সাধারণ সদস্যদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন করে নানা আর্থিক ‘অনিয়মে’ জড়িয়েছেন ‘দি চিটাগাং কো–অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটি লিঃ’–এর ব্যবস্থাপনা কমিটি। তাছাড়া সমবায় সমিতির আইনের বিভিন্ন বিধানও লংঘন করেছেন তারা। এসব অনিয়মের কারণে ‘দেউলিয়া’ হওয়ার উপক্রম হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
এ অবস্থায় আগামী ৩০ দিনের মধ্যে বর্তমান ব্যবস্থাপনা কমিটি ভেঙে দেয়ার নির্দেশনা দিয়েছে জেলা সমবায় অফিস। গতকাল বুধবার এ নির্দেশনা দেয়া হয়। এর আগে গত ২৪ আগস্ট ব্যবস্থাপনা কমিটি কেন ভেঙে দেয়া হবে না তার ‘সন্তোষজনক’ ব্যাখ্যা দেয়ার জন্য নোটিশ দেয় সমবায় অফিস। এতে ব্যবস্থা কমিটির সকল সদস্যকে ২ সেপ্টেম্বর শুনানিতে উপস্থিত থাকতে বলা হয়। কিন্তু নির্ধারিত দিনে কেউ উপস্থিত হননি।
এদিকে ব্যবস্থাপনা কমিটি ভেঙে দেয়ার জন্য সমবায় অফিস নির্দেশনা দেয়ায় সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন সোসাইটির সাধারণ সদস্যরা। তারা বলছেন, দ্রুত কমিটি ভেঙে দেয়া হোক। এরপর সমবায় অফিসের মাধ্যমে একজন প্রশাসক নিয়োগ দেয়া হোক। নিয়োগকৃত প্রশাসক ভোটার তালিকা হালনাগাদ করার পর সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজন করুক। এ বিষয়ে জেলা সমবায় অফিসার মুরাদ আহম্মদ আজাদীকে বলেন, ‘দি চিটাগাং কো–অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটি লিঃ’ এর ব্যবস্থাপনা কমিটিকে শুনানিতে অংশ নেয়ার জন্য নোটিশ দেয়া হয়। কিন্তু নির্ধারিত দিনে তারা উপস্থিত হননি। এখন আমরা বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নিব।
‘দি চিটাগাং কো–অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটি লিঃ’–এর সাধারণ সদস্য প্রকৌশলী সংগঠক ও নগরপরিকল্পনাবিদ ইঞ্জিনিয়ার জাহিদ আবছার চৌধুরী আজাদীকে বলেন, বর্তমানে যে কমিটি রয়েছে তাদের পদত্যাগ করা উচিত। কারণ এ কমিটি নির্বাচনের নামে প্রহসন করে দায়িত্ব নিয়েছে। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চেয়েছেন এমন অনেককে এম এ আজিজ স্টেডিয়াম সংলগ্ন একটি অফিসে ডেকে নিয়ে প্রত্যাহারের জন্য চাপ দেয়া হয়। এখন এ কমিটি ভেঙে দিয়ে জেলা সমবায় অফিস প্রশাসক নিয়োগ করুক। তারা সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে নির্বাচন পরিচালন করবে। এতে যোগ্য প্রার্থীরা অংশ নিবেন এবং যোগ্যদের হাতেই ফিরে আসবে ঐতিহ্যবাহী দি চিটাগাং কো–অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটি লিঃ।
জানা গেছে, ২০২১ সালের ৪ নভেম্বর ‘দি চিটাগাং কো–অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটি লিঃ’–এর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিসহ তিনজন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সোসাইটির এক সদস্য আজাদীকে বলেন, গত নির্বাচনসহ পূর্বের দুুটি নির্বাচনে ভোটার তালিকায় কারচুপি করা হয়েছে। এছাড়া ওই সময় যোগ্য কেউ প্রার্থী হতে চাইলে বিগত ব্যবস্থাপনা কমিটির প্রভাবশালী কয়েকজন সদস্য চাপ সৃষ্টি করে নির্বাচন থেকে বিরত রাখতেন। স্টেডিয়াম কেন্দ্রিক শক্ত অবস্থান থাকা ওই প্রভাবশালী সদস্য নিজের পছন্দের লোককে বিজয়ী করতে প্রয়োজনীয় সবটুকুই করতেন। এ অবস্থায় সমবায় সমিতি বর্তমান ব্যবস্থাপনা কমিটি ভেঙে প্রশাসক নিয়োগ দিয়ে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করুক।
ব্যবস্থাপনা কমিটির যত অনিয়ম : সমবায় অফিসের ২০২১–২০২২ ও ২০২২–২০২৩ অর্থবছরের অডিট প্রতিবেদনে দি চিটাগাং কো–অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটি লিঃ’–এর ব্যবস্থাপনা কমিটির নানা অনিয়ম উদঘাটন করা হয়। যা গত ২০ আগস্ট ব্যবস্থাপনা কমিটিকে দেয়া নোটিশেও উল্লেখ করা হয়।
নোটিশ সূত্রে জানা গেছে, সোসাইটির বড়দীঘির প্রকল্পে ৩ কোটি ১৪ লাখ ৪৬ হাজার ৯৯৭ টাকা ব্যয়ের ক্ষেত্রে সমবায় সমিতি বিধিমালা অনুযায়ী নিবন্ধকের অনুমতি নেয়া হয়নি। এর মধ্যে ২০২১–২০২২ অর্থ বছরের জমি ক্রয় বাবদ ব্যয় হয় ৩ কোটি ১১ লাখ ৭০ হাজার ৩৯৭ টাকা এবং একই প্রকল্পে উন্নয়ন খরচ বাবদ খরচ হয় বাকি ২ লাখ ৭৬ হাজার ৬০০ টাকা। এ অনিয়মের জন্য ব্যবস্থাপনা কমিটিকে দায়ি করা হয়।
জেলা সমবায় অফিস সূত্রে জানা গেছে, বড়দীঘির প্রকল্প অথবা বিনিয়োগ প্রস্তাবও বিধি মোতাবেক নিবন্ধকের অনুমোদন গ্রহণ করা হয়নি। যার জন্য ব্যবস্থাপনা কমিটি দায়ি। ২০২২–২০২৩ অর্থবছরের অডিট প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রকল্পে ৫ কোটি ৬৩ লাখ ৭৯ হাজার ৪৩৩ টাকা বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও নিবন্ধকের অনুমোদন নেয়া হয়নি। এছাড়া প্রকল্পটিতে এ পর্যন্ত ব্যয় হওয়া অর্থের হিসাব উদ্ধৃত পত্রে প্রদর্শন না করা এবং সদস্যদের নিকট হতে প্লট বরাদ্দের বিপরীতে প্রাপ্ত অর্থ পুঞ্জিভূত ব্যয় থেকে প্রত্যাহার দেখিয়ে মনগড়া হিসাব উপস্থাপন করে ব্যবস্থাপনা কমিটি।
অডিট রিপোর্ট সূত্রে জানা গেছে, ব্যবস্থাপনা কমিটির কোষাধ্যক্ষ মো. সাজ্জাদ হোসেন–এর ব্যক্তিগত মামলা খরচ বাবদ ৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা সমিতির তহবিল হতে প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া হাইকোর্টের আদেশ (মামলা নং–১১৬৯০/২০২১) অমান্য করে ২০২১ সালের ১২ ডিসেম্বর ব্যবস্থাপনা কমিটির সভা অনুষ্ঠানপূর্বক ২০২১ সালের ১৩ ডিসেম্বর আইনজীবীর অনুকূলে উক্ত টাকার টাকার চেক ইস্যু করে এবং একই বছরের ১৯ ডিসেম্বর এ টাকা সমিতির ব্যাংক হিসাব থেকে উত্তোলন করা হয়। জন্য ব্যবস্থাপনা কমিটির ১০ জন সদস্যকে দায়ি করা হয়। এ ১০ জন হচ্ছেন– ব্যস্থাপনা কমিটির সভাপতি এ এ মোহাম্মদ সাইফুদ্দীন, সহ–সভাপতি আলহাজ্ব মোহাম্মদ ইদ্রিছ, সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আলমগীর পারভেজ, কোষাধ্যক্ষ মোহাম্মদ সাজ্জাদ, সদস্য মোহাম্মদ জসিমুল আনোয়ার খান, আলাউদ্দীন আলম, মোরশেদ আহমেদ, মোহাম্মদ রাইসুল উদ্দিন, এমদাদুল আজিজ চৌধুরী এবং মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম। জানা গেছে, উত্তোলনকৃত টাকা ১২০ দিনের মধ্যে সমিতির তহবিলে জমা দেয়ার জন্য গত আগস্ট মাসে জেলা সমবায় অফিস থেকে নির্দেশনাও দেয়া হয়।
জেলা সমবায় অফিস সূত্রে জানা গেছে, সমিতির সমবায় উন্নয়ন তহবিলের দেনা আছে ৫৮ লাখ ৮৪ হাজার ৬৭৩ টাকা। ধার্যকৃত সমবায় উন্নয়ন তহবিল পরিশোধ না করায় সমবায় আইন ও বিধি লঙ্ঘন করা হয়েছে। এছাড়া সমিতির কার্যকরী মূলধন এক কোটি টাকার বেশি হওয়া সত্ত্বেও বিধি মেনে সমবায় সমিতি অভ্যন্তরীণ অডিট সেল গঠন করা হয়নি। এসব অনিয়মের জন্যও ব্যবস্থাপনা কমিটিকে দায়ি করা হয়।
জেলা সমবায় অফিস সূত্রে জানা গেছে, সোসাইটির অফিস ঘর নির্মাণের পূর্বেও বিধি অনুযায়ী প্রকল্প অথবা বিনিয়োগ প্রস্তাবে নিবন্ধকের অনুমোদন গ্রহণ করা হয়নি। এমনকি ভবনের প্রাক্কলিত বাজেট ও সোসাইটির ভবনের নকশা জেলা সমবায় কার্যালয়ে দাখিল না করা এবং ভবন প্রকল্পের পুঞ্জিভূত ব্যয় এবং ফ্ল্যাট বরাদ্দ বাবদ প্রাপ্ত আয় সমিতির হিসাব বিবরণীতে প্রদর্শন না করে মনগড়া হিসাব উপস্থাপনের জন্য ব্যবস্থাপনা কমিটি দায়ি।
সদস্যদের লাভ থেকে বঞ্চিত করা হয় : ২০২২–২০২৩ অর্থবছরের অডিট প্রতিবেদন অনুযায়ী, সোসাইটিতে অবন্টিত মুনাফার পরিমাণ ১৭ কোটি ৬৫ লাখ ৩৯ হাজার ৭১৭ টাকা। বিপুল এই মুনাফা অবন্টিত রেখে সোসাইটির সদস্যদেরকে লাভ হতে বঞ্চিত করেছে ব্যবস্থাপনা কমিটি।
এছাড়া সোসাইটির সদস্য রেজিস্টারে ভর্তি ও প্রত্যাহার বিষয়ে হালনাগাদ তথ্য নেই। সদস্য নম্বর ১ থেকে ৩৯৮২ পর্যন্ত যাদের নাম রয়েছে তা কাগজে স্বাক্ষর নিয়ে কাট–পেস্ট করা হয়েছে। সদস্য নং ৩৯৮৩ হতে ৫০৬৪ পর্যন্ত সদস্যদের কোন স্বাক্ষর নেই। ফলে সমবায় সমিতি বিধিমালা, ২০০৪ এর ৫৬(ক) বিধিতে বর্ণিত রেজিস্টার সঠিকভাবে সংরক্ষণ না করার জন্য ব্যবস্থাপনা কমিটি দায়ি।
দেউলিয়া হওয়ার উপক্রম : সমবায় অফিসের দেয়া নোটিশে বলা হয়, দি চিটাগাং কো–অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটি লি: –এর ব্যবস্থাপনা কমিটি সমবায় সমিতি আইন ও বিধিমালা পরিপন্থী কার্যকলাপ করেছে। এছাড়া কমিটির ১০ জন সদস্যের উপর সমবায় সমিতি আইন, ২০০১ (সংশোধন ২০০২ ও ২০১৩) এর ৮৩(২) ধারায় চূড়ান্ত দায় নির্ধারিত হয়েছে। এ বিষয়ে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণের নিমিত্ত প্রাপ্ত তদন্ত প্রতিবেদনে সুনির্দিষ্ট সুপারিশ করে। এতে সোসাইটির সাধারণ সদস্যদের স্বার্থ ক্ষুন্ন হচ্ছে এবং সোসাইটি দেউলিয়া হওয়ার উপক্রম হচ্ছে।
অতঃপর কমিটি ভেঙ্গে দেয়ার নির্দেশনা : গতকাল ব্যবস্থাপনা কমিটি ভেঙে দেয়ার নির্দেশনা সম্বলিত জেলা সমবায় অফিসের চিঠিতে বলা হয়, অডিট প্রতিবেদনের উদঘাটিত অনিয়ম এবং অডিট প্রতিবেদনের উপর চূড়ান্ত দায় নির্ধারণের প্রেক্ষিতে ব্যবস্থাপনা কমিটিকে কারণ দর্শানো পূর্বক শুনানিতে উপস্থিত হয়ে জবাব দাখিল করতে বলা হয়। কিন্তু সোসাইটির ব্যবস্থাপনা কমিটি নির্ধারিত শুননিতে উপস্থিত হননি। তাই সমবায় সমিতি আইন, ২০০১ (সংশোধন, ২০০২ ও ২০১৩) এর ২২(১) ধারা মোতাবেক সমিতির বর্তমান ব্যবস্থাপনা কমিটি ভেঙ্গে দেওয়ার উদ্দেশ্যে আগামী ৩০ (ত্রিশ) দিনের মধ্যে বিশেষ সাধারণ সভা আহ্বান করার জন্য ব্যবস্থাপনা কমিটিকে নির্দেশ প্রদান করা হলো। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বিশেষ সাধারণ সভা অনুষ্ঠানে ব্যর্থ হলে সমবায় সমিতি আইন মোতাবেক পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।