সমকালের দর্পণ

‘হামাস’ এর উত্থান – তার সামরিক শক্তি

মেজর মোহাম্মদ এমদাদুল ইসলাম (অব.) | রবিবার , ১৯ মে, ২০২৪ at ১০:২৬ পূর্বাহ্ণ

হামাস’। ফিলিস্তিনিদের উপর ক্রমাগত নিপীড়ন, হত্যা, উৎখাতের প্রতিবাদে আর প্রতিরোধে হামাসের জন্ম। বর্তমান গাজা যুদ্ধের কারণে বিশ্বে এখন সবচেয়ে আলোচিত নাম ‘হামাস’। অনেকটা মিসরীয় ব্রাদারহুড কর্তৃক অনুপ্রাণিত শেখ আহাম্মদ ইয়াসিন ১৯৮৭ সালে হামাস গঠনে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেন। এই আহাম্মদ ইয়াসিনও ছিলেন তখন স্বীয় বাসভূমি থেকে বিতাড়িত উদ্বাস্ত্তু। ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনি ভূমিতে ইসরাইল প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিলে লক্ষ লক্ষ ফিলিস্তিনির মত তিনিও উদ্বাস্ত্তু হন। ইসরাইলী মিলিশিয়ারা পাশ্চাত্যের বিশেষ করে আমেরিকার মদদে ফিলিস্তিনিদের নিজ ভূমি থেকে ব্যাপক হারে উৎখাত করে। অত্যাচার নিপীড়ন উৎখাত ইত্যাদির চলমান প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে ১৯৯৩ সালে ইসরাইল আর ফিলিস্তিনীদের মধ্যে ওসলো চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুযায়ী স্বাধীন ফিলিস্তিন গঠন ত দূরের কথা ঐ চুক্তির সুযোগ নিয়ে ইসরাইলীরা ১৯৬৭ সালে দখল করা ফিলিস্তিনি ভূমি আরো আরো দখলে নিতে থাকে। বহু সংখ্যক ফিলিস্তিনিকে ইসরাইলীরা বাস্ত্তুচ্যুত করে স্ব ভূমি থেকে বিতাড়ন করে। এ অবস্থায় হামাস তার সর্বশক্তি নিয়ে ইসরাইলীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। এই রুখে দাঁড়াতে গিয়ে তারা তাদের সামরিক শাখা ‘কাসেম ব্রিগেড’ গড়ে তোলে। ইসরাইলীরা হামাসের পক্ষ থেকে বিপদ অনুধাবন করে। ইসরাইলী সেনাবাহিনী ২০০৪ সালের ২২ মার্চ প্রত্যুষে শেখ আহাম্মদ ইয়াসিন গাজার এক মসজিদ থেকে ফজরের নামাজান্তে যখন বের হন তখন তাকে হত্যা করে। আহাম্মদ ইয়াসিনের সেকেন্ড ইন কমান্ড আবদুল আজিজ রানতাসি তখন হামাসের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

হামাস প্রয়োজনে সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে ফিলিস্তিনিদের ব্যাপক সর্মথন আদায়ে সর্মথ হয়। ফলস্বরূপ ২০০৬ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে গাজায় বিপুল ভোটে হামাস জয়ী হয়। গণতন্ত্রের প্রবক্তা আমেরিকার নেতৃত্বে পাশ্চাত্য সেই থেকে গাজা তথা হামাসের উপর সর্বাত্বক অবরোধ আরোপ করে। ইতিহাসের কি নির্মম উপহাস! গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিতরা গণতন্ত্রের পূজারীদের দ্বারা অবরুদ্ধ।

হামাস অবরোধে থেমে না থেকে প্রতিরোধে নিজেদের সর্বাত্মকভাবে তৈরী করতে থাকে। কাসেম ব্রিগেড ক্রমাগত নিজেদের শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে। হামাসের সামরিক বাহিনী ‘কাসেম ব্রিগেড’ নাম ধারণ করার পিছনেও একটি ঐতিহাসিক বিষয় নিহিত আছে। সিরিয়ান মুক্তিযোদ্ধা ইজ্জাদিন আলকাসেমকে সিরিয় মুক্তি আন্দোলনে অংশ নেওয়ার কারণে ফরাসী ঔপনেবেশিক শক্তি সিরিয়া থেকে ফিলিস্তিনে বিতাড়ন করে। কাসেম ফিলিস্তিনে এসে সেখানেও ফিলিস্তিনীদের পক্ষ নিয়ে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে স্বশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে তোলেন। ১৯৩৫ সালে বৃটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি কাসেমকে হত্যা করে। এ হত্যাকাণ্ডের জের ধরে ১৯৩৫৩৯ পর্যন্ত প্যালেস্টাইনে বৃটিশ সাম্রজ্যবাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিরোধ এবং বিদ্রোহ সংগঠিত হয়।

ইজ্জাদিন আলকাসেমকে স্মরণে রেখে হামাস ইসরাইলীদের অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে ক্রমাগত প্রতিরোধ আর আক্রমণ পরিচালনা করে আসছে। বর্তমানে কাসেম ব্রিগেড স্বল্প পাল্লার মিসাইল, ইম্প্রুভাইস এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস, মর্টার, এ্যান্টি ট্যাংক ওয়েপন ইত্যাদি তৈরীতে দারুণ অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছে। হামাসের সবচেয়ে চমক লাগানো বিষয় তাদের ‘ট্যানেল’ রণ কৌশল, যেখানে ইসরাইলীরা এখনও পর্যন্ত অসহায়। হামাসের যোদ্ধার সংখ্যা বর্তমানে ৩০,০০০ (ত্রিশ হাজার) এর মত।

বর্তমানে হামাসের রাজনৈতিক শাখার নেতৃত্ব দিচ্ছেন ইসমাইল হানিয়া। তিনি ২০০৭ সাল থেকে এ দায়িত্ব পালন করে আসছেন। এর আগে এ দায়িত্ব পালন করেন খালেদ মিশাল।

৭ অক্টোবর ২০২৩ হামাস কেন ইসরাইলীদের উপর আক্রমণ পরিচালনা করেছে? এ প্রশ্ন অনেকের। বিশেষ করে অনেক পশ্চিমা পণ্ডিত বর্তমানে গাজায় চলমান ইসরাইলীদের বর্বর নৃশংস আক্রমণের অজুহাত হিসাবে তুলে ধরতে সচেষ্ট। কেন এ ৭ অক্টোবরের এ আক্রমণ? প্রশ্নের উত্তরে কাসেম ব্রিগেড কমান্ডার বলেন ‘ক্রমাগত মুসলমানদের তৃতীয় পবিত্রতম স্থান মসজিদে আল আকসার পবিত্রতা লঙ্ঘন, ইসরাইলী সেটেলারদের দ্বারা ফিলিস্তিনি ভূমি দখল, হাজার হাজার নিরপরাধ ফিলিস্তিনীদের অমানবিক নির্যাতন এবং কারাগারে নিক্ষেপ ইত্যাদির প্রতিবাদ এবং নিরোধে এই আক্রমণ’।

এই বক্তব্যের বাইরেও কোনও কোনও রাজনৈতিক ভাষ্যকার মনে করেন ফিলিস্তিনিদের অধিকার তথা ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের বিষয়টি একপাশে রেখে পাশ্চাত্যের প্রভাবে মধ্যেপ্রাচ্যের দেশগুলি যেভাবে একে একে ইসরাইলকে স্বীকৃতি দানের মাধ্যমে ইসরাইলের সাথে স্বাভাবিক সর্ম্পক স্থাপন করা শুরু করেছিল তার থেকে এসব দেশকে বিরত রাখার কৌশল হিসাবেও হামাস এ আক্রমণ পরিচালনা করে থাকতে পারে। তবে ঘটনা যেটিই হোক এ প্রসঙ্গে কাসেম ব্রিগেড কমান্ডার দায়েফ এর বক্তব্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। দায়েফ উল্লেখ করেছেন ‘দিস ইস দি ডে অব দি গ্রেটেস্ট ব্যাটেল টু এ্যান্ড দি লাস্ট ওকুপেশন অন আর্থ’ অর্থাৎ এ যুদ্ধ পৃথিবীর বুকে শেষ দখলদারিত্ব মুছে দেওয়ার যুদ্ধ।

আজ এ লেখাটি লিখতে বসে জর্জ হাবাসের ‘ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর’ এর যোদ্ধাদের কথা মনে পড়ছে, যারা দলে দলে জীবন দিয়ে একটি স্বাধীন মাতৃভূমি প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল। লায়লা খালেদ, দুরন্ত সাহসে একটির পর একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিল তাও একটি স্বাধীন প্যালেস্টাইন রাষ্ট্রের স্বপ্নে। হাজার হাজার ফিলিস্তিনি তরুণ যারা স্বাধীনভাবে বাঁচার জন্য জীবন মৃত্যুকে পায়ের ভৃত্য করেছে সেই তরুণদের কথা ভেবে বেদনায় অন্তর ভরে উঠছে। সেইসব দুঃখিনী ফিলিস্তিনী মায়েদের কথা ভাবতেও কেমন জানি অনুভূতির সব শিরদাঁড়া খাড়া হয়ে যায়, যারা কষ্ট করে সন্তান ধারণ এবং জন্ম দেন আবার যুদ্ধের মাঠ থেকে লাশ হয়ে আসা সেই সন্তানকে তাদের কবরও দিতে হচ্ছে এখন। হতভাগ্য ফিলিস্তিনি বিশেষ করে গাজার পুরুষদের এখন দিনে পাঁচ ওয়াক্তের জায়গায় ছয় ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতে হয়, ফজর, জোহর, আছর, মাগরিব, এশা আর জানাযা। কী দুর্ভাগ্য মানুষের। ১৪ মে ২৪ সংবাদ মাধ্যম আল জাজিরা তাদের সংবাদ প্রবাহে বারবার দেখাচ্ছিল, গাজার দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষের জন্য প্রেরিত খাদ্য সামগ্রী কীভাবে গাজায় বসতি স্থাপনকারী ইহুদি উগ্রবাদীরা ত্রাণবাহী গাড়িসমূহ আক্রমণ করে একের পর এক নষ্ট করছে। অন্যদিকে রাফা আক্রমণে ইসরাইলী বাহিনী যখন গাজার আল নাসের হাসপাতাল ছেড়ে এসেছে সেখানে ইসরাইলীদের দ্বারা সংঘটিত গণহত্যার প্রমাণ একের পর এক গণ কবর আবিষ্কৃত হচ্ছে।

সভ্য পৃথিবী কেবল নীরব দর্শক। এত কিছুর পরও আশার কথা হামাস অপরাজেয় থাকবে, এটি আমার নয় মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী এ্যান্টনি ব্লিংকেনর কথা।

………………..

লেখার শিরোনামের বাইরে গিয়ে এখন দু একটি মনোবেদনার কথা প্রকাশ করতে চাই। আমি জানি না আমাদের জাতির মনন আর মনস্তত্বে ভবিষ্যৎএ এ ঘটনাগুলির প্রতিফলন কীভাবে ঘটবে। কীভাবে এ জাতির ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এ ঘটনা গুলি তাদের ভবিষ্যৎ পথ চলায় পাথেয় করবে! প্রথম ঘটনা ১২ মার্চ ২০২৪ এম ভি আবদুল্লা নামক একটি বেসরকারি পণ্যবাহী জাহাজ সোমালিয় উপকূলে জলদুস্যদের কবলে পড়ে জিম্মি হয়। ৩ এপ্রিল ২০২৪ জাহাজটি জলদুস্যদের কবল মুক্ত হয়। এই দীর্ঘ জিম্মি সময়ে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায় নানা আলাপ আলোচনার ফলশ্রুতি ৪ থেকে ৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (সেই ডলার জলদুস্যদের উদ্দেশ্য হেলিকপ্টার যোগে নিক্ষেপ করার দৃশ্যও আমরা দেখেছি) মুক্তিপণ দিয়ে অবশেষে জাহাজ এবং তার নাবিকরা মুক্ত হয়। এই মুক্তি জাহাজ মালিক এবং নাবিকদের আত্মীয় স্বজন সবার উৎফুল্ল হওয়ার যৌক্তিক কারণ রয়েছে। তবে আমাদের ইলেক্ট্রনিক এবং প্রিন্ট মিডিয়া এ ঘটনাকে যেভাবে প্রতিদিন তাদের শিরোনাম করেছে তা আমাদের গৌরাবান্বিত না করে প্রতিদিন অপমানবোধের জ্বালাই বাড়িয়েছে। এ প্রচারের কয়েকটি নমুনা যেমন, এম ভি আবদুল্লা আজ দুবাই এসে পৌঁছেছে, আবদল্লা আজ কতুবদিয়ায় নোঙ্গর করেছে অবশেষে যেন বহিঃশক্র দ্বারা আক্রান্ত বঙ্গোপসাগর থেকে সব শক্র ধ্বংস করে আবদুল্লা ১৪ মে চট্টগ্রাম বন্দরে এসে নোঙ্গর করে। আমাদের সামরিক বে সামরিক নেতারা বন্দরে আবদুল্লা’কে অভ্যর্থনা জানাতে উপস্থিত হয়েছেন বৈশাখের এই চরম আদ্রতাকেও উপেক্ষা করে। মিডিয়ার ত কথাই নেই যেন কতবার কামান দেখেছেন কীভাবে শক্রকে এভাবে নিশ্চিহ্ন করলেন! নাবিকরাও যেন বলছেন গোলাগুলির খুব বেশি প্রয়োজন হয়নি ডলার মেরেই কাবু করে ফেলেছি!

দ্বিতীয় ঘটনা। এপ্রিলের ৩ এবং ৪ কুকি চিন নামক একটি গোষ্ঠীর কিছু সশস্ত্র সদস্য প্রথম দিন রুমা এবং দ্বিতীয় দিন থানচিতে ব্যাংক ডাকাতির চেষ্ঠা করে। আর যাবি কোথায় আমরা সকল পক্ষ এই ঘটনাকে এমন ভাবে প্রচারে নেমে গেলাম যেন বান্দরবান অঞ্চলে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের কোনও কর্তৃত্বই আর অবশিষ্ট নেই। আমার মনে হয় না এ দুটি ঘটনা আমরা যেভাবে জাতির সামনে নিয়ে এসেছি তা একটি জাতির গৌরবান্বিত মনন গঠনের জন্য কোনও উপকারে আসবে।

আমি একজন প্রাক্তন সেনা কর্মকর্তা বলে নয়, এ দেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসাবে বলছি, আজ যদি এমন হত, ইরানইরাক যুদ্ধের ভয়াবহতার মাঝেও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অকুতোভয় সদস্যরা শান্তি স্থাপন করে স্বদেশে ফিরে এসেছে, সদূর আফ্রিকার নামিবিয়া, সোমালিয়া, লাইবেরিয়া, মোজাম্বিক, সিয়েরা লিওন, কঙ্গো, এঙ্গোলা, আইভরি কোস্ট. সুদান, ইথিওপিয়া, পূর্ব সাহারার মত দেশে দেশে আমাদের সেনাবাহিনী স্বগৌরবে অভিযান চালিয়ে শান্তি স্থাপন করে ফিরেছে, আভিজাত্যের অহমিকার অঞ্জন পরা ইউরোপের তাজিকিস্তান, জর্জিয়া, কসভো, সুদূর আমেরিকার হাইতি এশিয়ার কাম্বোডিয়া, কুয়েত, পূর্ব তিমোরে আমাদের সেনাবাহিনীর অমন সাহসী বীরেরা গৌরবের পদচিহ্ন রেখে এসেছে। আমাদের এইসব অর্জন যদি জাতি পালন করত উল্লাসে উৎসবে তবে আমার মনে হয় আমরা আগামী প্রজন্মের জন্য মাথা নত না করে পথ চলার একটি পথরেখা রেখে যেতে পারতাম। বিষয়টি জাতির মনন নির্মাণে, জাতির নেতৃত্বে যারা তাদের অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে। অন্যতায় এম ভি আবদল্লাহ হয়ে ভবিষ্যৎ এ জাতি জিম্মি হবে আর মুক্তিপণ দিয়ে দিয়ে পথ চলবে।

লেখক: প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট; সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধওষুধের মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতা রুখতে কতিপয় সুপারিশ ও প্রস্তাবনা
পরবর্তী নিবন্ধরাঙ্গুনিয়ার দুই শতাধিক শিক্ষার্থী পেল মেধাবৃত্তি পুরস্কার