(প্রথম পর্ব)
পৃথিবীর বুকে আমরাই সম্ভবত একমাত্র জাতি, যারা সংস্কৃতি চর্চার নামে প্রতিনিয়ত সংস্কৃতির ব্যবচ্ছেদ করি। আমরা প্রকৃতি, মানুষ, কর্ম, সর্বোপরি আগামী দিনের প্রতি তেমন একটা দায়বদ্ধতা অনুভব করি না। আমাদের যাবতীয় দায়বদ্ধতা কিছু বায়বীয় অনুভূতির প্রতি, যার মাঝে সংস্কৃতির নাম সর্বাধিক উচ্চারিত। চেতনা, জাতীয়তা, দেশপ্রেমের কথাও উচ্চকণ্ঠে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয় মঞ্চ থেকে মঞ্চে। বিষয়বস্তুর কলেরব না বাড়িয়ে আজ কেবল সংস্কৃতির কথাই হোক।
হায় সংস্কৃতি! আমাদের প্রাণের বাংলাদেশের হাজার বছরের ঐতিহ্য! কথায় কথায় আমাদের সুশীল সমাজের প্রতিনিধিগণ সংস্কৃতি চর্চা নিয়ে ভারী ভারী ভাষণ দিয়ে ফেলেন। দেখে শুনে মনে হয় সংস্কৃতি বুঝিবা কেবল আলোকিত মঞ্চেরই বিষয় এবং কেবলমাত্র প্রমিত ভাষায় কথা বলা রুচিশীল পোশাক পরিহিত নাগরিকগণই সংস্কৃতি ধারক ও বাহক। বাদবাকি সকলেই রুচিহীন, অসংস্কৃতিবান। তাদেরকে ‘আনকালচার্ড’দের দলে ফেলে দেই আমরা অনায়াসে। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, মাটির গন্ধ, নদীর পলি গায়ে মেখে যে বিশাল গেঁয়ো জনগোষ্ঠী বিন্দুমাত্র নাগরিক সুবিধা ভোগ না করে সোনা ফলিয়ে কোটি মানুষের ভাতের সংস্থান করে যাচ্ছে তারাও কিন্তু আমাদের চোখে ‘আনকালচার্ড’দেরই দলভুক্ত! আলো ঝলমলে শহর জুড়ে ভাসমান শ্রমজীবী জনসাধারণ, টুকরি আর কাস্তে কোদাল কিংবা ছেঁড়া ফাটা ঝোলাই যাদের জীবন, তারা তো পোকামাকড় বৈ অন্যকিছু নয়। আমাদের সংস্কৃতিতে ওদের অবস্থান কোথায়? সংস্কৃতির ওরা কী–ইবা জানে?
সত্যিই তো, সংস্কৃতি আসলে কী? সংস্কৃতির সংজ্ঞা উদাহরণসহ বুঝিয়ে বলতে বললে সমাজবিজ্ঞানের জ্ঞান না থাকা আমাদের মতো সাধারন মানুষেরা বেশ একটা সমস্যায় পড়ে যায়। তবে সাধারণভাবে সবাই ধরে নেন– নাচ,গান, কবিতা, নাটক সিনেমা– এসবের চর্চা করাই সংস্কৃতি। আর এই সব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত শিল্পীদেরকেই কেবল সংস্কৃতিমনা বলে মনে করা হয়। আর হ্যাঁ, সুসজ্জিত আলোকিত মঞ্চে বক্তৃতা ভাষণ দিয়ে বেড়ানো বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরাতো আছেনই। কিন্তু সংস্কৃতির ব্যাপ্তি যে কত বিশাল, তা আমাদের সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরাও ভুলে থাকেন প্রায়শ। সেকারণেই বিনোদন আর সংস্কৃতিকে আমরা এক করে ফেলি। সংস্কৃতির অসংখ্য শাখা প্রশাখার মাঝে বিনোদন একটা ছোট্ট উপাদান মাত্র– সেকথাও ভুলে যাই আমরা।
তাহলে সংস্কৃতির অর্থ কী দাঁড়ায়? সমাজবিজ্ঞানের বিশেষ কোন জ্ঞান নয়, বরং পারিবারিক চৌহদ্দি থেকে পাওয়া শিক্ষা, মূল্যবোধ, ধর্মাচরণ, জীবনদর্শনের ওপর ভর করে বলা যায় আমাদের আচার আচরণ, পারিবারিক মূল্যবোধ, শিক্ষা, জীবনদর্শন, ধর্ম, উৎসব– এসবই সংস্কৃতির অংশ। খাদ্যাভ্যাস, পোশাক–পরিচ্ছদ সাংস্কৃতিক পরিচয় তুলে ধরার বড় দুটো মাধ্যম। আমাদের হাসি–কান্না, আনন্দ–বেদনা, মায়া–মমতা–ভালবাসা, স্বপ্ন, স্মৃতিকথা এসবও কী সংস্কৃতির উপাদান নয়? বিনোদন– আমাদের সংগীত, আমাদের কবিতা, আমাদের নাটক, আমাদের চলচ্চিত্রকে বাদ দিলে আমাদের যে অস্তিত্বই থাকে না। শিল্পীগণের পরিবেশনা ও তার হাত ধরে সাংস্কৃতিক জাগরণ জাতির ঘুম ভাঙিয়েছিল বলেইনা বাংলাদেশটা আজ আমাদের, একান্তই আমাদের।
সংস্কৃতি নিয়ে এই উপলব্ধিটা এসেছিল, যখন দক্ষিণ গোলার্ধে গিয়ে পরবাস করছিলাম সাত সাতটি বছর ধরে। পিতামহীর কথাগুলো কানে বাজত খুব। দাদু আমাদের দু’বোনকে বলতেন, “লেখাপড়া কর, জজ–ব্যরিস্টার হও, দেশ–বিদেশে যাও। কোন বাড়ির মেয়ে তোমরা– কেবল সেকথা ভুলোনা। বাড়ির দরজায় দাদা পরদাদারা ঘুমিয়ে থাকলেও তাঁরা তোমাদের দেখতে পান। মনে রেখ, শেকড় তোমাদের এই মেঘনা পাড়েই।” শেকড়ের কথা বলে দাদু কিন্তু আমাদের পায়ে শেকল পরিয়ে দেননি, বরং ডানাই লাগিয়ে দিয়েছিলেন ওড়বার জন্য। এখানে বলা আবশ্যক, কেবল মেয়ে বলে নয়, বরং পরিবারের বড় সন্তান বলেই বাড়ির মান রাখার দায় দায়িত্বের কথা আমদের স্মরণ করিয়ে দিতেন তিনি। আমাদের এই বিদুষী দাদুটি কোন পাঠশালার চৌকাঠ মাড়াননি। বাল্যশিক্ষা আর ট্রাংকভরা উর্দু ফার্সি কবিতার বই–ই ছিল তাঁর অবলম্বন। চোখ বোজার দুই দশক পর আজও দাদু আমাদের পথ দেখিয়ে চলেন।
প্রশ্ন উঠতে পারে, সংস্কৃতি কী স্থবির না চলমান? চিরন্তন না কী নিয়ত পরিবর্তনশীল? কেউ যখন নিজস্ব গণ্ডির সীমানা পেরিয়ে নতুন জনপদে পা রাখে, তখন সে সঙ্গে করে নিয়ে যায় তার সংস্কৃতি; তার মূল্যবোধ ও বিশ্বাস। অচেনা জনপদে চেনাজানা হয় ধীরে ধীরে। মানিয়ে নিতে নিতে সময় এসে পড়ে বিদায় বলার। ফেরার সময় সে কিন্তু খালি হাতে ফেওে না। ভিনদেশী সংস্কৃতি থেকে কিছু না কিছু নিয়ে আসে, হয়তো নিজের অজান্তেই। আবার ভিনদেশীদেরকে দিয়েও আসে, কিছু না কিছু, নিজের সংস্কৃতি থেকে। কোথায় যেন পড়েছিলেম, মানুষ কোন জায়গা ছেড়ে চলে এলে হৃদয়ের কিছু অংশ পুরনো জায়গায় ফেলে আসে। ছেলেবেলায় দেখেছিলাম– গ্রামের বাড়িতে খালা ফুপুরা সুঁইসুতো দিয়ে ছন্দ লিখে কাঁচ দিয়ে বাঁধাই করে ঘরের দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখত। একটা ছন্দের কথা আজও পরিষ্কার মনে আছে– “পাখি উড়ে যায় রেখে যায় ছায়া, মানুষ চলে যায় রেখে যায় মায়া”।
এই রেখে যাওয়া মায়াটুকুর কারণেই হয়তো অন্যরা হারিয়ে যাওয়া, কিংবা চলে যাওয়া মানুষটিকে মনে রাখে, তাকে ভেবে স্মৃতিকাতর হয়। এই যে স্মৃতিকাতরতা, এও কী সংস্কৃতি নয়? যেমন– কোটি কোটি বাংলাদেশী প্রবাসে পাড়ি দেবার সময় বুকের ভেতর করে নিয়ে যান এক টুকরো বাংলাদেশ। চার পাঁচ দশক পরও, কিংবা বলা যায় আমৃত্যু তা লালন করেন অনেকেই। আবার অনেকের কাছে খুব দ্রুত ফিকে হয়ে যায় সে ছবি। যেকোন সমাজে এরকম দু’ধরনের চিত্রই কিন্তু দেখতে পাওয়া যায়।
এবার একটু ইতিহাসের কথা হোক। আমাদের বঙ্গভূমি প্রাচীনকাল হতে সমৃদ্ধ জনপদ হিসেবে বিশ্বমাঝে স্বীকৃত। মধ্যযুগে পশ্চিমের অনেক ঐতিহাসিক বাংলাকে ‘পৃথিবীর স্বর্গ’ বলেছিলেন (যদিও ধনসম্পদে পরিপূর্ণ এই রাজ্যে অভুক্ত মানুষের অভাব ছিলনা)। এই জনপদের প্রাচুর্যের খবর পেয়ে কত ভিনদেশী পরিব্রাজক, ধর্মযাজক, সন্ন্যাসী, বণিক ও দস্যু এদেশে এসেছে! কেউ দীর্ঘকাল থেকেছে, কেউবা অল্পদিন পর ফিরে গিয়েছে নিজভূমে। সকলেই পায়ের চিহ্ন রেখে গিয়েছে এই দেশের কোথাও না কোথাও। সেই সঙ্গে রেখে গিয়েছে তাদের সংস্কৃতির কিছু না কিছু। সঙ্গে করে নিয়েও গিয়েছে কিছু না কিছু। সেকারণেই আমাদের সংস্কৃতিতে এত বৈচিত্র্য। আমাদের ভাষায়, বাংলা বিশ্বকোষে, আমাদের সাহিত্যে আরবি, ফার্সি, তুর্কি, পর্তুগীজ, ফরাসি, ইংরেজিসহ উর্দু, হিন্দি নানার ভাষার শব্দ জায়গা করে নিয়েছে, যেমন জায়গা করে নিয়েছে নানান দেশী খাবার ও পোশাক। এসকল সংযোজন নিঃসন্দেহে আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে ।
শুধু কী ভিনদেশীরাই বৈচিত্র্য এনেছিল আমাদের সংস্কৃতিতে? বঙ্গভূমি কী আদিকাল থেকেই বৈচিত্র্যময় ছিল না? আঞ্চলিক বা স্থানীয় সংস্কৃতিতে এত বৈচিত্র্য কোথা থেকে এল? ভাষা, পোশাক, খাদ্যাভ্যাস, রীতিনীতি– এই ক্ষুদ্র বদ্বীপে এত রূপে ধরা দেয় কেন? শুধু স্থানীয় বৈচিত্রের কথাইবা বলি কেন? প্রতিটা পরিবারের রীতিনীতিও ভিন্ন ভিন্ন। গৃহসজ্জা বিষয়ক এক নিবন্ধে পড়ছিলাম– প্রত্যেকটি বাড়ীরই একটা নিজস্ব ভাষা আছে। আছে গন্ধ। ঠিক তাই, ঘরদোর গুছিয়ে রাখা ছাড়াও কী কী করা যাবে, আর কী কী করা যাবে না তার অলিখিত তালিকা অনেক পরিবারেরই থাকে। ঘরের শান্তি, পরিবারের শৃঙ্খলা অটুট রাখার জন্য নীতিমালাগুলো বড় কাজ দেয়। কেউ কী বলতে পারবে– কোন পরিবারের কোন কাজটা ঠিক, আর কোনটা ঠিক নয়? ঠিক বেঠিক বিষয়টা তো নীতিশাস্ত্রের বিষয়; সততা, সত্যবাদিতা, ন্যায়পরায়নতা যার প্রধান কিছু চরিত্র। সংস্কৃতির সঙ্গে নীতিশাস্ত্রের কোন সংযোগ আছে কীনা জানা নেই। তবে সংস্কৃতিতে বোধ করি অপরাধের কোন স্থান নেই। কিংবা অপকর্মকে সংস্কৃতি বলারও অবকাশ নেই। অথচ দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, নানান ধরনের নির্যাতন, সহিংসতা, দানবিকতা ও পাশবিকতার আদিম উল্লাস এবং সেইসঙ্গে বিচারহীনতা আমাদের সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে পড়েছে অনেকদিন হয়।