মানুষের সৃষ্টিশীলতা আমাকে আজন্ম মুগ্ধ করেছে। প্রকৃতির নানা সুরকে মানুষ তার মাঝে আত্মস্থ করে নিজে সে সুরকে বাঙময় করে তুলতে বিভিন্ন অনুসঙ্গ তৈরি করে নিয়েছে। এসবের মাঝে গিটার, ভায়োলিন, ঢোল, তবলা, সানাই, সেতার, বাঁশি, বেহালা আরো কত কি। মানুষের তৈরি সুরের অনুসঙ্গ কে সঙ্গী করে মানুষ যুগে যুগে সৃষ্টি করেছে এক মোহন সুরের জগৎ। মানুষের তোলা সুর এই যেমন ইকুয়েডরিয়ান লিও রোজার বাশেঁর বাঁিশর সুর কনডর পর্বতমালার স্বর্গীয় ঈগলদের পাখায় পাখায় কি বিষাদ যে ছড়ায় তা ঐ সুরে যারা মগ্ন হয়েছেন তারা জানেন। ইয়ান্নির তোলা সুরে অজস্র মানুষ বিমুগ্ধ থেকেছে বহুদিন থেকে। আমাদের এ উপ–মহাদেশের রবি শংকরের সেতার ইয়াহুদি মেনহুইনের সাথে যুগল বন্দী হয়ে মানুষকে ভাসিয়েছে আনন্দ বেদনার বন্যায়। ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খানের সানাইয়ের সুর মানুষকে বিমুগ্ধ বেদনায় আচ্ছন্ন করেছে। লালন – শাহ আবদুল করিম কি এক মরমীয়া বিচ্ছেদ বেদনায় ডুবে মানুষকে নিয়ে যান অদেখা এক ভুবনে। এই মানুষই আবার সৃষ্টি করেছেন পারমানবিক অস্ত্র, হাইপারসনিক মিসাইল, সাবমেরিন, জঙ্গী বিমান। এসবই মানুষ মারার জন্য। মানুষ মারার জন্য বললে ভুল হবে, লক্ষ মানুষকে এইসব অস্ত্র ব্যবহার করে নির্বিচার হত্যা করা হয়েছে। এটা করা হয়েছে নাগাসাকি–হিরোসিমাতে হয়েছে ভিয়েৎনাম, কম্বোডিয়া, আফগানিস্তান, ইরাক, ইরান, ইয়েমেন, লেবাননে। এখন চলছে ইউক্রেন এবং গাজায়। মানুষের এই যে সৃষ্টিশীলতা আবার ধ্বংসের তান্ডবলীলা এ যেন মানুষের উলঙ্গ দ্বি–চারিতা। রাশিয়ার ইউক্রেন অভিযান দু বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। গাজা যুদ্ধ পাঁচ মাস পেরিয়ে গেছে। ভয়াবহতা হত্যালীলায় আর মর্মান্তিকতায় ইসরাইলের গাজা আক্রমণ মানুষের ইতিহাসে এক নারকীয় অধ্যায় হিসাবে বিবেচিত হবে নিশ্চিতভাবে।
ইউক্রেন গাজা উভয় ক্ষেত্রে যুদ্ধের ইন্ধন যুগিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব ব্যাপী গণতন্ত্রের প্রবক্তা। আমাদের দেশেও কার্যকর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ঢাকাস্থ যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত কত না দৌড়ঝাঁপ করেছেন। অথচ এর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমরা যদি অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি রাখি তাহলে মনে প্রশ্ন জাগে মিসরে কি হয়েছিল? মুরশি মিসরের গণতান্ত্রিকভাবে নির্ব্বাচিত প্রেসিডেন্ট। রাতারাতি গণ–অভ্যুত্থানের নামে মুরশিকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। ক্ষমতায় বসানো হয় অর্নিবাচিত সামরিক বাহিনী প্রধান জেনারেল সিসি’কে। নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে মরতে হয়েছে কারাভ্যন্তরে। অতি সম্প্রতি পাকিস্তানে আমরা কি দেখেছি। গণতান্ত্রিকভাবে র্ন্বিাচিত প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে পছন্দ হয়নি বলে তথা কথিত পার্লামেন্টারী ক্যূ এর মাধ্যমে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। এ দু ক্ষেত্রে পিছন থেকে কলকাটি নেড়েছে মার্কিনীরা।
ফিরে আসি ইউক্রেনে। ইতোমধ্যে ইউক্রেন তাদের বিশাল ভূ–খণ্ড রাশিয়ার কাছে হারিয়েছে। শুরুতে পশ্চিমাদের ইউক্রেনের পক্ষ নিয়ে যে হাঁকডাক এখন তাতে ভাল রকম নিরবতা নেমে আসছে। এ যেন নাটকের মঞ্চে ধীরে ধীরে যবনিকাপাতের মত। রাশিয়ার ইউক্রেন অভিযানের প্রথম প্রথম পাশ্চাত্য যে রকম অবরোধ সহ নানা হৈ চৈ তুলেছিল তা রাশিয়া তার কৌশল বলে অক্ষমের প্রলাপে পরিণত করেছে। ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যাবে ইতোপূর্বে দুইবার পাশ্চাত্য রাশিয়ায় অভিযান চালিয়েছিল। বলাবাহুল্য দু বারই পাশ্চাত্য রাশিয়ায় শোচনীয় অবস্থায় পড়ে পরাজিত হয়েছিল। এর একবার ফরাসী সম্রাট নেপোলিয়নের নেতৃত্বে ফরাসীদের রাশিয়া আক্রমণ আর দ্বিতীয়বার হিটলারের নেতৃত্বে জার্মানদের রাশিয়া অভিযান। এ দুটি অভিযান রাশিয়ানরা শুধু ব্যর্থই করেনি বরং তারা ইতিহাসের পাতায় যুদ্ধ কৌশলে অনেক বেশী পারঙ্গম হিসাবে নিজেদের অভিষিক্ত করেছেন। এর কারণ হিসাব সমরবিদরা যেটা উল্লেখ করেন তা হল রাশিয়ার আবহাওয়া, বিশাল ভূ–খণ্ড, সমরাস্ত্র তৈরির অফুরন্ত কাঁচামাল আর জীবন বাজি রেখে হার না মানা রাশিয়ান জাতি সত্তা।
ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হল কেন বা ইউক্রেন যুদ্ধের কারণ কি এ প্রশ্ন অনেকের মনে জাগতে পারে এবং জাগাটা অস্বাভাবিক নয়। ভূ–রাজনীতিতে যাদের আগ্রহ আছে তারা নিশ্চয় অবগত আছেন দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ শেষ হতে না হতেই ৪ এপ্রিল ১৯৪৯ ইউরোপিয় ১২ টি দেশকে সঙ্গী করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটো গঠন করে। এটি গঠনের পিছনের কারণ তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে নিজেদের নিরাপত্তা। এর কয়েক বছর যেতেই সোভিয়েত ইউনিয়ন পাল্টা ব্যবস্থা হিসাবে গড়ে তোলে “ওয়ারশ” জোট। ন্যাটো–ওয়ারশ জোটের পাল্লায় পড়ে পৃথিবী দ্বিধাবিভক্ত হয়। সোভিয়েত ব্লক আর আমেরিকান ব্লক। শুরু হয় বিশ্ব ব্যাপী স্নায়ু যুদ্ধ কাল। স্নায়ু যুদ্ধের দুর্বিষহ দ্বন্দ্বে পৃথিবীর দেশে দেশে নানা কূটচালে সরকারগুলির উত্থান পতন চলতে থাকে। এ প্রক্রিয়ায় পৃথিবী বহু রক্তপাতের সাক্ষী। এরই মধ্যে ১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে ক্ষমতার আসনে বসেন মিখাইল গর্বাচেভ। তিনি তার মতবাদ “গা্লসনট” তথা উন্মুক্তকরণ এবং “পেরেস্ত্রইকা” তথা পরির্বতন এর মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়নে নানা সংস্কারে নিবিষ্ঠ হন। অনেক পতনের মত একসময় সোভিয়েত ইউনিয়নেরও পতন সময় আসে। ২৬ ডিসেম্বর ১৯৯১ সোভিয়েত ইউনিয়ন বিলুপ্ত হয়। সোভিয়েত পূর্ববর্তী ১৫ টি রাষ্ট্র তাদের স্ব স্ব সত্তায় প্রত্যাবর্তন করে। এরই মধ্যে পৃথিবীর ইতিহাসে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে তার অন্যতম ৯ নভেম্বর ১৯৮৯ সালে বার্লিন ওয়াল’এর অবসান। এ দেওয়াল র্জামানীকে পূর্ব পশ্চিমে বিভক্ত করে ওয়ারশ আর ন্যাটোভুক্ত করে রেখেছিল। এক সময় আমি বার্লিন ওয়াল দেখতে গিয়ে মানুষের বোকামি দেখে মন খুলে হেসেছিলাম আবার বেদনাবোধ আমাকে আচ্ছন্নও করেছিল। এর কারণ অন্য সময় জানাব। বার্লিন প্রাচীর ভাঙার সময় মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী ছিলেন জেমস বেকার। বেকার সাহেব সে সময় ঘোষণা দেন “এখন স্নায়ু যুদ্বের অবসান হতে চলেছে, সুতরাং ন্যাটো আর তার পূর্ব মুখি সম্প্রসারণে আগ্রহী হবে না”। এই প্রেক্ষাপটে সোভিয়েতের গর্বাচেভ’রা ১ জুলাই ১৯৯১ ওয়ারশ জোটের অবসান ঘটান। ইতিহাসের নির্মম পরিহাস বার্লিন প্রাচীর ভাঙা হয়েছে, ওয়ারশ জোটের বিলুপ্তি হয়েছে কিন্ত্তু ন্যাটোর পুর্বমুখি সম্প্রসারণ থেমে থাকেনি, ন্যাটো’র অবসায়ন না হয়ে আরো ব্যাপ্ত হয়েছে। ন্যাটো তথা পাশ্চাত্য ক্রমাগত পোল্যান্ড, রুমানিয়া, বুলগেরিয়া, চেকোস্লাভিয়াকে নিজেদের প্রভাব বলয়ে অন্তর্ভুক্ত করেছে। এখানে থেমে না থেকে ন্যাটো আরো আগ বাড়িয়ে ইউক্রেনে সামরিক হস্তক্ষেপ করা শুরু করে। রাশিয়া যতই পাশ্চাত্যকে ইউক্রেনে হস্তক্ষেপ থেকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেছে পাশ্চাত্য তত বেশি আগ্রাসী ভূমিকা গ্রহণ করেছে। এরই পরিণতি ইউক্রেনে রাশিয়ান অভিযান। রাশিয়ানদের এ অভিযানের পরিণতিতে ইউক্রেন ইতোমধ্যে তাদের ধনবাস, মারিওপোল, ওদেসা সহ বিপুল ভূমি হারিয়েছে, বিধ্বস্ত হয়েছে অজস্র সামরিক বেসামরিক স্থাপনা। প্রায় এককোটি ইউক্রেনীয় উদ্বাস্ত্তু ইউরোপের দ্বারে দ্বারে আশ্রয়ের জন্য ধর্না দিয়ে যাচ্ছে। ইউক্রেন এবং রাশিয়ার লাখের কাছাকাছি সৈন্য এরই মধ্যে নিহত হয়েছে। ইউক্রেনকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ অব্যাহত রাখতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপিয় ইউনিয়ন সাধ্যমত সামরিক এবং আর্থিক সাহায্য করে যাচ্ছে। মানবতাবাদী পাশ্চাত্য একবারও কিন্ত্তু বলেনি এ যুদ্ধ কিভাবে থামানো যায়। এখানে এ যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার পিছনে পাশ্চাত্যের যে মনস্ত্তত্ব কাজ করছে তা হল যুদ্ধ প্রলম্বিত হলে রাশিয়া দুর্বল হয়ে পড়বে। যা দেখতে পাশ্চাত্য উদগ্রীব। কিন্ত্তু চলমান যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে এখন যে সব খবরা খবর পাওয়া যাচ্ছে তা থেকে মনে হয় পশ্চিমারা পিছন থেকে ঠেলে ধরেও ভ্লামির জেলেনেস্কির পতন থেকে ঠেকাতে পারবেনা। সম্প্রতি ফরাসী প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোনের এক বক্তব্য থেকে তা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ফরাসী প্রেসিডেন্ট বলেছেন যে কোন সময় কিয়েভের পতন হতে পারে। ফরাসী প্রেসিডেন্ট আরো উল্লেখ করেন, ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়া জিতলে তা ইউরোপের জন্য সমূহ বিপদ বয়ে আনবে। অন্যদিকে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী অস্টিন বলেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে কোন মূল্যে কিয়েভের পতন ঠেকাবে।
সম্প্রতি পুনঃনির্বাচিত হয়ে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সার্ব্বিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে ঘোষণা করেছেন ইউক্রেন যুদ্ধে ন্যাটো সরাসরি জড়িত হলে রাশিয়া তার পরমানু অস্ত্র ব্যবহারে দ্বিধা করবে না। সাম্প্রতিক রাশিয়ানদের হাতে ফাঁস হওয়া র্জামান বিমান বাহিনী প্রধান ইনগু গ্যারর্হাটজ এবং অন্য শীর্ষ তিন কর্মকতার সাথে টেলিফোন কথোপকথন থেকে বেরিয়ে আসে বৃটিশ সামরিক বাহিনীর কিছু সদস্য ইউক্রেনে ইউক্রেনীয়দের হয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করছে। একই সাথে ঐ কথোপকতন থেকে ইউক্রেন যুদ্ধে ফরাসী এবং র্জামানীর সমপৃক্ততার ঘটনাও বেরিয়ে আসে। জার্মান বিমান বাহিনী প্রধান ইনগু গ্যারহার্টজ ঐ আলোচনায় প্রথমত ইউক্রেনকে জার্মানী কর্তৃক দূরপাল্লার মিসাইল সরবরাহের বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়ার কথা বলেন। তিনি উল্লেখ করেন ইউক্রেনীয়দের দূর পাল্লার মিসাইল সরবরাহ করা গেলে তা তারা রাশিয়ান “কারচ” ব্রিগেডের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে পারবে। উল্লেখ্য এই কারচ ব্রিগেড রাশিয়ার অত্যন্ত সংবেদনশীল কৌশলগত অবস্থান ক্রিমিয়া–রাশিয়া সংযোগ রক্ষায় নিয়োজিত। এই কথোপকথনে আরো প্রকাশিত হয় ফ্রান্স এবং বৃটেন ইউক্রেনকে যথাক্রমে “স্কাল্প” এবং “স্ট্রম স্যাডো” মিসাইল সরবরাহ করেছে। এ প্রসঙ্গে রাশিয়ান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র দিমিত্রি পেশকভ উল্লেখ করেন ফাঁস হওয়া এই কথোপকতন এ কথাই প্রমাণ করে পশ্চিমারা রাশিয়া আক্রমণের পাঁয়তারা করছে। প্রসঙ্গক্রমে আরো উল্লেখ্য ন্যাটো ইতিমধ্যে ফিনল্যান্ড এবং সুইডেনকে তাদের সদস্যভুক্ত করেছে। এবিষয়টি বর্তমান প্রেক্ষাপটে রাশিয়ার জন্য উস্কানিমূলক এতে কোন সন্দেহ নাই। কারণ সুইডেনের সাথে রাশিয়ার রয়েছে প্রায় ২০০০ (দুই) হাজার মাইল সমুদ্র সীমানা। এই সমুদ্র সীমানার সাথে সম্পৃক্ত রয়েছে র্জামানী, পোল্যান্ড, ডেনমার্ক, লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়া এবং এসথোনিয়া। এ বিষয় মাথায় রেখে রাশিয়ানরা এরই মধ্যে সুইস এবং ফিনল্যান্ড সীমানায় তাদের পারমাণবিক অস্ত্র নিয়োজনের ঘোষণা দিয়েছে। সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে আমরা এ উপসংহারে আসতে পারি আমেরিকা পাশ্চাত্যকে ক্রমাগত তৃতীয় বিশ্ব–যুদ্ধাভিমুখী ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট; সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক