নিহত ইরানি প্রেসিডেন্ট ইবরাহিম রাইসি’র জন্ম ১৯৬০ সালের ১৪ ডিসেম্বর মাসহাদে। বাবা ছিলেন ধর্মীয় নেতা। ১৯৭৯ সালে আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনি ইরানে ইসলামী বিপ্লবী আন্দোলন গড়ে তুললে ইবরাহিম রাইসী সে আন্দোলনের পক্ষে ছাত্র আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে রাজনীতিতে নিজেকে সামিল করেন। ইবরাহিম রাইসী আইন শাস্ত্রে পি এইচ ডি ডিগ্রিধারী। মাত্র ২৫ বছর বয়সে রাইসী তেহরানের ডেপুটি প্রসিকিউটর হন। তার স্ত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তাদের দুই সন্তান। ২০১৭ সালে ইবরাহিম রাইসী প্রথম প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হন। ৩৮ শতাংশ ভোট পেয়ে তিনি সেবার হাসান রুহানির কাছে পরাজিত হন। হাসান রুহানি দ্বিতীয় বার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। প্রেসিডেন্ট পদে পরাজিত হলেও সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি রাইসী’কে ইরানের প্রধান বিচারপতি হিসাবে নিয়োগ দেন। পরবর্তীতে ২০২১ সালের ৫ আগস্ট দ্বিতীয়বার প্রার্থী হয়ে শতকরা ৬২% ভোট পেয়ে ইবরাহিম রাইসী রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। সেই থেকে তিনি ইরানকে সফলভাবে নেতৃত্ব দিয়ে এসেছেন। রাইসী ছিলেন ইরানের দ্বিতীয় ক্ষমতাধর শীর্ষ নেতা। ধারনা করা হচ্ছিল তিনি আয়াতুল্লাহ খামেনি’র পর ইরানের শীর্ষ পদে আসীন হবেন।
ইরান সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ব মঞ্চে অন্যতম এক আলোচিত সমালোচিত শক্তি হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। ইরান তার কার্যক্রমের মাধ্যমে প্যালেস্টইন সমস্যাকে আরবদের পরিবর্তে একে ইসলামী জগৎ এর সাথে ইহুদিদের সমস্যায় রূপান্তরিত করেছে। ইরান অত্যন্ত কৌশলের সাথে এবং দূরদর্শিতায় পাশ্চাত্যের সকল প্রকার আরোপিত নিষেধাজ্ঞাকে মোকাবেলা করে এসেছে। পাশ্চাত্য চাতুর্যের সাথে সাদ্দাম হোসেনকে প্রলুদ্ধ করে কুয়েত দখলে এগিয়ে দিয়ে ইরাক আক্রমণের সুযোগ খুঁজে নিয়েছিল এবং ইরাককে ধ্বংস করে। এই একই কায়দায় পাশ্চাত্য ইরানকে ফাঁদে ফেলার নানা ঘটনা ঘটায় যাতে ইরান তাদের সাথে সংঘর্ষে জড়ায়। এসব কর্মকাণ্ডের মধ্যে উল্লেখযোগ্য, ইরানি পারমাণবিক স্থাপনার উপর সাইবার আক্রমণ, ইরানের পারমাণবিক গবেষণার প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাকে হত্যা, ইরানী রেভ্যুলুশনারি গার্ডের প্রধান জেনারেল সোলাইমানীকে বাগাদাদে ড্রোন আক্রমণে হত্যা।
ইরান সুকৌশলে উল্লেখিত কোনও ঘটনায় নিজেকে সরাসরি সম্পৃক্ত না করে তার প্রক্সিদের মাধ্যমে প্রতিউত্তর এবং প্রতিরোধ যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকে। এসব প্রক্সির মধ্যে লেবাননের হিজবুল্লাহ, ইয়েমেনে হুথি এব প্যালেস্টাইনের হামাস অন্যতম। এর বাইরেও ইরাক–সিরিয়ায় রয়েছে ইরান সমর্থিত মিলিশিয়া বাহিনী।
উল্লেখ্য প্রক্সির মাধ্যমে সামরিক কার্যক্রম চালানোর পাশাপাশি ইরান তার পারমাণবিক কার্যক্রমকে যেমন একটি অবস্থানে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে তেমনি সামরিক শক্তিকেও সম্মানজনক পর্যায়ে উত্তরণ ঘটিয়েছে। এরই প্রমাণ রাশিয়ার মত সামরিক পরাশক্তিকে ইরানের সমরাস্ত্র বিশেষ করে ড্রোন দিয়ে ইউক্রেন যুদ্ধে সহায়তা।
সামরিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি ইরান সাম্প্রতিক সময়ে কূটনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণেও অনেক দূরর্দশিতার প্রমাণ রেখেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য চীনের মধ্যস্থতায় সৌদি আরবের সাথে দীর্ঘদিনের বৈরী সর্ম্পকের অবসান ঘটিয়ে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন। ভারতের সাথে চা–বাহার বন্দর ব্যবস্থাপনা চুক্তি, পাকিস্তানের সাথে কিছুটা শীতল সম্পর্কের অবসান ঘটিয়ে গ্যাস লাইন চুক্তি, চীন এবং রাশিয়ার সাথে সামরিক মহড়া এবং সৌহর্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন ইরানের অন্যতম কূটনৈতিক সফলতা।
পাশ্চাত্যের দীর্ঘ অর্থনৈতিক অবরোধ সত্ত্বেও ইরান তার অর্থনীতিকে ভালোভাবেই সামাল দিয়েছ্ে। শুধু সামাল দেওয়া নয় ইরানী অর্থনীতি তার সামরিক বাহিনীকেও এগিয়ে যাওয়ার রসদ যুগিয়েছে।
পাশ্চত্যের মদদে ইরানের উপর সর্বশেষ যে আঘাত আসে তা হল ইসরাইল কর্তৃক সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে ইরানী দূতাবাস আক্রমণ করে ইরানী গার্ড রেজিমেন্টের সাতজন উচ্চ পদস্থ সেনা অফিসারকে হত্যা। এটি সংঘটিত হয় ১ এপ্রিল ২০২৪। প্রতিক্রিয়ায় ইরান ১৩ এপ্রিল ২৪ ইসরাইলে ৩০০ ড্রোন, ক্রুজ এবং ব্যালেস্টিক মিসাইল এর সমন্বয়ে এক অভাবনীয় আক্রমণ পরিচালনা করে। এই আক্রমণ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ইসরাইল এবং জর্দানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ভেদ করে ইসরাইলে আঘাত হানতে সক্ষম হয়। এতে করে ইরান পাশ্চাত্যের সার্বিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে প্রশ্নের মুখামুখি করতে সক্ষম হয়।
এ সমস্ত সম্ভব হওয়ার পিছনে ব্যক্তির সাফল্য খুঁজতে গেলে ইরানী প্রেসিডেন্ট ইবরাহিম রাইসী’কে সর্বাগ্রে এবং তার পররাষ্ট্র মন্ত্রী আবদুল্লাহহিয়ান’কে এরপরের স্থান দিতে হবে। এ স্থানই রাইসী এবং তার পররাষ্ট্র মন্ত্রীর জন্য কাল হয়নি ত?
১৯ মে ২০২৪ আজারবাইজানে নির্মিত একটি জলাধারের বাঁধ উদ্বোধন শেষে ইরানের পূর্ব আজারবাইজানের জোলফা নামক অরণ্যঘেরা পাহাড়ি অঞ্চলে প্রেসিডেন্ট রাইসী’কে বহনকারী হেলিকপ্টারটি বিধ্বস্ত হয়। বিধ্বস্ত হওয়ার প্রায় ১৬ ঘণ্টা পর উদ্ধারকারী দল দুর্ঘটনা স্থলে পৌঁছাতে সক্ষম হয়। দুর্ঘটনাস্থলটি খুঁজে বের করতে তুর্কি ড্রোন বিশেষ ভূমিকা রাখে। ঐ ড্রোন মেটালিক বা লৌহজাত বস্ত্তু থেকে যে হিট জেনারেট হয় অর্থাৎ হেলিকপ্টারের ধ্বংস স্ত্তূপ থেকে নির্গত হিটকে ব্যবহার করে তার মাধ্যমে দুর্ঘটনা স্থল বের করে।
এখানে উল্লেখ্য আজারবাইজান থেকে প্রেসিডেন্ট ইবরাহিম রাইসী’র ফেরার পথে তার হেলিকপ্টার বহরে মোট তিনটি হেলিকপ্টার ছিল। প্রেসিডেন্টেকে বহনকারী হেলিকপ্টারটি বিধ্বস্ত হয় বাকী দুটি নিরাপদে ফিরে আসে। হেলিকপ্টারগুলোর গন্তব্য ছিল ইরানের অন্যতম বৃহৎ শহর তাবরিজ। বলা হচ্ছে হেলিকপ্টারগুলো পূর্ব আজারবাইজানের দুর্ঘটনা স্থলে পৌঁছালে সেখানে ঘন কুয়াশা এবং বৃষ্টির কবলে পড়ে। তখন বাইরে তাপমাত্রা হিমাংকের নীচে মাইনাস পনের।
এখানে স্বাভাবিক যে প্রশ্নটা উঠে আসবে তা হল একই দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় অন্য দুটি হেলিকপ্টার নিরাপদে অবতরণ করলেও প্রেসিডেন্টেরটা পারল না কেন? প্রেসিডেন্টের হেলিকপ্টার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য এবং পাইলট সবচেয়ে চৌকষ হওয়ারই কথা।
সেনাবাহিনীতে বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামে দীর্ঘ সময় এবং আফ্রিকার কঙ্গোতে শান্তিরক্ষী হিসাবে নিয়োজিত থাকার কারণে আমার হেলিকপ্টারে বহু শতবার উড়ালের অভিজ্ঞতা আছে। বিশেষজ্ঞ না হলেও সে অভিজ্ঞতায় দেখেছি পাইলট দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া আঁচ করতে পারলে কন্ট্রোলে যোগাযোগ করে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা গ্রহণ করে এবং সে অনুযায়ী পথ অনুসরণ করে। ১৯৮৮ সালে এরকম এক ঘটনা, রেড এলার্ট ছিল, অর্থাৎ উড়াল দেওয়া বারণ। খাগড়াছড়ি ব্রিগেডের তৎকালীন কমান্ডার অনেকটা অনুরোধ জোরাজুরি করে হেলিকপ্টারের দুই পাইলটকে খাগড়াছড়ির পথে উড়াল দিতে রাজী করান। যাত্রী আমি আর কমান্ডার। লক্ষীছড়ির আকাশে পৌঁছাতে প্রচণ্ড ঝড়ো হাওয়া সাথে বৃষ্টি। সে অবস্থায় পাহাড়ি পথে পাইলট দৃষ্টিহীন। অগত্যা পাইলট আমরা যে পথে গিয়েছি সে পথ ধরে নির্বিঘ্নে ফিরে আসে। ইরানী প্রেসিডেন্টের হেলিকপ্টারও ত একই প্রথা অনুসরণ করতে পারত। তবে এখানে রহস্য থেকে যায় বহরের অন্য দুটি হেলিকপ্টার দুর্য়োগ মোকবেলা করে এগিয়ে যেতে পেরেছে পারেনি প্রেসিডেন্টেরটা!
ইতিমধ্যে ইরানি গোয়েন্দা সংস্থা তাদের প্রেসিডেন্টের হেলিকপ্টার দুর্ঘটনা তদন্তে নিজেদের নিয়োজিত করেছে। আমি নিশ্চিত তাদের তদন্তে সন্দেহের প্রথম তীর থাকবে ইসরাইলীদের দিকে। কারণ মধ্যেপ্রাচ্য জুড়ে ইসরাইলী প্রভাব এবং স্বার্থের অন্যতম তথা প্রধান বাধা ইরান। এ বাধা দূর করতে ইবরাহিম রাইসীদের মত সাহসী এবং কট্টর ইসরাইল বিরোধীকে নিশ্চিহ্ন করতে ইসরাইল কোনও দুঃসাহসী পদক্ষেপ নিলে তাতে আশ্চর্য হওয়ার তেমন কোনও কারণ থাকবে না।
দ্বিতীয়ত ভারতকে চা–বাহার বন্দর ব্যবহার করতে দেওয়া। এ বিষয়টির প্রতিও তদন্তকারীরা নিশ্চিত দৃষ্টি রাখবেন। কারণ এ বন্দর ভারতকে ইরান হয়ে মধ্য এশিয় দেশগুলির সাথে যেমন বাণিজ্যের সুযোগ দিবে তেমনি রাশিয়ার সাথে ভারতের সরাসরি একটি বাণিজ্য পথও অবারিত করে দেবে। বর্তমানে রাশিয়ার সাথে ইউক্রেন যুদ্ধ ঘিরে আমেরিকার যে সম্পর্ক বিদ্যমান তাতে আমেরিকা ইরান–ভারতের এ পদক্ষেপ সহজে মেনে নেবে ভাবা যায় না।
তৃতীয়ত তদন্তকারীরা ইরানের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিকেও তদন্তের বাইরে রাখবেন বলে মনে হয় না। ইবরাহিম রাইসী ছিলেন আয়াতুল্লাহ খামেনির পর ইরানি সর্বোচ্চ নেতার আসনে আসীন হওয়ার জন্য প্রথম আলোচিত ব্যক্তি। এই সূত্রে তার বিরুদ্ধে একটি অভ্যন্তরীণ ক্ষমতাপ্রত্যাশী গোষ্ঠী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতে পারে।
তুর্কি যোগাযোগ এবং পরিবহন মন্ত্রীর একটি বক্তব্যের মূল সুরটা উল্লেখ করে শেষ করতে চাই। তার বক্তব্য হল, তারা যখন জানতে পারেন ইরানী প্রেসিডেন্টকে বহনকারী হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় পতিত হয়েছে, তখন তারা ঐ হেলিকপ্টারের উদ্দেশ্যে বার্তা প্রেরণ করেন, তখন দেখা যায় হেলিকপ্টারটির সমস্ত সিগন্যাল তথা বার্তা আদান প্রদান সিস্টেম বন্ধ। তার মতে এটি একটি অস্বাভাবিক ঘটনা, কোন অবস্থাতেই প্রেসিডেন্টকে বহনকারী হেলিকপ্টারের সিগন্যাল সিস্টেম বন্ধ থাকার কথা নয়। সর্বশেষ আশ্চর্য এবং সন্দেহের বিষয় ঐ হেলিকপ্টার থেকে কোনও প্রকার ‘মে ডে’ বা ‘এস ও এস” অর্থাৎ আমাদের বাঁচান বার্তাও আসেনি। এটিও আকাশ পরিবহন বিশেষজ্ঞদের মাঝে প্রশ্নের অবতারনা করেছে।
লেখক: প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট; সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক।