সমকালের দর্পণ

গাজায় গণহত্যা : তারুণ্যের উত্থিত বিবেক

মেজর মোহাম্মদ এমদাদুল ইসলাম (অব.) | রবিবার , ১২ মে, ২০২৪ at ১১:৩৭ পূর্বাহ্ণ

অবশেষে এই শতাব্দীর মানুষদের আগামী বহু শতাব্দীর মানুষের কাছে হেয় হয়ে থাকার হাত থেকে রক্ষা করেছেন প্রথমত আমেরিকার কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবেকবান ছাত্রছাত্রীরা। কলম্বিয়ার ছাত্রছাত্রীরা গাজার মানুষদের উপর ইসরাইলের নির্মম বর্বরতার প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠে সে প্রতিবাদের ঢেউ ছড়িয়ে দিয়েছে দিকে দিকে। এদেরকে অনুসরণ করে ক্রমান্বয়ে একে একে হার্ভার্ড, ইয়েল, অস্ট্রেলিয়ার সিডনীসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, দক্ষিণ আফ্রিকীয় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় সমূহ, কিউবার হাভানা বিশ্ববিদ্যালয়, মেক্সিকোর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, স্পেনের বিশ্ববিদ্যালয় সমূহ, অক্সফোর্ড, কেমব্রিজও প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠেছে।

এখানে উল্লেখ্য পৃথিবীর চিন্তাচেতনায় সবচেয়ে অগ্রসরমান মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে উল্লেখিত বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের প্রাঙ্গণ মুখরিত। এদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া নিঃসন্দেহে আগামীর পৃথিবীর জন্য আশা এবং শুভ বার্তাই বহন করে।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য আমেরিকার আজকের মত সেই সময়ের যুদ্ধবাজ নেতাদেরও বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে ১৯৬৮সালে ভিয়েৎনাম যুদ্ধের প্রতিবাদে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা প্রতিবাদে মুখর হয়েছিল। যদিও এ যুদ্ধ ছিল সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব বনাম পুঁিজবাদী বিশ্ব ব্যবস্থার মধ্যে। কিন্ত্তু ভিয়েৎনাম যুদ্ধে আমেরিকা যে বর্বরতা, নৃসংশতা প্রদর্শন করছিল তার প্রতিবাদে কলম্বিয়ার ছাত্রছাত্রীরা পথে নেমেছিল।

১৯৮৫ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় চলমান বর্ণবাদের বিরুদ্ধে এই কলম্বিয়ার ছাত্রছাত্রীরাই প্রতিবাদে ফেটে পড়েছিল। তারা সে সময়ও আজকের মত হ্যামিলন্টন হল দখলে নিয়েছিল। তিন সপ্তাহ দখলে রেখে হ্যামিল্টন থেকে সে প্রতিবাদের ঢেউ আমেরিকা ছাড়িয়ে পৃথিবীময় ছড়িয়ে পড়েছিল এক সময়। অবশেষে দক্ষিণ আফ্রিকায় সভ্যমানুষদের জন্য কলংক মানুষে মানুষে ভেদাভেদ বর্ণবাদের অবসান ঘটে। আফ্রিকার মানুষ পরিশেষে মানুষ সৃষ্ট অভিশাপ মুক্ত হয়।

আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের ছাত্রছাত্রীরা বর্তমানে তাদের প্রতিবাদের উচ্চকণ্ঠ দাবীতে একটি বিষয়কে সামনে নিয়ে এসেছে, তা হল তাদের বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের আয় লব্দ অর্থ কোন অবস্থাতেই ইসরাইলী যুদ্ধের ব্যয় বহনে নিয়োজিত হতে পারবে না। এজন্য ইসরাইলী যে কোনো ধরনের অর্থ বিনিয়োগ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় সমূহকে নিবৃত্ত থাকার দাবী জানান ছাত্রছাত্রীরা। এই সূত্রে ইসরাইলীদের সাথে সমস্ত সম্পর্ক চুকিয়ে ফেলেেতও ছাত্রছাত্রীরা দাবী জানিয়ে যাচ্ছেন। এ প্রেক্ষাপটে কোনও কোনও বিশ্ববিদ্যালয় ভোটাভুটির আয়োজন করে। এসব ভোটে দেখা গেছে শতকরা ৯০% ছাত্রছাত্রী ইসরাইলীদের সাথে সমর্থন চুকিয়ে ফেলার পক্ষে মতামত দিয়েছে।

আর্শ্চয্যের বিষয় হল একটি চরম অন্যায়ের প্রতিবাদরত ছাত্রছাত্রীদের উপর আমেরিকান কর্তৃপক্ষ পুলিশ লেলিয়ে দিয়ে তা দমন করার প্রয়াশ পেয়েছে। অথচ আমেরিকার সংবিধানের প্রিয়াম্বল তথা সূচনাপর্বে উল্লেখ আছে ‘ইট ইজ এ্যা কান্ট্রি অব ফ্রি এন্ড ব্রেইভ’ এখানে মানুষের বাক স্বাধীনতা, মুক্ত চিন্তা, ইত্যাদিকে উচ্চে তুলে ধরার কথা শুধু বলাই হয় না বরং বিশ্বব্যাপী আমেরিকানরা তা জোরালোভাবে প্রতিষ্ঠায় নানা শক্তি প্রয়োগেও নিজেদের নিয়োজিত করেন। অথচ পরিতাপের বিষয় হল সেই আমেরিকাতেই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা যখন গাজায় চলমান এক মানবিক দুর্যোগ এবং চরম অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে তাদের ক্যাম্পাসগুলিতে প্রতিবাদ মুখর হল তখন তাদের হাজারে হাজারে কারাবরণ করতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার হুমকিতে পড়তে হয়। সব চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক, বিভিন্ন কর্পোরেট সংস্থাগুলির সি ই ও’দের মাধ্যমে বিভিন্ন টি ভি চ্যানেল সমূহে প্রচার চালানো হচ্ছে আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের তারা তাদের প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দানে উৎসাহী হবেন না। কি নির্মম আচরণ বিবেকবানদের সাথে। এ থেকে আর কিছু না হোক আমেরিকান কর্পোরেট ইহুদিবাদী প্রতিষ্ঠানগুলি নিজেদের বিবেক বর্জিত অমানবিক হিসেবেই নিজেদের চিহ্নিত করে রাখবে।

ছাত্রছাত্রীদের যুদ্ধ বিরোধী এবং অবিলম্বে যুদ্ধ বিরতির দাবীতে প্রচণ্ড আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেন ‘ছাত্রদের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে আপনার ইসলাইকে সমর্থন দানের নীতির কোনও পরিবর্তন হবে কি না ?’ তার নির্লিপ্ত উত্তর ‘না’।

এ ‘না’ শব্দটির মধ্যেই নিহিত আছে অনেক হ্যাঁ।

যেমন ইসরাইলকে গাজায় হত্যাকাণ্ড চালানোর জন্য আরো কি অর্থ সাহায্য দেওয়া হবে, হ্যাঁ। আরো ২৬ বিলিয়ন ডলার মারণাস্ত্র ক্রয়ের জন্য ইতিমধ্যে দেওয়া হয়েছে।

গাজায় ৩৫,০০০ (পঁয়ত্রিশ হাজার) মানুষ ইসরাইলীদের হাতে নিহত হয়েছে, যার মধ্যে ১৪,০০০ শিশু এরপরও কি ইসরাইলকে আরো হত্যাকাণ্ড চালাতে দেওয়া হবে? হ্যাঁ।

গাজায় যে কয়টা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল ইসরাইলী বোমাবর্ষণে সবকয়টি ধ্বংস হয়েছে। এর পরও ইসরাইলকে গাজায় আরো বোমাবর্ষণ করায় উৎসাহিত করা হবে? হ্যাঁ।

ইসরাইলী বোমা বর্ষণে গাজার মানুষের ৭০% বাড়িঘর ধ্বংসস্ত্তূপে পরিণত করা হয়েছে, বাকী ৩০%ও কি ধ্বংস করা হবে, হ্যাঁ। গাজায় বুভুক্ষু অসহায় মানুষের খাবার নেই। ত্রাণবাহী কনভয় ইসরাইলীরা আটকে দিচ্ছে। ক্ষুধার্ত মানুষের জন্য ত্রাণ সরবরাহ কি এভাবে বাধাগ্রস্ত করা হবে? হ্যাঁ। পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনীদের ইহুদি বসতি স্থাপনকারীরা প্রতিদিনই আক্রমণ করে ক্রমান্বয়ে তাদের ঘরবাড়ি ছাড়া করছে। এ অন্যায় কি চলতে থাকবে? হ্যাঁ। গাজায় ৭৪ (চুয়াত্তর) হাজার মানুষের কোনও চিকিৎসা ব্যবস্থা নেই। গাজায় বিদ্যুৎ নেই। পান করার পানি নেই। এসব অনাচার কি চলতে থাকবে? হ্যাঁ।

গাজায় সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে ইসরাইলীদের হাতে ১০০ জনেরও বেশি সংবাদকর্মী নিহত হয়েছেন। ২০০ মত ত্রাণকর্মী গাজায় ইসরাইলী হত্যাকাণ্ডের শিকারে পরিণত হয়েছেন। ইতিমধ্যে গাজায় ইসরাইলীদের যাবতীয় নির্যাতনের, হত্যাকাণ্ডের, ধ্বংসলীলার খবরাখবর অত্যন্ত গুরুত্ব এবং তাৎক্ষণিক পরিবেশনকারী সংবাদসংস্থা গুলির অন্যতম আল জাজিরাকে ইসরাইলীরা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। বর্ণিত এসব বিষয় কি ন্যায়, এসব কি সভ্য পৃথিবী চলতে দিতে পারে? ছাত্রছাত্রীদের দাবীর মুখে নীতি পরিবর্তন হবে কি না? এ প্রশ্নের উত্তরে আমেরিকার প্রেসিডেন্টের সেই ‘না’ এর মাঝে যে ‘হ্যা’। এখানেও উত্তর হবে হ্যাঁ ইসরাইলের সব কিছু চলতে পারে। রাফা আক্রমণ করে আরো ৫০,০০০ মানুষ হত্যা করা হলেও তাও অন্যায় কিছু হবে না। এটাও মেনে নিতে বাধা নেই পাশ্চাত্যের। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানী, ফ্রান্স এক সুরে রব তুলবে রাফাতে সাধারণ মানুষের সাথে হামাসের যোদ্ধারা একাকার হয়ে আছে তাই এ হত্যাকাণ্ড, এ ত ‘কো লেট্যারাল ডেমেজ’। কী করার আছে হামাস যোদ্ধারা ওখানে লুকিয়ে আছে তাই সাধারণ নারী শিশু পুরুষ মহিলারও সহমরণ।

পাশ্চাত্যের নীতিহীনতা দ্বিচারিতা আর দেউলিয়াত্বকে গাজা যুদ্ধ একেবারে উলঙ্গ করে ছেড়েছে। দীর্ঘ ৭০ বছর ধরে ফিলিস্তিনীদের উপর চালানো স্টিম রোলার, ফিলিস্তিনীদের নিজেদের বাস্তুভিটা থেকে উচ্ছেদ করা, লক্ষ লক্ষ ফিলিস্তিনিদের যুগের পর যুগ শরণার্থী জীবন, ফিলিস্তিনিদের উপর চালানো হত্যা নির্যাতন নিপীড়ন কিছুই পশ্চিমারা কখনো অন্যায় মনে করেনি। প্রতিক্রিয়ায় ৮ অক্টোবর ২৩ হামাসের অভিযান এখন পাশ্চাত্যের কাছে সব সমস্যার মূল হয়ে গেছে। সেদিন এরই উলঙ্গ বহিঃপ্রকাশ দেখলাম আমেরিকার একসময়ের ফার্স্ট লেডি পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট ওবামার পররাষ্ট্র মন্ত্রী হিলারী ক্লিন্টন এক সেমিনারে জোর গলায় বলছেন, ‘আমার স্বামী বিল ক্লিটন ক্যাম্প ডেভিডে দুই রাষ্ট্রের যে সমাধান দিয়েছিলেন ইয়াসীর আরাফাত তা মেনে নিলে বর্তমানে ফিলিস্তিনী রাষ্ট্রের বয়স হত ২৩ বছর’। হিলারী ক্লিন্টন ক্যাম্প ডেভিডে সেদিন আমেরিকানরা ইয়াসির আরাফাত কে দিয়ে ফিলিস্তিনীদের যে কবর রচনা করতে চেয়েছিলেন তার বিন্দু মাত্রও উল্লেখ করেননি। ক্যাম্প ডেভিডে সেদিন যে চুক্তিতে উপনীত হতে ইয়াসির আরাফাতের উপর চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল তাতে পশ্চিম তীর গাজা নিয়ে ফিলিস্তিনী রাষ্ট্রের কথা বলা হয়েছিল যার মাঝে জেরুজালেমের বিষয়ে কিছুই উল্লেখ ছিলো না উপরন্ত্তু শর্ত ছিল উদ্বাস্ত্তু কোনও ফিলিস্তিনী শরণার্থী তার হারানো বাসভূমিতে কোনও দিন ফিরতে পারবে না। ইয়াসির আরাফাত তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করেছিলেন। সেই সত্য তুলে না ধরে হিলারী ক্লিন্টন এখনও ইয়াসির আরাফাতের উপর দোষ চাপানোর চেষ্টায় মগ্ন, ইতিহাসের কি নির্মম পরিহাস।

এবার আসি আমেরিকা ইউরোপে তো পৃথিবীর সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলির দুরন্ত সব মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা গাজার অন্যায় যুদ্ধ অবিচারের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছে। এ প্রসঙ্গে আজ বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়ে প্রত্যক্ষ করছি কোথায় গেল আরব বসন্ত? গাজায় মাসের পর মাস হত্যাযজ্ঞ আর আরব দেশগুলির কি নিস্তব্ধ নীরবতার সাথে তা অবলোকন। আহা আরবরা তোমরা কি দেখছ না তোমাদের শিশুরা হাজারে হাজারে মরছে অনাদরে, তোমাদের বিত্ত বৈভবের দ্বারে তোমাদের বুভুক্ষু ভাইয়েরা হাত পাতছে সামান্য সাহয্যের আশায়! কী দুর্বোধ্য ভূরাজনীতি, কী দুর্বোধ্য ক্ষমতা লিপ্সা।

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মননে চেতনায়ও কি অবক্ষয়ের ধূলা জমেনি? এ ধূলা ঝারতে হবে না হলে ভবিষ্যৎ অন্ধকার।

লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট; সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধদূরের দুরবিনে