সমকালের দর্পণ

মেজর মোহাম্মদ এহমাদুল ইসলাম (অব.) | রবিবার , ১৭ মার্চ, ২০২৪ at ৫:০২ পূর্বাহ্ণ

অপার বিস্ময়ের নাম শেখ মুজিবুর রহমান

আমার কৈশোর থেকে শেখ মুজিবুর রহমান এই একটি নাম আমাকে এক ধরনের বিস্ময়ের ঘোরে আর বিমুগ্ধতায় আচ্ছন্ন করে রেখেছে। হিজল তমালের শ্যামল বাংলার টুঙ্গি পাড়ার এক সন্তান ক্রমাগত পথ চলতে চলতে এক সময় একটি জাতির দেদীপ্যমান নক্ষত্র হয়ে গেলেন। চলার পথে তিনি কখনো মানবিকতায় কখনো সাহসিকতায়, কখনো দূরদর্শিতায় আবার কখনো বন্ধুতায় চলা এক শেরপা। এই চলতে চলতে তার ব্রত ছিল ‘হিমালয় জয় করতে গিয়ে অনেকেই ব্যর্থ হয়েছেন তাই বলে মানুষের কাছে হিমালয় অজেয় থাকেনি’।এই ব্রতে তিনি কৈশোরে বাবার গোলার ধান পরিবারের অজান্তে রাতের অন্ধকারে অভুক্ত মানুষের মাঝে বিলিয়েছেন, শীতের ভোরে কোচিং টিচারের কাছ থেকে ফিরার পথে নিজের গায়ের সুয়েটার খুলে পরিয়ে দিয়েছেন শীতার্ত মানুষকে। স্কুলের হয়ে দুরন্ত ফুটবল খেলেছেন আবার টিনের ছাদের ফুটো দিয়ে স্কুলে বৃষ্টির পানি পড়ার প্রতিবাদ করেছেন জাঁদরেল মন্ত্রীর সামনে দাঁড়িয়ে।

পড়ালেখার তাগিদে প্রিয় জন্মস্থান ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছেন কলকাতায়। সেখানে গিয়েও মানুষের পাশে দাঁড়ানো থেকে নিজেকে নিবৃত্ত রাখেননি। দাঙ্গা বিধ্বস্ত ভয়ার্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য করে। ভারত বিভক্তির সময় পাকিস্তান আন্দোলনে নিজের সাংগঠনিক শক্তিকে পুরাদমে নিয়োজিত করেছেন। সিলেটকে সেসময়ে পাকিস্তানভুক্তির গণভোটে তার ভূমিকা অবিস্মরণীয়।

অক্লান্ত পরিশ্রম আর সংগ্রামে পাকিস্তান অর্জনের মোহ কাটতে সময় লাগেনি বেশিদিন যখন দেখলেন তার মাতৃভাষার ওপর প্রথম আঘাত এসেছে। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনেও জেলে বসে পালন করেন ঐতিহাসিক ভূমিকা। মৌলানা ভাসানী সভাপতি, শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক কারান্তরাল থেকে তরুণ শেখ মুজিব যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। তাকে ১০ এপ্‌্িরল ১৯৪৯ গ্রেফতার করা হয় একই বছরের ২৯ জুলাই পর্যন্ত তিনি কারাগারে ছিলেন।

কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি দুর্বার গতিতে দল গোছানোর কাজে নেমে পড়েন। এ কাজের মাঝে সব চেয়ে যে উল্লেখযোগ্য কাজটি তিনি করেছিলেন তা হল আওয়ামী লীগকে একটি ধর্ম নিরেপক্ষ দল হিসাবে প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে, মুসলিম কথাটি তুলে দিয়ে আওয়ামী লীগকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উপর ভিত্তি করে গড়ে তোলার প্রাণান্ত প্রচেষ্টায় তিনি আত্মনিয়োগ করেন। বলা বাহুল্য এতে তিনি দারুণভাবে সফল হন। এ সফলতার যথার্থ স্বীকৃতি অর্থনীতিতে ভারতীয় নোবেল বিজয়ী অর্মত্য সেনের সাম্প্রতিক অকপট বক্তব্য থেকে প্রতিভাত হয়। অমর্ত্য সেনের বক্তব্য ভারত তার পথ চলায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। এ বক্তব্যের মূলে হয়ত সাম্প্রতিকের ভারতে ধর্মীয় উগ্রবাদের ব্যাপক উত্থান তাকে বিচলিত করে থাকতে পারে।

মাওলানা ভাসানীর পরামর্শে শহীদ সোহরাওয়ার্দী’র সাথে দেখা করতে শেখ মুজিব ১৯৪৯ সালে লাহোর পৌঁছেন। তিনি জানতেন লাহোরে পৌঁছে সোজা নবাব মামদোতের বাড়ি যাবেন সেখানে সোহরাওর্য়াদী সাহেব থাকেন। লাহোরে কোনদিন যাননি। এক দোকান থেকে নবাব মামদোতের বাড়িতে ফোন করে জানতে পারেন সোহরাওর্য়াদী সাহেব লাহোরের বাইরে। এখন কোথায় যাবেন? লাহোরে একমাত্র মিয়া ইফতেখার তাকে চিনেন। তখন তার পকেটে মাত্র দুই টাকা, সাথে প্রচণ্ড ক্ষিধে। লাহোরের হাড় কাঁপানো শীতের কথা তার জানা ছিল না। শেষমেষ ঐ দুই টাকা সম্বল নিয়ে টাঙ্গায় চড়ে মিয়া সাহেবের বাসায় পৌঁছেন। সারাদিনের শীতের কামড় ফলশ্রুতি রাতে গা কাঁপুনি দিয়ে জ্বর। মিয়া সাহেব রাতেই ডাক্তার ডাকেন। মিয়া সাহেব এবং তার স্ত্রী’র পরম যত্ন এবং ডাক্তারের ঔষধে জ্বর সারে। দুইদিন পর সোহরাওর্য়াদী লাহোরে ফিরে আসেন। প্রিয় শিষ্য শেখ মুজিবকে নিয়ে তিনি কাপড়ের দোকানে যান, গরম জামা কাপড় কিনে তাকে উপহার দেন। এই হল সেই সময়ের তরুণ নেতা শেখ মুজিব। ত্যাগেতিতিক্ষায়, সংগঠনেসংগ্রামে অবিচল আর উজ্জ্বল।

পথ চলতে তরুণ আপষহীন শেখ মুজিবকে পাকিস্তানি কায়েমী স্বার্থবাদীদের রোষানলে পড়তে হয়েছে অসংখ্যবার। এরই ফলশ্রুতি তার জীবনের সোনালি যৌবনের সুবর্ণ সময় কারান্তরালে যাপন। কারাবাসের অমানবিক দিকটি নির্মমভাবে ফুটে উঠে যখন তার বয়ানে তিনি জানান তার স্ত্রী বেগম ফজিলতুনেচ্ছা এবং তিনি শোবার ঘরে, কিছুক্ষণ পরপর হাসিনা এসে তার গলা জড়িয়ে আব্বু আব্বু ডাকে তা দেখে একসময় শেখ কামাল হাসিনার কাছে অনুমতি চায় “হাসু আপা তোমার বাবাকে আমিও একটু বাবা ডাকি”? বাবাকে না দেখে দেখে নিজ সন্তানও জানেনি তিনি তারও বাবা। সন্তান সংসার এভাবেই তার কাছে গৌন ছিল জাতীয় স্বার্থে।

হাজার বছরের রাষ্ট্র কাঠমোর অভিধাবিহীন শতধা বিভক্ত বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে, তাকে আপষহীন পথ চলতে উজ্জীবিত করতে চারণ কবির মত শেখ মুজিব তার ঐক্যের একতারা হাতে ঘুরে বেরিয়েছেন শ্যামল বাংলার পথে প্রান্তরে। ডাক দিয়েছেন দুঃখী বাংলার মানুষকে মুক্তির পথে, সে মুক্তির পথে দিশারী হতে গিয়ে তার জীবন হুমকির মুখে পড়েছে অসংখ্যবার। হুমকি এসেছে সামরিক বেসামরিক আমলাতন্ত্রের দিক থেকে, হুমকি এসেছে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের কাছ থেকে। তিনি কোনওটির তোয়াক্কা করেননি। বাঙালির অধিকার আদায়ে তার এই অকুতোভয় পথ চলার স্বীকৃতি দিয়েছে জাতি তাকে ‘বঙ্গবন্ধু’ অভিধায় অভিষিক্ত করে।

বঙ্গবন্ধু অভিধায় অভিষিক্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব উল্কার মত ছুটে বেড়িয়েছেন বাংলার পথে প্রান্তরে। তার এই অভিযাত্রা থেকে নিবৃত্ত করতে পাকিস্তানি স্বৈরশাসকরা তাকে বহুবার মৃত্যুর মুখামুখি দাঁড় করিয়েছেন সময়ে সময়ে, যার অন্যতম ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ইতিমধ্যে ৪৯ সালে আওয়ামী লীগ গঠন, ৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬ সালের ৬ দফা ঘোষণা ইত্যাদির মাধ্যমে গণ মানুষের হৃদয়ে আসন করে নিয়েছেন। তারই বহিঃপ্রকাশ ৬৯ সালে জনতার রুদ্ররোষের গণ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সকল ষড়যন্ত্র ভেদ করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে তার নিঃশর্ত মুক্তি। ১৯৭০ বঙ্গবন্ধুর জীবনের সমস্ত ত্যাগ তিতিক্ষা আর সংগ্রামের সোনালি ফসল বাংলার মানুষ তাকে নিবেদন করে ভোটের মাধ্যমে। সে এক অভূতপূর্ব অর্জন। পাকিস্তানি স্বৈরশাসকদের সমস্ত হিসাব নিকাশ ওলট পালট। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা। বঙ্গবন্ধুর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার নানা ফন্দি ফিকির শুরু হয়। স্বৈরশাসকদের সেই ষড়যন্ত্র ভেদ করতে বঙ্গবন্ধু তার অভ্যর্থ অস্ত্র তার জনগণের সামনে হাজির হন। ৭ মার্চ সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। নির্মলেন্দু গুণের অবিনাশী কবিতার দ্যোতনায় যা ছিল এমন

শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে

রবীন্দ্রনাথের মত দীপ্ত পায়ে হেঁটে

অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন

তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল

হৃদয়ে লাগিল দোলা, জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার

সকল দুয়ার খোলা। কে রুখে তাহার বজ্রকণ্ঠ বাণী?

গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর কবিতাখানি

এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,

এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’

সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের।

শুধু স্বাধীনতা শব্দটিকেই নয় বঙ্গবন্ধুর প্রেরণায় সংগ্রামে উজ্জীবিত জাতি নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতাকেও নিজের করে নেয়। এই উপমহাদেশে বহু জাতি সত্তা রয়েছে তাদের জাতীয় নেতাও রয়েছে কিন্ত্তু তারা নিজেদের স্বাধীন সত্তা হিসাবে অভিষিক্ত বা বিকশিত করতে পারেনি। টানলে অনেক উদাহরণ সামনে আনা যায়। যেমন পাকিস্তানের পস্তুন, পাঞ্জাবি, সিন্ধি, বালুচ ভারতের মারাঠী, গুজরাটি, তামিল, রাজপুত, মিজো, নাগা, অহোম, ইত্যাদি।

বঙ্গবন্ধু তার দূরদর্শিতা, অবিচল আর্দশ আর বলিষ্ঠ নেতৃত্বের গুণে বাঙালি জাতি সত্তার উন্মেষ ঘটিয়েছেন এবং তা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র কাঠামোয় প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং সবশেষে জাতির পিতা হিসাবে নিজেকে অধিষ্ঠিত করেছেন।

১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট ঘাতকের বুলেট হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে তার জনগণের কাছ থেকে কেড়ে নেয়। ব্যক্তি মুজিব তিরোহিত হলেও জনগণের কাছে আদর্শের মুজিব হয়ে যান আরো দেদীপ্যমান আর অনুপ্রেরণার এক অফুরন্ত উৎস। আজ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন। তাকে শ্রদ্ধা জানাতে অন্নদাশঙ্কর রায়ের হৃদয় ছোঁয়া কবিতার এই উদ্ধৃতি।

যতকাল রবে পদ্মা মেঘনা গৌরী যমুনা বহমান

ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান’।

লেখক: প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট; সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের দুরবিনে
পরবর্তী নিবন্ধতৃতীয় ওয়ানডে দলে লিটনের বদলে ডাক পেলেন জাকের