সৌন্দর্যের লীলাভূমি চট্টগ্রাম এক অপরিকল্পিত শহরের নাম
আজকের লেখাটি মনে করেছিলাম হিজবুল্লাহ–ইসরাইলকে নিয়ে লিখব। এ বিষয়ে লেখা প্রায় শেষই করে জরুরি কাজে ঢাকা যেতে হয়েছিল। ঢাকায় কাজ সেরে হাতে কিছু সময় থাকাতে আমি কয়েকটি বই সংগ্রহ করার মনস্থ করি। বইগুলির একটি শ্রী রাধা দত্ত সম্পাদিত ‘বাংলাদেশ অন এ নিউ জার্নি মুভিং বিইঅন্ড দি রিজিউনাল আইডেনটিটি’ বইটি খোঁজাখুঁিজ করতে গিয়ে জানি এটি গুলশান পার্কে পাওয়া যাবে। গুলশান পার্কে বই। আমি কিছুটা সংশয় কিছুটা বিস্ময় নিয়ে গুলশান পার্কের উদ্দেশ্যে যাত্রা করি। পার্কে ঢুকতেই প্রবেশ পথের অনতি দূরে সৌকর্যমণ্ডিত কফি শপ। নানা লেইনে বিভক্ত চলাচলের পথ। কিছু পর পর বসার সুবিধা। একেবারে পরিকল্পিত। ছিমছাম গাছপালার সারি। সব কিছুই নান্দনিক। প্রচুর লোকজন এই পার্কে। কেউ হাঁটছেন, কেউ বিশ্রামে, কেউ কেউ এমন এক স্বর্গীয় পরিবেশে পাঠে মগ্ন। আমি হাঁটতে হাঁটতে ভাবি আর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ি।
আহা! বিপ্লবের–বিদ্রোহের, পাহাড়ের–সাগরের, নৈসর্গের চট্টগ্রাম।
হঠাৎ মনে অবচেতনে মনে পড়ে একটি টিভি টকশোর কথা। অনেক দিন আগের বলে টিভি চ্যানেলটির নাম ঠিক এ মুহূর্তে মনে করতে পারছি না। আমি আর পণ্ডিতজন অধ্যাপক সলিমুল্লা খান টক শো’তে অংশগ্রহণ করেছিলাম। কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন ‘চট্টগ্রাম এক এতিম শহরের নাম’, কী নিদারুণ উক্তি!
আমি হাঁটতে হাঁটতে বইয়ের দোকানের সামনে। ‘বুক ওয়ার্ম’ বইয়ের দোকানের নাম। থরে থরে দেশ বিদেশের নানা বইয়ের বিপুল সমাহার। নৈসর্গের মাঝে অনেক তরুণ তরুণী, পাঠক পাঠিকা এই বুকওয়ার্মের ভিতর। কেউ বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছেন কেউ তার পছন্দের বই খুঁজছেন, কেউ কেউ বই কিনে নিয়ে কিছুদূরে বেঞ্চে বসে পড়ছেন। আমি আমার কাঙ্ক্ষিত বই কিনে বাইরে আসি।
আহা! দৌলত কাজী–আলাওল, মাস্টারদা সূর্যসেন–মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী’র চট্টগ্রাম।
পরদিন দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছার জন্য মেট্্েরারেলে যাত্রা করি। নানা পেশার নানা শ্রেণির মানুষে পরিপূর্ণ মেট্্েরারেল। ঠিক নির্দিষ্ট সময়ে রেল থামে আমার গন্তব্যে। চট্টগ্রামে ফ্লাইওভার প্রাধান্য পেল কেন? গণপরিবহন মেট্্েরারেল হল না কেন? কার এ অদূরদর্শী পরিকল্পনা? মেট্্েরারেল সময় মত গন্তব্যে পৌঁছে, যানজট কমায়, সব শ্রেণি পেশার মানুষের জন্য উপযোগী এবং সাশ্রয়ী। ফ্লাইওভার আমাদের দেশে চলমান সব যানবাহন উঠানামার উপযোগী নয় ফলে ফ্লাইওভার হয়ত ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারকারীদের জন্য সাময়িক উপশম কিন্ত্তু দীর্ঘ মেয়াদি কোন সমস্যার সমাধান নয়। আমাদের মত নিম্ন আয়ের দেশের মানুষের জন্য মেট্্েরারেলের মত গণপরিবহন সব দিক দিয়ে উপযোগী। এটি চট্টগ্রামে হতে পারত কিন্ত্তু হয়নি। কেন হয়নি? এ প্রশ্ন যারা নীতিপ্রণয়ন এবং নীতি নির্ধারণকারী তাদের করার অধিকার সাধারণ মানুষের রয়েছে।
প্রকৃতি চট্টগ্রামকে দুহাত ভরে তার বর দিয়েছে। বহমান কর্ণফুলী নদী। বঙ্গোপসাগরের অবারিত সুনিল রাশি আছড়ে পড়ছে চট্টগ্রাম উপকূলে। এই চট্টগ্রামকে প্রকৃতি এমনই দানে ধন্য করেছে যার বদৌলতে এটি পৃথিবীর যে কোনও বিখ্যাত শহরের সাথে সমানে পাল্লা দিতে পারে। উদাহরণ হিসাবে উল্লেখ করতে পারি। প্যারিস–সীন নদীর এপার ওপার। লন্ডন টেমস’এর এপার ওপার। নিউইর্য়ক হাডসন’এর এপার ওপার। মস্কো বল্গা’র এপার ওপার। এসব বিখ্যাত শহর থেকেও চট্টগ্রাম একদিক থেকে অনন্য, কর্ণফুলীর এপার ওপার জুড়ে তো রয়েছেই তারপরও চট্টগ্রাম পাহাড় বেষ্টিতও, পাহাড় চট্টগ্রামের আরো একটি অলংকার। চট্টগ্রামের অপূর্ব এই পাহাড় শ্রেণিকে আমরা কী করেছি? অবলীলায় কেটেছি। এটি করা হয়েছে কখনো আড়ালে কখনো প্রকাশ্যে।
আহা! অধ্যাপক জামাল নজরুল–অধ্যাপক নুরুল ইসলাম, হাবিলদার রজব আলী–তারেকশ্বর দস্তিদার’এর চট্টগ্রাম।
এই চট্টগ্রামকে বহু শতাব্দী আগে চৈনিক এক পরিব্রাজক বলেছিলেন ‘ইট ইজ এ্যা বিউটি রাইজিং ফ্রম মিস্ট এ্যান্ড ওয়াটার”। প্রকৃতির লীলাভূমি এই চট্টগ্রামে গুলশান পার্কের আদলে একটি পার্কও গড়ে উঠেনি। এই চট্টগ্রামে অপূর্ব সব পাহাড় শ্রেণি থাকা সত্ত্বেও একটি বোটানিক্যাল গার্ডেনও গড়ে উঠেনি। অথচ চট্টগ্রাম শহরের দুই দুই জন মাননীয় মেয়র’কে আমি ব্যক্তিগতভাবে সবিনয়ে অনুরোধ করেছি অনন্ত সিঙ্গাপুরের গ্লানিক্যাল হসপিটালের ঠিক বিপরীতে অবস্থিত বোটানিক্যাল গার্ডেনটি পরিদর্শন করে সিঙ্গাপুর কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করে চট্টগ্রামে সেই আদলে একটি বোটানিক্যাল গার্ডেন গড়ে তুলতে। এটি পারস্পরিক সৌজন্য বা চুক্তির মাধ্যমেও হতে পারে। আরো একটি অনুরোধও আমি একই সাথে করেছিলাম। সেটি হল চট্টগ্রামের সকল স্কুল/কলেজের যানবাহনকে হলুদ রঙে রঙ করা। এটি করার পর সমিল্লিতভাবে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষ সর্বসম্মতিক্রমে একটি ঘোষণা দেবেন, যদি ভবিষ্যৎ এ কোনও দিন কোনও ধরনের হরতাল/ধর্মঘট হয় তাহলে হলুদ রঙের যানবাহন চলাচলে কোনও ব্যাঘাত কেউ সৃষ্টি করবে না। এতে করে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার উপর কোনও ধরনের আঘাত আসবে না। সময়ের সাথে শিক্ষা এবং শিক্ষার্থীর সম্পর্ক ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। আমরা অনেক কর্মসূচীর মাধ্যমে আমাদের বর্তমানকে বিনাশের পথে ঠেলে দিতে পারি কিন্ত্তু আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যারা কোনও অবস্থাতেই বর্তমানের সংঘাত সংর্ঘষের সাথে জড়িত নয় বা দায়ী নয় তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা চিনিমিনি খেলতে পারি না। এর কোনওটিই আজ পর্যন্ত কার্যকরী হয়নি বা এব্যাপারে কোনও উদ্যোগও নেওয়া হয়নি।
আহা! হান্নান–মান্নান, এম এ আজিজ–জহুর আহাম্মদ চৌধুরী’র চট্টগ্রাম। কাজ সেরে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম ফেরার সময় প্রায়ই আমি বিকেল করে ফিরি। দুটি কারণ প্রথমটি মন ভরে কর্ণফুলীর মোহনা দেখা। মেঘমুক্ত আকাশ হলে গোধূলি কর্ণফুলীর বুকে ভাসমান নৌযানে রং ছিটিয়ে বেড়ায়। সে অপূর্ব নৈসর্গ পারলৌকিকতার এক আবেশ ছড়ায় আমার হৃদয় মন জুড়ে। দ্বিতীয়টি আমার স্ত্রী আসে আমাকে এয়ারপোর্ট থেকে নিয়ে যেতে। তার এয়ারপোর্টে আসার মূল কারণ কর্ণফুলীর পাড়ে বসে তার অপরূপ রূপ দেখা আর গরম পেয়াঁজু–কাঁকড়া ভাজা খাওয়া। ২৪ জুন ২০২৪ ও এর ব্যতিক্রম হয়নি। আমার স্ত্রী পেয়াঁজু–কাঁকড়া নিয়ে বসে। খানিক পর আমি এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে তার সাথে যোগ দিই।
চেয়ার টেনে বসতেই আমাদের সামনে দেওয়াল! কর্ণফুলী নেই! বেদনায় আমার সমস্ত মনপ্রাণ আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। কর্ণফুলীর অপূর্ব রূপকে দেওয়াল দিয়ে ঘিরে দেওয়া। কার বা কাদের এই কাজ?
দ্রুত উঠে পড়ি বাড়ির পানে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ‘যেতে নাহি দেব’ কবিতার চরণ ভর করে আমার ওপর!
কী গভীর দুঃখে মগ্ন সমস্ত আকাশ,
সমস্ত পৃথিবী। চলিতেছি যত দূর
শুনিতেছি কর্ণফুলীর কান্নার সুর (কবিগুরুর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি)।
কর্ণফুলী’কে আড়াল করার এই অবিমৃষ্যকারী সিদ্ধান্ত একেবারেই অগ্রহণযোগ্য এবং অবিলম্বে এটি পরিত্যাজ্য।
আহা! শেফালি ঘোষ–শ্যাম সুন্দর বৈঞ্চব, কবিয়াল ফণিভূষণ–আইয়ূব বাচ্চুর চট্টগ্রাম। এ পর্যন্ত বেদনার কথা বললাম। চট্টগ্রামে আশা আনন্দের কিছু কিছু ঘটনাও ঘটেছে। একজন আমলা সৃষ্টিশীল দেশপ্রেমিক হলে যে অনেক কিছু করা যায় তার উদাহরণ চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান। তিনি হয়ত চট্টগ্রামের হতশ্রী অবস্থা, পরিকল্পনাহীনতা পর্যবেক্ষণ করে তার পক্ষে যা সম্ভব তা করেছেন। তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ আউটার স্টেডিয়াম। কী দন্যদশা ছিল এই আউটার স্টেডিয়ামের, খেলাধূলার মাঠের পরিবর্তে এটি বাগাড়ে পরিণত হয়েছিল। এটি এখন সবুজ মখমলে ঢেকে যাচ্ছে। আউটার স্টেডিয়ামের পাশেই সার্কিট হাউজ মাঠ। এক সময়ের চট্টগ্রাম শহরের মানুষের অনাবিল নিঃশ্বাস ফেলার জায়গা। সেটি হয়ে পড়েছিল দেওয়াল ঘেরা লক্ষিণদরের বাসর ঘর। এ মাঠ এখন মুক্ত সে অভিশাপ থেকে। এটিও চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান’এর কীর্তি। তার অন্যন্য কীর্তি ডিসি পার্ক, চট্টগ্রামের সলিমপুরে দখল হয়ে যাওয়া পাহাড়ী অঞ্চল উদ্ধার।
ফিরে আসি হিজবুল্লাহ–ইসরাইল ইস্যু বাদ দিয়ে কেন উপরের শিরোনামে লেখা শুরু করলাম সে প্রসঙ্গে। এয়ারপোর্ট থেকে পূর্বমুখী হয়ে বের হতেই দেখা যেত অপরূপ কর্ণফুলী। উঁচু প্রাচীরের কবলে পড়ে কর্ণফুলী এখন আর দেখা যাচ্ছে না। চট্টগ্রামের মাননীয় মেয়র, সি ডি এ চেয়্যারম্যান, চট্টগ্রামের মাননীয় প্রশাসক সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি আপনাদের যারই দায়িত্বের আওতায় পড়ুক, সে দায়িত্বটুকু পালন করুন। কর্ণফুলীকে দেওয়ালের হাত থেকে রক্ষা করুন।
আলেকজান্ডারের সময় গ্রীসের অন্যতম জ্ঞানী দার্শনিক ছিলেন ডায়গনিস। তিনি বাস করতেন করিয়েন্তে। আরেকজান্ডারের ডায়গনিসের প্রতি ছিল অগাধ সম্মান। আলেকজান্ডার গ্রীসদের সম্মিলিত সম্মতিতে গ্রীসের দায়িত্ব গ্রহণকালীন ডায়গনিসের উপদেশ গ্রহণের জন্য তার কাছে যান। বিনয়ের সাথে আলেকজান্ডার ডায়গনিস’এর কাছে জানতে চান ‘আপনার কোনও কিছুর প্রয়োজন আছে কি? আপনার জন্য আমি কী করতে পারি?’ আলেকজান্ডার সূর্যকে পিছনে রেখে ডায়গনিস’এর মুখামুখি দাঁড়িয়েছিলেন। ডায়গনিস কোনও ধরনের রাখডাক না করে আলেকজান্ডারকে বলেন ‘স্ট্যান্ড আউট অব মাই লাইট’। সরে দাঁড়াও আমাকে সূর্যের আলো থেকে বঞ্চিত করো না। পরবর্তীতে গ্রীক দার্শনিকেরা এটিকে ব্যাখ্যা করেন ‘তুমি আমাকে যা দিতে পার না তা থেকে তুমি আমাকে বঞ্চিত করতে পার না’ স্ট্যান্ড আউট অব মাই লাইট এই বাণীই বহন করে। এয়ারপোর্ট থেকে বের হতে কর্ণফুলীর পাড় জুড়ে যারা প্রাচীর তুলছেন তাদের উদ্দেশ্যে মহামতি ডায়গনিস’এর উক্তির পুনরাবৃত্তি করে এ লেখা শেষ করছি ‘স্ট্যান্ড আউট অব মাই লাইট’।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক।