মানব সভ্যতার পেছনে নারীর ভূমিকা অনস্বীকার্য। সভ্যতা ও সংস্কৃতি শব্দ দুটি নির্বিচারভাবে ব্যবহৃত হলেও দুটির মধ্যে পার্থক্য আছে।
civilization (সভ্যতা) ও culture (সংস্কৃতি) এই শব্দগুলোর অর্থ তাত্ত্বিকদের কাছে কখনও এক, কখনওবা আলাদা। সংস্কৃতি হচ্ছে শিল্পিত, রুচিসম্মত, সৌন্দর্যখচিত করে তোলার চেতনা। দার্শনিকদের মতে, সংস্কৃতি হচ্ছে নৈতিক মূল্যবোধ, সুরুচি, সৌন্দর্যবোধ, ঔচিত্যবোধ, [আবদুল মতিন, ১৯৯৫] ।
ইদানীং লক্ষ্য করা যাচ্ছে নারীকে অবদমনের চেষ্টায় এক শ্রেণির মানুষ মরিয়া হয়ে উঠেছে। পুরুষের পাশাপাশি নারীর যে শক্ত একটা অবস্থান তৈরি হয়েছে তা ভেঙে দিতে কিছু মানুষ তৎপর। অথচ এই নারীরাই পুরুষদের পাশে থেকে নিজেকে প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত করে গড়ে তুলেছেন।
সংস্কৃতির প্যাটার্নের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই নারী–পুরুষের জটিল পার্থক্য,পরিবার, ধর্ম ও রাজনীতির বৈশিষ্ট্য, আইন–শিক্ষা–রাজনীতির বিভেদ। তাই মূল্যবোধের অবক্ষয়, মানবতার গুণাবলীর চর্চা ব্যাহত হলে নারী সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সভ্যতা বলতে বুঝি আমাদের কামনা–বাসনা আর প্রয়োজনীয়তা।
এবার আমাদের সংস্কৃতি অঙ্গনের নারীরাই টার্গেটে পড়েছেন বেশি। তিনজন খ্যাতিমান শিল্পী মেহজাবীন,পরিমনি, ও অপু বিশ্বাস; প্রত্যেকেই নিজের স্বইচ্ছায় নিজেকে একটা অবস্থানে দাঁড় করিয়েছেন। এদের নিয়ে মানুষের কৌতূহলের শেষ নেই। এরা তিনজনের কেউ রেস্তোরাঁ উদ্বোধন, কেউ শোরুম উদ্বোধনে যাওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু একদল মারমুখী জনতার রোষানলে পড়ে শেষ পর্যন্ত যেতে পারেননি। তিনমাসের ব্যবধানে একই কায়দায় বাধার মুখে পড়েছেন উনারা। বিষয়টা নিয়ে অন্য দু’জন চুপ থাকলেও পরিমনি চুপ থাকতে পারেননি। তিনি তাঁর ফেসবুক পেইজে এর প্রতিবাদ করে লিখেছেন,‘এতো চুপ করে থাকা যায় নাকি। পরাধীন মনে হচ্ছে। শিল্পীদের এতো বাধা কেন আসবে? ইনসিকিউর ফিল হচ্ছে।এমন স্বাধীন দেশে নিরাপদ নই কেন আমরা? ধর্মের দোহায় দিয়ে কী প্রমাণ করতে চলেছেন তাঁরা? এ দেশে সিনেমা, বিনোদন সব বন্ধ করে দেয়া হোক তাহলে। এই দায়ভার কিন্তু আমাদের সবার নিতে হবে।’
একটি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত কামরাঙ্গীচর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বলেছেন, ‘ফেসবুকে হুজুররা প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছিলেন অপু বিশ্বাসকে উদ্বোধনে আনা হলে বিশৃঙ্খলা করবেন। রেস্টুরেন্টের মালিকরা জানান অপু বিশ্বাসকে আনলে যদি হুজুররা বিশৃঙ্খলা করেন তাহলে আনবো না, বিরোধের দরকার নেই। পরে স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে উদ্বোধন করান।
এইসব ঘটনা থেকে বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে এখন পর্যন্ত কোনো পুরুষ তারকাকে বাধা দেয়নি। নারী ফুটবলারদের ফুটবল খেলতে দেওয়া হচ্ছে না। অথচ ফুটবল খেলায় এই নারীরাই আমাদের জন্য সম্মান বয়ে এনেছেন।
নারীদের বাধা দেয়ার চেষ্টা চলছে এমন অনেক জায়গায়। একধরনের ভায়োলেন্স সৃষ্টি করে মেনে নেওয়ার জন্য চাপ দেয়া হচ্ছে। এভাবে বাধা দিতে থাকলে নারীরা সমাজে পিছিয়ে পড়বে। অন্ধকারের দিকে ধাবিত হবে।
এটা একধরনের রাজনীতি। এই রাজনীতি সফল নারীকে বাধা দেয়ার চেষ্টা। এরা স্বাধীনচেতা নারী ও আধুনিক সমাজকে খুব ভয় পাচ্ছে। তাই এটাকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করছে।
শিল্পীর পরিচয় সে শিল্পী। সে নারী নাকি পুরুষ সেটা বড় বিষয় নয়।
কোভিডের পরপরই নারী বাইকার বেশ চোখে পড়েছে। এরা ঘরে বন্দী না থেকে বাইক চালানোর কাজ শিখেছেন। সমাজে অনেকে তাদের ভালোভাবে নিতে পারেননি। অথচ এই বাইকাররা নিজেদের অনেক কাজ সহজেই সামলে নিতে পেরেছেন। আমাদের সমাজে নারীদের কাজকে সবসময়েই হেয়ভাবে দেখা হয়েছে। নারীর কাজের গুরুত্বকে সবসময়েই ভেবেছে টাইমপাস টাইপের। অথচ এই নারীদের সকাল শুরু হয় আলো ফোটার আগেই। ঘরের সব কাজ সেরে বাচ্চাদের স্কুলে পৌঁছে দেয়া, অফিসে যাওয়া, বাজার–সদাই করা,ইলেকট্রিক বিল,গ্যাসবিল সব গুরুত্বপূর্ণ কাজই নারীর ওপর বর্তায়।
এমন করে–করে উৎপাদনকর্ম থেকে নারী ক্রমে সরে যেতে থাকে, তাকে সরিয়ে দেওয়া হতে থাকে। সে হয়ে পড়ে প্রান্তবাসী। গৃহকর্মই তার জন্য যেন নির্ধারিত একমাত্র কাজ– এ রকম ধারণায় সমাজ চলে যাচ্ছে। প্রকৃতিজগতে যে কাজের বৈষম্য ছিল না, তা–ই সংস্কৃতিজগতে শোষণ ও বৈষম্যের সূচনা করে। বর্তমানে পৃথিবীর নানা দেশে গৃহকাজের জন্য অর্থমূল্য দাবি করা হচ্ছে, নারী ও পুরুষ যৌথভাবে এই কাজ করবে–এমন কথাও শোনা যাচ্ছে। অথচ বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে এখনও গৃহস্থালির কাজ পুরুষের জন্য অবমাননাকর হিসেবে বিবেচ্য–ধনী–গরিব সর্বত্র।
নারীদের যেভাবে ঠেকানোর চেষ্টা চলছে সেটা প্রতিহত করতে হবে সকলকেই। রাষ্ট্র এবং সমাজকেই জরুরিভাবে তা প্রতিহত করতে হবে। নারীদের নিরাপত্তা দিতে হবে। সম্মান পাওয়ার অধিকার রাখে নারীসমাজ।
পুরুষেরা যে সব অধিকার, স্বাধীনতা, সুযোগ ভোগ করেন নারীরা তা অনেক ক্ষেত্রে পান না। এই বৈষম্যের অবসান প্রয়োজন।
নারীর কর্মক্ষেত্র প্রসারিত হলেই সংস্কৃতি বিচিত্ররূপে বিকশিত হতে পারে উৎপাদনকাজে এবং শিল্পসাহিত্য জগতে–দুই ক্ষেত্রেই।