সমকালের দর্পণ

দুর্নীতির আত্ম-অনুসন্ধান

মেজর মোহাম্মদ এমদাদুল ইসলাম (অব.) | রবিবার , ৭ জুলাই, ২০২৪ at ৮:৩৯ পূর্বাহ্ণ

সম্প্রতি আমাদের সব আলোচনায় দুর্নীতি বিষয়টি প্রাধান্য পাচ্ছে। চায়ের দোকানে ঝড়। পত্র পত্রিকা, টিভি টক শো সবখানে প্রধান আলোচ্য মতিউরের ছাগল কাণ্ড। এমনকি আমাদের মহান জাতীয় সংসদেও একজন সাংসদকে সোচ্চার কন্ঠে বলতে শোনা যায় আমরা যা পারিনি অর্থাৎ সংসদ যা পারেনি একটি ছাগল তা পেরেছে। এটি যেমন জাতি হিসেবে আমাদেও চরম লজ্জায় ফেলেছে তেমনি এটি একটি জাতির জন্য শুভ লক্ষণও। কারণ সাধারণ মানুষ যারা দুর্নীতির শিকার তারা এ আলোচনা সমালোচনা থেকে পরিত্রাণের একটি আশাও দেখছেন। এখন এমনই অবস্থা যারা দুর্নীতিতে নিমজ্জিত তারা দায়বদ্ধতার জালে আটকানোর ভয়ে, আর যাদের কর্তৃত্বে রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছে তাদেরও সচেতন হবার, জবাবদিহিতার একটি সময় সমানে উপস্থিত।

প্রথম একটি জাতীয় দৈনিকে পুলিশের প্রাক্তন আ ই জি পি জনাব বে নজীরের নজীর বিহীন দ্রুততম সময়ে বিপুল সম্পদ অর্জনের বিষয়টি সামনে আসে। এর পর পর আসে ঢাকা মেট্রোপলিটান পুলিশের এক সময়ের কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়া’র আলাউদ্দিনের দৈত্যের চেরাগ ঘষে সম্পদ অর্জনের কাহিনী। এসব যেতে না যেতে মতিউরের ছাগল বেঁ বেঁ করে দুর্নীতিতে নিমজ্জিতদের আরো অনেক নাম আসার ঘোষণা পাঠ করে।

এখন প্রশ্ন বেনজীরের কর্মকাণ্ড কি বেনজীর একদিনে ঘটিয়েছেন নাকি বেনজীর বছরের পর বছর ধরে এ কীর্তি সৌধ গড়ে তুলেছেন। উত্তর নিশ্চিতভাবে এটি অনেক দিন ধরে চলমান একটি প্রক্রিয়ার বহিঃপ্রকাশ মাত্র। এই যদি হয় তবে ধরে নিতে হবে বেনজীর এমন একটি নিশ্চয়তার মধ্যে বাস করছিলেন যে, তাকে কোনদিন তার অপর্কমের জন্য জবাবদিহি করতে হবে না। অন্যদিকে যারা বেনজীরের কর্মকাণ্ডের উপর নজর রাখছিলেন তারা হয়ত দেখেও না দেখার ভান করেছেন অথবা দেখলেও কিছু করার নাই মনোভাব নিয়ে চলেছেন। এটা যারাই অর্থাৎ এই সর্ব্বগ্রাসী দুর্নীতিতে জড়িয়েছেন সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। সেটা মতিউর হউক আর আসাদুল হউক।

দুর্নীতির করাল ছায়ায় বসে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার উপর আজ যে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারে, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা কি আমাদের শিক্ষার্থীদের এমন কোনো প্রণোদনায় উজ্জীবিত করছে যেখানে তাদের মনস্তত্বে অবৈধ বা দুর্নীতির বিরুদ্ধে স্বাভাবিক একটি ঘৃণার জন্ম হয়? আমার মনে হয় এ বিষয়ে এখনই আমাদের ভাবার সময় এসেছে। এখানে স্কুল পাঠ্যের চীনের একটি উদাহরণ প্রণিধানযোগ্য। অনেকদিন আগে পড়া বৃটেনে জন্ম গ্রহণকারী আমেরিকার ফ্রি ল্যান্স সাংবাদিক ফেলিক্স গ্রীন’এর চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের পরপর লেখা বই “দি ওয়াল হ্যাজ টু সাইডস” এর একটি বিষয় উল্লেখ করছি। বইটির এক অধ্যায়ে লেখকের সাথে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের কথোপকথনের বিষয়টি তুলে ধরা হয়।

সাংবাদিক ফেলিক্স এক ফুটফুটে ছাত্রীর কাছ থেকে একটি পেন্সিল হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করেন “এটি কার পেন্সিল?”

মেয়েটির উত্তর “আমাদের!”

ফেলিক্স কিছুটা আশ্চর্যান্বিত হয়ে ভাবেন মেয়েটি হয়ত ঠিকমত প্রশ্ন না বুঝে ভুল উত্তর দিয়েছে।

ফেলিক্স এবার কয়েক বেঞ্চ পর এক শিক্ষার্থী ছাত্রের কাছ থেকে একটি বই চেয়ে নেন। ঐ ছাত্রকে ফেলিক্স জিজ্ঞেস করেন, “বইটি কার ?”

ছাত্রটির উত্তর “আমাদের”। এবার ফেলিক্সের বিস্ময়ের পালা।

এ ঘটনার পর ফেলিক্সের অভিমত, চীন ভিতর থেকে বদলে যাচ্ছে, এবং ইতিবাচক পথে। ফেলিক্সের এ অভিমতকে সে সময় পূঁজিবাদী বিশ্বের অনেক বরেন্য জন কঠোর সমালোচনায় বিদ্ধ করেছিলেন। আমরা আজ কি দেখছি, চীন অর্থনৈতিক বিনিমাণে, সামরিক শক্তিতে সবক্ষেত্রে এক বিস্ময়ের নাম।

UBUNTU “উবান্তু” দক্ষিণ আফ্রিকার “জাসুয়া” জনগোষ্ঠীর মাঝে বিদ্যমান সাম্য সম্প্রীতি সৌহার্দ্য ইত্যাদির মিলিত নাম। এই “উবান্তু‘র” উপর ইউরোপিয়ন এক নৃতত্ত্ববিদ গবেষণা চালানোর মনস্থ করেন। তার গবেষণার অংশ হিসেবে ঐ নৃতত্ত্ববিদ স্কুল ছেলেমেয়েদের নিয়ে একটি প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন। প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য স্কুল শিক্ষার্থীদের তিনি একত্রিত করেন। সবাইকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে কিছুদূরে একটি ফলের ঝুরির দিকে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে প্রতিযোগিতার নিয়ম বলেন। নিয়ম অনুযায়ী যে সবার আগে ফলের ঝুরি ছুঁতে পারবে বা দখলে নিতে পারবে সেই ফলের ঝুরির মালিক হবে।

প্রতিযোগিতা শুরু হয়। দেখা গেল শির্ক্ষার্থীরা কেউ আগে কেউ পিছে নয়, পরস্পরের হাত ধরাধরি করে সবাই এক সাথে এগিয়ে যাচ্ছে! এবং ফলের ঝুরির সামনে এক সাথে হাজির হয়। সেই নৃতত্ত্ববিদ শিক্ষার্থীদের কাছে জানতে চান “তোমাদের মাঝে কেউ একজন দৌড়ে আগে এসে ফলের ঝুরির দখল নিতে পারতে কিন্ত্তু তা না করে সবাই একসাথে আসলে কেন?”

শিক্ষার্থীদের উত্তর আমরা একজন সুখি হয়ে অন্য সবাইকে দুঃখ দিব কীভাবে? UBUNTU,“উবান্তু‘” জাসুয়া জনগোষ্ঠীর এই শব্দের মর্মাথ হল I am because we are. এর গুরুত্ব বা সারর্মম হল আমরা আছে বলেই আমি আছি, আমাদের মাঝেই “আমি” নিহিত। একবার ভেবে দেখুন আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার কোথাও এমন কিছুর বা তেমন নৈতিকতার কোন স্থান আছে?

আমাদের সমাজ ব্যবস্থার কথা ভেবে দেখুন। সমাজ নৈতিক শক্তিহীনতার কবলে। এই সমাজ কি কখনো দুর্নীতিকে রুখে দাঁড়ানোর সাহস দেখিয়েছে। একবারও কি আমাদের সমাজ কোন দুর্নীতিবাজকে বয়কট করে জানান দিয়েছে এই সমাজে দুর্নীতির স্থান নাই। অবৈধ অঢেল সম্পতির কোন মালিককে সমাজ কখনো কি প্রশ্নের মুখে দাড় করিয়েছে, বরং ফুলের মালায় তাকে নেতৃত্বের আসনে বসিয়ে দিয়েছে। এই সমাজ দুর্বৃত্তকে শুধু লালনই করছে না বরং এই সমাজ এ যাবৎ সৎ মানুষদের জীবনকে অসহনীয় এক আবর্ত্তে ঠেলে দিয়ে এসেছে।

রাজনৈতিক কর্তৃত্বের কথায় আসি। কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত বা উৎসারিত হয় অর্জিত জ্ঞান, প্রজ্ঞা আর নেতৃত্ব দেওয়ার সৎ সহজাত ইচ্ছে থেকে। আমাদের রাজনীতির বিরাজমান বাস্তবতার দিকে চোখ বুলান। আপনি জ্ঞান, প্রজ্ঞা বা সততার মাপকাঠি নিয়ে মাপুন। আপনি হতাশ হবেন। বরং ক্ষেত্র বিশেষে আপনি মার্কোভিজ’এর পোর্টফলিও তত্ত্বের বা বর্তমানের পুঁজি বাজারের প্রবাদ পুরুষ ওয়ারেন বাফেট বা মোল্লা নাসিরুদ্দিনের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার উপদেশ আমাদের রাজনীতিবিদেরা কিভাবে মেনে চলেছেন তা দেখে স্তম্ভিত হবেন। এবং দেখবেন এ তত্ত্বগুলি কীভাবে একজন দুর্নীতিবাজকে দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হতে সাহস বা উৎসাহ যোগায়। পাঠকদের জ্ঞাতার্তে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনাগুলির একটু ব্যাখ্যা উপস্থাপন করছি।

মার্কোভিজ’এর পোর্টফলিও। পোর্টফলিও হল, একজন ব্যক্তির সম্পদের যাবতীয় কাগজ যেমন শেয়ার এক ব্যাগের মধ্যে রাখা। মার্কোভিজ’এর পরামর্শ হল তোমার সব সম্পদ তুমি এক জায়গায় রেখনা। ঝুঁকি এড়াতে বৈচিত্রায়নে মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। এতে করে কোন সময় আজকের সবচাইতে তেজি শেয়ার বা সম্পদও যদি ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যায় তবে অন্য শেয়ার বা সম্পদ সেখানে তোমাকে পতনের হাত থেকে রক্ষা করবে।

ওয়ারেন বাফেট মার্কোভিজ সাহেবের কথাকে আরো সহজভাবে বলেছেন। বাফেট সাহেবের উপদেশ “সব গুলি ডিম এক ঝুড়িতে রেখ না। ভিন্ন ভিন্ন ঝুড়িতে রাখ”। এর তাৎপর্য হল এক ঝুড়ির ডিম ভাঙলেও অন্য ঝুড়ির ডিম রক্ষা পাবে।

মার্কোভিজ আর ওয়ারেন বাফেট’এর ও প্রায় সাতশ বছর আগে আমার অত্যন্ত প্রিয় মানুষ মোল্লা নাসিরুদ্দিন হোজ্জা আরো দুর্দশিতা আরো প্রজ্ঞার সাথে জীবনের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় পারর্দশিতা দেখিয়েছিলেন। মোল্লার ছিল দুই মেয়ে। মোল্লা এক মেয়েকে বিয়ে দেন কৃষকের সাথে, অপর জনকে বিয়ে দেন এক ইট ভাটার মালিকের সাথে। মোল্লা এবার ভবিষ্যৎ নিয়ে নিশ্চিত।

বৃষ্টি বেশী হলে কৃষক জামাইয়ের গোলা ভরপুর। বৃষ্টি কম হলে ইটভাটার জামাইয়ের রমরমা অবস্থা।

কি অপূর্ব ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা। আমাদের রাজনীতিতে এ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা মার্কোভিজ, ওয়ারেন বাফেট আর মোল্লা নাসিরুদ্দিন হোজ্জা’র চেয়েও সফলভাবে আমাদের রাজনীতিবিদরা প্রয়োগে সক্ষম। এতে বৃষ্টি হলেও আর রৌদ্র প্রখর হলেও যেমন হোজ্জার লাভ তেমনি আমাদের রাজনীতিতে এ দল ক্ষমতায় আসলেও আর ও দল হলেও দুর্নীতিবাজদের পরোয়া নেই, তারা ত বৃষ্টিতেও আছেন আবার রৌদ্রেও আছেন।

এবার আমলাতন্ত্রের উপর রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার বিষয়টিতে আসি। রাজনৈতিক নেতারা জনগণের কাছে জবাবদিহিতায় আবদ্ধ, আমলারা নন। আমলারা রাজনৈতিক কতৃত্বের কাছে জবাবদিহি করেন। এটি একটি সুষ্ঠ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অংশ। কর্তৃত্ব বিষয়টি নির্ভর করে সক্ষমতার উপর। সক্ষমতা অর্জিত হয় জ্ঞান আর প্রজ্ঞা থেকে। যেহেতু আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের জনগণের কাঠগড়ায় জবাবদিহি করতে হয় বিশেষ করে সরকার পরিচালনায় কোন ধরনের ব্যত্যয় ঘটলে তার সব দায়িত্ব সরকারী দলের দিকেই আঙ্গুলি নির্দিষ্ট করা হয়। আমাদের চলমান দুর্নীতির উপখ্যান ও এর থেকে ব্যতিক্রম নয়।

তারিক আলী একসময়ের তুখোড় বামপন্থী ছাত্র নেতা এবং বিশ্বছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি। তার বই দি নেহেরুজ এন্ড দি গান্ধীজএ্যান ইন্ডিয়ান ডাইনেস্টি। এই বইতে আমলাতন্ত্রের উপর রাজনৈতিক কতৃত্ব প্রতিষ্ঠার মহাত্মা গান্ধীর একটি অপূর্ব কৌশলের বর্ণনা রয়েছে। গান্ধী ভারতীয় আমলা বিশেষ করে আই সি এস অফিসারদের সমাবেশে জওহর লাল নেহেরু’কে সঙ্গে নিতেন। গান্ধী তার বক্তব্যের শুরুতে প্রায়ই জওহর লাল নেহেরু’কে দেখিয়ে বলতেন “লুক জওহর ইজ ফ্রম হ্যারো”। হ্যারো তখনও এবং এখনও সারা বিশ্বের অন্যতম অভিজাত শিক্ষাপীঠ। গান্ধী তার এই বক্তব্যের মাধ্যমে আমলাদের বুঝিয়েছেন, দেখ রাজনীতির জওহর কোন স্তরের শিক্ষায় শিক্ষিত। সেই থেকে ভারতে সরকার পরিচালনায় বিশাল বহরের মেধাবী আমলা শ্রেণীর ওপর রাজনীতির জওহর’দের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা। বলাবাহুল্য ভারতীয় রাজনীতিকদের মাঝেমাঝে কোনো দুর্নীতির খবর বের হলেও আমলাদের ক্ষেত্রে এটি একেবারেই অকল্পনীয়।

লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট; সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধদূরের দুরবিনে