখুঁতভাবে তুলে আনতে সক্ষম হয়। হিজবুল্লাহ’র ড্রোন কর্তৃক ধারণকৃত ভিডিও চিত্র বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হতে থাকলে তা ইসরাইলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ইতিপূর্বের সব বড়াই নিঃসাড় প্রমাণিত করে। এ ঘটনা ওয়াশিংটনকেও দারুণ দুশ্চিন্তা এবং শঙ্কিত করে তোলে। কারণ এর ফলে আমেরিকার কলারাডো এবং গোলান হাইটে বসে ০০১ ইসরাইল–আমেরিকা গোয়েন্দা সহায়তা/সহযোগিতা ইত্যাদি প্রশ্নের মুখে পড়ে গেছে। এ প্রেক্ষাপটে আমেরিকা হিজবুল্লাহ’র উপর এই মুহূর্তে ইসরাইলী আক্রমণের বিরুদ্ধে। ইসরাইল এ বিষয়টি টের পেয়ে সপ্তাহ কয়েক আগে তার প্রতিরক্ষা মন্ত্রী, সামরিক বাহিনী প্রধান এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টাকে ওয়াশিংটন পাঠায়। উদ্দেশ্য সম্ভাব্য হিজুবুল্লাহ–ইসরাইল যুদ্ধের ব্যাপারে ওয়াশিংটনের মনোভাব বুঝা এবং সামরিক সাহায্যের বিষয়টি নিশ্চিত করা। ৩১ জুলাই ইসমাইল হানিয়ার হত্যাকাণ্ড সম্ভবত মধ্যপ্রচ্যের চলমান সব হিসাব নিকাশকে ওলটপালট করে দিয়েছে।
ব্রাজিল, ইন্দোনেশিয়া, রাশিয়া, চীন, আলজেরিয়াসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ইসমাইল হানিয়ার হত্যাকাণ্ডকে বর্বরোচিত বলে আখ্যায়িত করেছেন। জাপান এই ঘটনায় মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাত মাথা চারা দিয়ে উঠবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
বিশ্বের বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের খবর অনুযায়ী ইরানী সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনী ইতিমধ্যে ইসমাইল হানিয়ার হত্যাকণ্ডের প্রতিশোধ গ্রহণে ইরানী বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানা যায়। এখন দেখার বিষয় এ প্রতিশোধের ধরন, তীব্রতা আর কারা কারা এতে জড়িয়ে পড়ছে।
তবে শেষ কথা হল এ হানাহানি মধ্যপ্রাচ্যের মানুষের জন্য যেমন আরো আরো দুর্ভোগ বয়ে আনবে তেমনি বিশ্বকে করবে আরো সংঘাত মুখর।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট; সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক।