সমকালের দর্পণ

স্বাধীনতা সুরক্ষায় আগামীর ভাবনা

মেজর মোহাম্মদ এমদাদুল ইসলাম (অব.) | রবিবার , ২৪ মার্চ, ২০২৪ at ১০:৫৩ পূর্বাহ্ণ

২৬ র্মাচ। ১৯৭১ সালের এই দিনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। ইতিপূর্বে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা আলোচনার আড়ালে ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে থাকে। ষড়যন্ত্রের এই জাল বুনা জেনে এবং এর পরিণতি ভেবে পাকিস্তানি দুজন দেশপ্রেমিক জেনারেল সেদিন তাদের পদের বা ক্ষমতার মোহ ত্যাগ করে পদত্যাগ করেছিলেন। এদের একজন এ্যাডমিরাল কে এম আহসান অপরজন লে. জেনারেল সাহেবজাদা এয়াকুব খান। এ দুজন সে সময় একজন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গর্ভনর এবং অপরজন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ছিলেন। পাকিস্তানি সামরিক জান্তার ষড়যন্ত্রের চুড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের রাতে ‘অপারেশন র্সাচ লাইট’। অপারেশন সার্চ লাইটের আওতায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ব্যাপক হত্যাকাণ্ডে মেতে উঠে। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্রের বিষয়ে সম্যক অবগত ছিলেন এবং সে অনুযায়ী তিনি যাবতীয় প্রস্ত্তুতিও নিয়ে রেখেছিলেন।

তার অন্যতম উদাহরণ স্বাধীনতা ঘোষণার সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ২৫ মার্চ ১৯৭১ রাত ১২টা পেরিয়ে ২৬ মার্চ এরই মাঝে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী অপারেশন র্সাচ লাইট শুরু করে দিয়েছে। ধানমণ্ডির বাসবভনে তার সহকারী গোলাম মোর্শেদকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু অপেক্ষায়, এরই মাঝে টেলিফোন বেজে উঠে, ফোন ধরেন বঙ্গবন্ধুর সহকারী গোলাম র্মোশেদ। ফোনে অপর প্রান্ত থেকে বলা হয় ‘আমি বলধা গার্ডেন থেকে বলছি, মেসেজ পাঠান হয়ে গিয়েছে, মেশিন নিয়ে কি করব? গোলাম মোর্শেদ বঙ্গবন্ধুকে টেলিফোনকারীর বার্তাটি জানান। বঙ্গবন্ধু উত্তরে বলেন মেশিন ভেঙে ফেলে ওকে পালিয়ে যেতে বল।’ গোলাম মোর্শেদ টেলিফোনকারীকে উত্তরটি জানিয়ে টেলিফোন রেখে দেন। টেলিফোনকারীর সেই ট্‌্রান্সমিটার বাঙালি জাতির দীর্ঘ চলার পথ পরিক্রমায় এই প্রথমবার নিজের অস্থিত্ব যেন বিশ্বকে জানান দেয়। বাঙালি জাতির স্বাধীনতার ঘোষণা বঙ্গবন্ধু সেদিন এভাবেই বিশ্বকে জানিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। যে ভদ্রলোক সেদিন মেসেজ পাঠান হয়ে গিয়েছে, মেশিন নিয়ে কী করব? প্রশ্ন করে বঙ্গবন্ধুর বাসায় ফোন করেছিলেন তার নাম প্রকৌশলী কে এম নুরুল হক, তিনি তখন টেলিযোগাযোগ ডিভিশনের প্রধান হিসাবে কর্মরত ছিলেন। টেলিযোগাযোগ ক্ষেত্রে তার অসামান্য অবদানের জন্য পাকিস্তান সরকার তাকে ১৯৬১ সালে ‘তমঘায়ে খেদমত’ উপাধিতে ভূষিত করে। সে নুরুল হকই সেদিন দেশপ্রেমের চরম পরাকাষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে বলধা গার্ডেনে বসে তার ট্রান্সমিটার থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার বিষয়টি বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিয়েছিলেন। ২৯ মার্চ ১৯৭১ প্রকৌশলী কে এম নুরুল হককে তার বাসা থেকে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর সদস্যরা তুলে নিয়ে যায়। তিনি আর কখনো ফিরে আসেননি। এদিকে অপারেশন সার্চ লাইটের অধীনে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী বেপরোয়া হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যেতে থাকে।

এ হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা কবি শামসুর রাহমান ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’ কবিতায় অন্তরছোঁয়া বিমূর্ত এক বেদনায় তুলে ধরেছেন।

তুমি আসবে বলে হে স্বাধীনতা

সখিনা বিবির কপাল ভাঙলো

সিথির সিঁদুর মুছে গেল হরিদাসীর।

তুমি আসবে বলে হে স্বাধীনতা

শহরের বুকে জলপাই রঙের ট্যাংক এলো

দানবের মত চিৎকার করতে করতে

তুমি আসবে বলে হে স্বাধীনতা

ছাত্রাবাস বস্তি উজাড় হল। রিকয়েললেস রাইফেল

আর মেশিন গান খই ফোটাল যত্রতত্র’।

সে অনেক ত্যাগ তিতিক্ষা আর রক্তের বিনিময়ে আমাদের স্বাধীনতা। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন সত্তা হিসাবে পৃথিবীর বুকে তার বিজয় পতাকা উত্তোলন করে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু তখনও পাকিস্তানের কারাগারে। ৮ জানুয়ারি ১৯৭২ বঙ্গবন্ধু মুক্তি পেয়ে ৯ জানুয়ারি ভোর ৬টায় লন্ডনের হিথ্রো বিমান বন্দরে পৌঁছেন। ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ বৃটিশ এয়ার ফোর্সের বিমান যোগে বঙ্গবন্ধু স্বদেশের পথে যাত্রা করেন। পথে দিল্লীতে যাত্রা বিরতি। বৃটিশ ঐ বিমানে বঙ্গবন্ধুর সফর সঙ্গী অন্যান্যদের মাঝে ভারতীয় কূটনীতিক শশাংক বাবুও ছিলেন। শশাংক বাবু একসময় ঢাকায় কর্মরত ছিলেন তখন লন্ডনের ভারতীয় দূতাবাসে। বঙ্গবন্ধু শশাংক বাবুকে যাত্রাপথে কাছে ডেকে তার সরকারকে একটি র্বাতা পাঠাতে বলেন যাতে উল্লেখ করবেন বঙ্গবন্ধু দিল্লীতে যাত্রাবিরতির সময় বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের বিষয়টি আলোচনা করবেন। বঙ্গবন্ধু তাই করেছিলেন দিল্লীতে তার বিশাল সর্ম্বধনা শেষে তিনি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে বৈঠকে বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের বিষয়টি তোলেন এবং সিদ্ধান্ত হয় ৩০ জুন থেকে ৩১ র্মাচ ১৯৭২ এর মধ্যে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহৃত হবে। বঙ্গবন্ধু যখন ঢাকার পথে যাত্রা করেন তখন শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী তার সেনা প্রধানকে ৩১ মার্চ ৭২ এর মধ্যে তাদের সৈন্য প্রত্যাহারের নির্দেশ প্রদান করেন। ১৩ মার্চ ১৯৭২ বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহৃত হয়।

আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের এমন অর্জনের অমন ত্যাগের মহিমা তা অক্ষুণ্ন রাখার স্পন্দিত বার্তা জাতির জনক আমাদের সামনে রেখে গেছেন। প্রতিটি জাতিকে স্বাধীনতা অর্জনে যেমন কিছু বিষয় বিবেচনায় রাখতে হয় তেমনি স্বাধীনতা সংহত এবং সুরক্ষায় ও কিছু বিষয়কে ধর্তব্যের মধ্যে নিয়ে তাকে ভবিষ্যৎ বির্নিমাণের পথে আগাতে হয়। আমাদের ভবিষ্যৎ বিনির্মাণ এবং সুরক্ষায় কিছু কিছু বিষয়ের উপর এখন থেকেই বিবেচনায় রেখে আমাদের পথ চলতে হবে।

আমার বিবেচনায় জাতি হিসেবে ভবিষ্যৎ এ আমাদের জন্য বৈশ্বিক এবং অভ্যন্তরীণ বেশ কিছু বিষয় চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখা দিতে পারে। বৈশ্বিক বিবেচনায় ভারতে চরম ধর্মীয় মৌলবাদের ক্রম উত্থান, মায়নমারের রাখাইনকে ঘিরে ভূরাজনীতি এবং রোহিঙ্গা সংকট, চীন এবং ভারতের মাঝে কূটনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখা ইত্যাদি। অভ্যন্তরীণ বিষয়ের মাঝে বিপুল সংখ্যক কর্মসংস্থান, সৃষ্টিশীল জাতিয়তাবাদের বিকাশ ঘটানো এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলির মাঝে ইনক্লুসিভনেস বা বাংলাদেশের মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন বা উন্নয়ন বঞ্চিত এমন মনোভাব সৃষ্টির যেন অবকাশ সৃষ্টি না হয়।

ভারত বহু জাতি সত্তার এক দেশ। বহু ভাষা নানা সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ ভারত। অতীতে ভারত তার বহুতারের সম্মিলনে নির্মিত এক সেতারে সুর তুলেছে। বর্তমানে ভারতীয় কৌশল প্রণেতারা ভারতে উগ্র ধর্মীয় আদর্শ বিস্তারে ধর্মীয় জাতিয়তাবাদ সৃষ্টিতে তৎপর। এটা করতে গিয়ে বর্তমান ভারতীয় শাসকগোষ্ঠী সেখানে মুসলিম সম্প্রদায়কে উপলক্ষ্য হিসাবে বেছে নিয়েছে। এরই ফলশ্রুতি এন আর সি(ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেন), সি এ (সিটিজেন এ্যাক্ট)। বাংলাদেশের সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষ মুসলিম তাদের মাঝে ভারতীয় এই উগ্র ধর্মীয়বাদ সঞ্জাত ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া হবেই। এ ধরনের প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে আমাদের রুখে দাঁড়ানোর একমাত্র হাতিয়ার হবে আমাদের সৃষ্টিশীল জাতীয়তাবাদ। মায়ানমারকে ঘিরে বিশেষ করে বাংলাদেশের সন্নিহিত অঞ্চল রাখাইনকে ঘিরে অর্থনৈতিক এবং সামরিক পরাশক্তি সমূহ নানা ধরনের কূটচাল আর সংঘর্ষে অনেকটা মুখামুখি হওয়ার উপক্রম। এই অবস্থা বাংলাদেশের জন্য অদূর ভবিষ্যতে বড়সড় এক চ্যালেঞ্জের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। রোহিঙ্গা পুনর্বাসনের বিষয়টি তো থাকছেই। রাখাইনে স্থিতিশীলতা অনুপস্থিত থাকলে সেখানে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন অনিশ্চিতের তিমিরেই থেকে যাবে। এ অবস্থায় রাখাইনে স্থিতিশীলতা ফিরানোর প্রচেষ্টা বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম নীতি কৌশল হওয়া বাঞ্চনীয়। চীন এবং ভারত দুটিই বাংলাদেশের কাছের এবং বন্ধু প্রতীম দেশ। ভূরাজনীতিতে এ দুদেশ পারস্পরিক এখনও মুখামুখি অবস্থানে। এমন পরিস্থিতিতে এ দুদেশের সাথে ভারসাম্য রক্ষা করে পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন বাংলাদেশের জন্য বেশ চ্যালেঞ্জের হবে নিঃসন্দেহে।

অভ্যন্তরীণ কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বাংলাদেশকে এখনই তার যাবতীয় শক্তি নিয়োজিত করতে হবে। কর্মসংস্থান বাংলাদেশকে উন্নয়নের শিখরে পৌঁছাতে যেমন সহায়ক হবে তেমনি বেকারত্ব বাংলাদেশকে দুর্বিষহ এক বোঝা বহন করতে বাধ্য করবে। পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৩ টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বসবাস। এই জাতি গোষ্ঠীদের দেশের মূলধারার যাবতীয় কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত রেখে তাদের মাঝে দেশপ্রেম সমুন্নোত রাখতে হবে। অন্যতায় এই অঞ্চলে সময়ে সময়ে বিচ্ছিন্নতাবাদ মাথাচারা দিয়ে উঠতে পারে। এধরনের পরিস্থিতি দেশের জন্য কোনও মঙ্গল বয়ে আনবে না। ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের এই মাহেন্দ্রক্ষণে কামনা স্বাধীন জাতি হিসাবে পৃথিবীর বুকে আমাদের পদচারণা হোক গৌরবমণ্ডিত, আমরা পৃথিবীতে শুধু শান্তি স্থাপনকারী এক নাম্বার জাতি সত্তা হতে চাই না আরো অনেক সৃষ্টিশীল কর্ম উদ্যোগে পৃথিবীর বুকে প্রধানতম হয়ে বিচরণ করতে চাই। আজ এই হোক আমাদের দৃঢ় অঙ্গীকার।

লেখক: প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট; সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅগ্নিঝরা উত্তাল মার্চ
পরবর্তী নিবন্ধরাঙ্গুনিয়ায় অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে গেছে দুটি বসতঘর