সমকালের দর্পণ

মেজর মোহাম্মদ এমদাদুল ইসলাম (অব.) | রবিবার , ২ জুন, ২০২৪ at ৭:১৬ পূর্বাহ্ণ

কিশোর মাহবুবানি, খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব। সিঙ্গাপুরের পররাষ্ট্র সচিব ছিলেন, দীর্ঘদিন সিঙ্গাপুরের হয়ে জাতিসংঘে স্থায়ী প্রতিনিধি ছিলেন। সম্প্রতি তার লেখা বই ‘হ্যাজ চায়না ওয়ান?’ তাকে বিপুল খ্যাতি এনে দেয়। কিশোর মাহবুবানির বইটি মুগ্ধ হয়ে পড়তে পড়তে তার সম্বন্ধে জানার আগ্রহ জন্মে।

এ জানার আগ্রহ থেকে যা জানি তা পাঠকদের সাথে শেয়ার করার লোভ সংবরণ করতে না পারার জন্য নিজের মাঝে একধরনের সংকোচ কাজ করে যাচ্ছে।

কিশোর মাহবুবানি ৪ অক্টোবর ১৯৪৮ সালে সিঙ্গাপুরে ৬ বছর বয়সে স্কুলে ভর্তি হন। দরিদ্র সিঙ্গাপুরে, কারণ তখন সিঙ্গাপুরের মাথা পিছু আয় মাত্র তিনশত মার্কিন ডলার, দরিদ্র এক পরিবারের সন্তান মাহবুবানি স্কুলে ভর্তি হয়ে জানতে পারেন তার ছোট্ট শিশু শরীরের তখন যা ওজন হওয়ার কথা তার থেকে তার ওজন কম। এটি অপুষ্টি জনিত কারণে। স্কুল কর্তৃপক্ষ মাহবুবানির মত শিশুদের ওজন প্রত্যাশিত পর্যায়ে উন্নীত করার জন্য স্কুলে সুষম খাদ্যের ব্যবস্থা করেন।

মাহবুবানি পরবর্তীতে সিঙ্গাপুরের সেরা এক ছাত্র হিসাবে পৃথিবীখ্যাত হার্ভাড থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। সে দেশের সেরা কূটনীতিক হন, সিঙ্গাপুরের লি কূয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক পলিসি ফ্যাকাল্টির ডিন হিসাবে দীর্ঘ ১৩ বছর কাজ করেছেন। এই ১৩ বছর তার ছাত্রদের একটি দেশকে সার্বিকভাবে উন্নত করতে হলে যা প্রয়োজন তা বুঝিয়েছেন ক্রমাগত একই সূত্র আর নীতির কথা বলে।

১৯৪৮ সালের দরিদ্র এক সিঙ্গাপুর কী যাদু বলে দ্রুত এবং অভাবনীয়ভাবে তৃতীয় বিশ্ব থেকে উন্নত বিশ্বে উন্নীত হয়, এটি বর্ণনা করতে গিয়ে মাহবুবানি তিনটি ইংরেজী অক্ষর উল্লেখ করেন, এম, এইচ, পি।

এম দিয়ে তিনি বুজিয়েছেন ‘মেরিটোক্রেসি’ অর্থাৎ মেধা। মেধা একটি জাতির উন্নয়নের জন্য সবচেয়ে অপরিহার্য অনুসঙ্গ। সিঙ্গাপুরের স্থপতি লি কূয়ান নিজে ছিলেন ক্যামব্রিজ আর হার্ভাডের সেরা ছাত্র। তিনি তার মন্ত্রীসভা এবং প্রশাসনে মেধাবিদের অগ্রাধিকার দিয়েছেন। তার প্রশাসনে তিনি কখনো স্বজন প্রীতিকে প্রশ্রয় দেননি।

এইচ। সততা সিঙ্গাপুরের দ্রুত উন্নয়নের অন্যতম জিয়নকাঠি। চুনুপুটিদের দুর্নীতির অপরাধে শাস্তি দেওয়ার চেয়ে একেবারে উচ্চপর্যায়ের দুর্নীতিকে নির্মূল করার মাঝে সিঙ্গাপুর দুর্নীতি দূর করতে সক্ষম হয়েছে। একবার প্রধানমন্ত্রী লি কূয়ানের ঘনিষ্ঠ ডেপুটি মিনিস্টার একদল ব্যবসায়ীর সাথে ছুটি কাটাতে যান। ছুটি শেষে ফিরে আসলে প্রধানমন্ত্রী লি কূয়ান তাকে গ্রেফতারের নির্দেশ প্রদান করেন। হতচকিত মন্ত্রী গ্রেফতারের কারণ জানতে চাইলে, তাকে জানানো হয় ব্যবসায়ীদের সাথে ছুটি কাটাতে যাওয়া এক ধরনের দুর্নীতি। তারা মন্ত্রীর সাথে উদ্দেশ্য ছাড়া এমনি এমনি বেড়াতে যাননি। এ থেকে সবাই যার যার বার্তা পেয়ে যান।

পি। প্রাগমাটিজম। এটি ইংরেজি শব্দ। মাহবুবানির বক্তব্য অনুযায়ী প্রাগমাটিজম শব্দটিকে সবচেয়ে ভালো ব্যাখ্যা এবং প্রয়োগিক দিক দারুণভাবে তুলে ধরেছেন চীনা নেতা দেং জিয়াও পিং। দেং এর কথা হল, ‘বিড়াল কালো কি সাদা তা নিয়ে ব্যস্ত না হয়ে দেখতে হবে বিড়ালটি ঠিক মত ইঁদুর ধরছে কিনা’। এটিই ইংরেজি প্রাগমাটিজম শব্দটির যথার্থ ভাবার্থ।

এই তিন অক্ষর এম, এইচ, পি, ভিত্তি করে সিঙ্গাপুর পথ চলেছে এবং বর্তমানে পৃথিবীর অন্যতম উল্লেখযোগ্য মাথাপিছু আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে।

এতক্ষণ দূরবিনে দূরের সিঙ্গাপুরকে দেখেছি। এবার নিজের আয়নায় নিজেকে দেখি। এ দেখার পিছনে আমার একটি বেদনাদায়ক স্মৃতি আমাকে তাড়িত করে আসছে সবসময়। চট্টগ্রামের ক্ষণজন্মা পুরুষ জনাব এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী পর পর তিনবার মেয়রের দায়িত্ব শেষ করে চতুর্থ বার মেয়র নির্বাচনের জন্য প্রার্থী হয়েছেন। আমি ঐ নির্বাচনে নাগরিক কমিটির মহাসচিব হিসাবে নির্বাচন পরিচালনার সার্বিক দায়িত্ব পালন করছিলাম। মেয়র নির্বাচনের দু তিন দিন আগে থেকে অঝোর ধারার বৃষ্টি। চট্টগ্রাম শহরের প্রায় অনেকটাই পানির নিচে। এতদিন একটি বিষয় অনেকেই বলাবলি করছিলেন, জনাব মহিউদ্দিন চৌধুরীর সুযোগ্য নেতৃত্বে চট্টগ্রাম শহর প্রায় সিঙ্গাপুর হয়ে গেছে এবার নির্বাচিত হলে চট্টগ্রাম পুরাপুরিই সিঙ্গাপুরের মত হবে। এদিকে চট্টগ্রাম শহরের অন্যান্য এলাকাসহ মুরাদপুরও তখন পানির নিচে। এ সুযোগ বিরোধী শিবির মোটেও হাতছাড়া করেনি। তারা শ্লোগান তোলে ‘দেখে যান মুরাদপুর হয়ে গেছে সিঙ্গাপুর’। এটি ছিল চরম বিদ্রুপার্থক এবং হাস্যরসাত্মক। আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ তখনও এখনও হাস্যরস এবং বিদ্রুপে নিজেদের আনন্দ খুঁজে নিতে ভালোবাসেন। সেই মুরাদপুরসিঙ্গাপুরের শ্লোগানের প্রচারণায় জনাব মহিউদ্দিন চৌধুরীর শিষ্য জনাব মনজুরুল আলম ভোটে জিতে যান। সেই থেকে চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা বিষয়টি সামনে আসলে আমি কিছুটা আনমনা হই। জনাব মনজুরুল আলম মেয়র হয়ে যখন জলবদ্ধতার কোনও গতি করতে পারছিলেন না তখন তিনি কায়দা করে এই জলবদ্ধতাকে জলজট বলে চালিয়ে দেওয়ার একটি কৌশল গ্রহণ করেছিলেন। কিন্ত্তু দুর্ভাগ্য চট্টগ্রামবাসীর জন্য যা জলবদ্ধতা তা জলজট, বা যা জল তাই পানি যেমন বাস্তব ঠিক তেমনি এখনও বৃষ্টি হলে জলের কবলে চট্টগ্রামবাসীর ভোগান্তির একই বাস্তবতাজলবদ্ধতা জনিত ভোগান্তি কোনও অংশে কমেনি।

জনাব আবদুচ ছালাম যখন সিডিএ’র চেয়্যারম্যান তখন তিনি চট্টগ্রামের জলবদ্ধতা দূরীকরণে বেশ কয়েক হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প সরকার থেকে অনুমোদন করিয়ে নেন।

চট্টগ্রাম শহরের জলবদ্ধতা প্রকল্প অনুমোদিত হওয়ার কিছুদিন পর তৎকালীন মাননীয় অর্থমন্ত্রী জনাব আবুল মাল আবদুল মুহিত’এর সাথে তাঁর সহোদর প্রাক্তন পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেনের উপস্থিতে আমার সাক্ষাৎ হয়। ঐ সাক্ষাৎ অনুষ্ঠানে কথা প্রসঙ্গে আমি উল্লেখ করি চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা প্রকল্পের টাকাগুলি জলে ঢেলেছেন, সে কথা শুনে তিনি আমার ওপর কিছুটা উষ্মা প্রকাশ করে কেন জলে ঢালা হয়েছে তা জানতে চান। আমি প্রতি উত্তরে বলেছিলাম, চট্টগ্রাম শহরে জলবদ্ধতার সেন্টার অব গ্রেভিটি কর্ণফুলী নদী। কর্ণফুলী নদীতে ক্যাপিটাল ড্রেজিং করতে গিয়ে ‘বালু জাফর’ যে কাণ্ড ঘটিয়েছিল কম বেশি তা সচেতন মহলের অজানা নয়। নদীর তলদেশের মাটি তুলে তা দূরবর্তী এলাকায় না নিয়ে নদীর উত্তর পাড় ভরাট করে নদীর প্রশস্ততাকে বেশ সংকুচিত করে ফেলা হয়েছে। একদিকে কর্ণফুলীর তলদেশ যথাযথ ‘ক্যাপিটাল ড্রেজিং’ না করে নদীর গভীরতা যেমন বৃদ্ধি করা হয়নি, অন্যদিকে নদীকে সংকুচিতও করে ফেলা হয়েছে ফলে যে পরিমাণ পানি অর্থাৎ ‘কোয়ান্টাম অব ওয়াটার’ কর্ণফুলী সাগরে বহন করে নিয়ে যাওয়ার কথা মানুষদের অবিমশ্যকারিতার জন্য সে তা হারিয়েছে। এর ফলে কাপ্তাই জলবিদ্যুতের পানি এবং অতিবৃষ্টি আর অন্যদিকে জোয়ারের পানি বুকে ধারণ করার ক্ষমতা হারিয়ে কর্ণফুলী তার দুকূল চাপিয়ে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে চলেছে। এর ফলে এখনও বৃষ্টি হলেই চট্টগ্রাম শহরের মানুষ জলাবদ্ধাতা বা জলজটে পড়ে নাকানি চুবানি খেয়ে যাচ্ছেন।

জলাবদ্ধতা প্রকল্প পাশ হওয়ার কিছুদিনের মধ্যে এ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এর পরপর ঈদের এক অনুষ্ঠানে সেনাবাহিনী থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প পরিচালকের সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়। কথা প্রসঙ্গে তিনি আমাকে জানান ‘প্রকল্পটি অনেকটা যথাযথ মূল্যায়ন, পর্যালোচনা, পরিকল্পনা ব্যতীত প্রণীত হয়েছে, এসব করার মত দক্ষ জনবল বা অভিজ্ঞ প্রকৌশলীও সিডিএ’তে নেই, তারা প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষমতাও রাখে না, ফলে এটা এখন সেনাবাহিনীকে দেওয়া হয়েছে’। তার আরো অভিমত দক্ষ এবং অভিজ্ঞদের দ্বারা প্রকল্পটি প্রণীত হওয়া উচিত ছিল, সেনাবাহিনীই যদি প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে তা হলে এ প্রকল্প প্রণয়নের দায়িত্বও সেনাবাহিনীর উপর ন্যস্ত হওয়া উচিৎ ছিল। সেটা করা হয়নি।

আমার সাধারণ জ্ঞান থেকে আমার অভিমত এই শহরকে এত কাটাকাটি খোঁড়াখুঁড়ি না করে যে অর্থ এখন এসব কাজে ব্যয় করা হচ্ছে তা দিয়ে আরেকটি নতুন চট্টগ্রাম শহর গড়ে তোলার অবকাঠামো গড়ে তোলা যেত। আমাদের এই শহরের উত্তরে এবং ট্যানেল হওয়ার পর দক্ষিণেও সে সুযোগ অবারিত হয়েছে। আমরা এই সুযোগ গ্রহণ করলে আগামীর চট্টগ্রামের জন্য একটি অনন্য এবং দূরর্দশী পথরেখা আমরা অবারিত করে রেখে যেতে পারতাম।

এ ভাবনা থেকে আয়নায় আমি নিজেকে দেখি, দেখে মনে হয়েছে, আমরা সিঙ্গাপুরের অভিজ্ঞতার এই তিনটি শব্দ ‘এম,এইচ,পি’ কোনওটিকেই তেমন গুরুত্ব দিই না সেটা জলাবদ্ধতা প্রকল্প বলুন বা জাতীয় অন্যান্য ক্ষেত্রের কথা বলুন।

যারা নীতি নির্ধারক, যারা জাতীয় কৌশল প্রণেতা তারা যদি মেধাকে অগ্রাধিকার দিতেন, সততাকে লালন করতেন আর প্রাগমাটিজমকে ধারণ করতেন তবে এ জাতির পথ চলা যেমন অনেক মসৃণ হত কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনও ততো সহজ হতো। হাজার হাজার কোটি টাকার চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পে বর্ণিত তিনটি শব্দের কোনওটিকেই ধারণ করা হয়নি এটি নিশ্চিত। হলে গত ২৭ মে ২০২৪ চট্টগ্রামবাসীকে জলে ভাসতে হতো না।

লেখক: প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট; সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধভিটামিন ‘এ’ শিশুর জন্য কেন এতো বেশি গুরুত্বপূর্ণ
পরবর্তী নিবন্ধপুকুরে ‘গোসলে’ নেমে বৃদ্ধের মৃত্যু