‘সদরুল’ নামটি আরবী। অর্থ : প্রধান বা নেতা। ‘পাশা’ নামটি আবার ফারসী। এর অর্থ : যিনি বিশেষ সম্মানীয় ব্যক্তি। উসমানীয় শাসনামলে ‘পাশা’ নামে এই পদবী দেয়া হতো রাজ্যপাল, সেনানায়ক কিংবা উচ্চ মর্যাদা বীরোচিত ব্যক্তিকে। সেই অর্থে সদরুল পাশা নামের অর্থ হচ্ছে: তিনি একজন প্রধান ও বিশেষ সম্মানীয় ব্যক্তি। এই যদি হয় নামের অর্থ : তাহলে চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করা ‘সদরুল পাশা’ নামের এই মানুষটি নিজেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন এই নামের সার্থকতা দিয়ে।
স্বাধীনতা উত্তর চট্টগ্রামে সংস্কৃতি চর্চা ও নাট্য আন্দোলনের অগ্রগামী সেনাপতির নাম: সদরুল পাশা। রাজনীতি পরিবারে জন্ম তাঁর। বাবা ডাঃ বি.এম. ফয়জুর রহমান এবং মা সেলিমা রহমান। আজ ২০২৫ সালে এই সদরুল পাশার মৃত্যু বার্ষিকীর দিন ভাবতে গিয়ে অবাক হই, কীভাবে তাঁর নামটি এমন সার্থক রূপ দিয়েছেন।
তরুণ তুর্কী চেঙ্গিস খানের মতই দাপিয়ে বেড়িয়েছেন চট্টগ্রামের আরেক তুর্কী। ‘চেঙ্গিস’ শব্দের অর্থও কিন্তু সাগর। বঙ্গোপসাগরের পারে দক্ষিণ চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার সন্তান সদরুল পাশা আমাদের দেখিয়েছেন – কীভাবে নেতা হতে হয়। কীভাবে সংগঠন করতে হয়। কীভাবে সংস্কৃতি চর্চা করতে হয়। কীভাবে আধুনিকতার সাথে শিল্প ও সংস্কৃতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয়। একই সাথে তিনি দেখিয়েছেন রুটি–রুজির সমন্বয়। সবকিছু ভাবলে অবাক হওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই।
বলা হয়, ১৯৭৩–১৯৭৮ সাল চট্টগ্রামের মঞ্চ নাটকের সোনালী অধ্যায়। আর এই অধ্যায়ের নেতৃত্বে ছিলেন সদরুল পাশা। চট্টগ্রাম কলেজে পড়াকালীন তিনি পেয়ে গেলেন অধ্যাপক মমতাজউদ্দিন আহমেদকে। আবার সেই সময়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করতে আসা নাগরিক নাট্য সমপ্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অধ্যাপক জিয়া হায়দারও যুক্ত হয়েছিলেন চট্টগ্রামের গ্রুপ থিয়েটারের সাথে। এই দুই গুণী অধ্যাপকের সংস্পর্শে এসে বারুদের মতো জ্বলে উঠলেন সদরুল পাশা। গায়ে তখনও মুক্তিযুদ্ধের উত্তাপ। সেই উত্তাপের সবটুকুই দান করলেন মঞ্চ নাটকে। প্রথমে থিয়েটার ৭৩ গড়লেন সমমনাদের নিয়ে এবং পরে আবার ১৯৭৪ সালে গড়ে তুললেন অরিন্দম নাট্য সমপ্রদায়। ঐ সময়ের যাঁরা আছেন, তাঁরা আজো শিহরিত হোন – সদরুল পাশার অভিনয় বিষয়ে কথা বলতে গেলে। ‘ম্যাসাকার’, ‘স্পাটাকাস বিষয়ক জটিলতা’, ‘শুভ্রা সুন্দর কল্যাণী আনন্দ’, ‘ফলাফল নিম্নচাপ’ – ইত্যাদি নাটকগুলোয় অভিনয় করে সদরুল জানান দিলেন চট্টগ্রামের গ্রুপ থিয়েটার চর্চা কীভাবে করতে হয়। আবার অরিন্দম নাট্য সমপ্রদায় গড়ে নিজেকে যেন শাণিত করলেন। এবার তাঁর চিন্তাভাবনায় এলো আধুনিকতা ও মৌলিক উপস্থাপনা ও সমসাময়িক প্রেক্ষাপট। ‘যামিনীর শেষ সংলাপ’ নাটকের কথা আজও জনপ্রিয় ও স্মরণীয় হয়ে আছে। তেমনি তাঁর অভিনীত ‘থিয়েটারের ব্যাকওয়াল’, ‘ফলাফল নিম্নচাপ’, ‘মল্লিকার চোখে জল’, ‘শনিবার’ ইত্যাদি নাটকে তাঁর সাড়া জাগানো অভিনয় ও নির্দেশনা নাট্যামোদীদের কাছে নাটক সম্পর্কে নতুন বার্তা এনে দিলো। সেই সময়ে চট্টগ্রামের সংস্কৃতিবান পরিবারের ছেলে–মেয়েরা গ্রুপ থিয়েটারের সাথে সানন্দে যুক্ত হয়েছেন। সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চায় উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। নাটক, গান, বিতর্ক, নাচ– সববিষয়ে চট্টগ্রাম দেশ কাঁপাচ্ছিল। আজকের তরুণ সমাজ কী ভাবতে পারবে, কতটুকু জনপ্রিয় অভিনেতা হলে সদরুল পাশার নাটকের টিকেট কালোবাজারি হয়? এটাও চট্টগ্রামে হয়েছে। টগবগিয়ে ছুটে চলা সেই গৌরবময় অধ্যায়ের অগ্রপথিক সদরুল পাশা।
১৯৭৮ সালে হঠাৎ করেই সদরুল পাশা নাটক ছেড়ে দিলেন। চলে গেলেন আরও আধুনিকতার সংস্পর্শ নিতে। নিজেকে গড়েছেন। ভেঙেছেন। আবারও গড়েছেন। সদাই চঞ্চল তারুণ্যের উচ্ছাসে মেতে থাকা সদরুল পাশা। এবারের যাত্রা ভারতের পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউটে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ দ্বিতীয় বর্ষ শেষ করে – ঐটুকুতেই ইস্তফা দিয়ে বৃত্তি নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের উপর কোর্স নিতে চলে গেলেন। একেবারেই ভিন্ন মাধ্যমে কাজ শেখা। সৃষ্টি যাঁর নেশা, তিনি যেকোন মাধ্যমেই তো সৃষ্টি করার ক্ষমতা রাখেন।
১৯৮৪ সালে দেশে ফিরলেন সদরুল পাশা। এবার নতুন করে নতুন কিছু সৃষ্টিতে মেতে উঠলেন। দেশের বিভিন্ন পণ্যের বিপননের জন্য বিজ্ঞাপনের বিষয়টিতে নতুনত্ব আনলেন বিজ্ঞাপন চিত্র তৈরি করে। তাঁর গড়া ‘সৃষ্টি’ বিজ্ঞাপনী সংস্থা থেকে নির্মিত হতে থাকে বিজ্ঞাপন চিত্র, তথ্য চিত্র, নাটক। আর বাংলাদেশ টেলিভিশনে মেতে থাকলেন অভিনয়ে।
বিটিভিতে প্রচারিত নাটকগুলো ছিল সত্তর/আশির দশকে বিনোদনের উপকরণ। আমরাও অধীর আগ্রহে থাকতাম। আফজাল, সুবর্ণা, আসাদ, ফরিদী, শম্পা রেজা, চম্পা নাটকে থাকা মানে হিট নাটক। আমরাও অপেক্ষায় থাকতাম। সেই সময় হঠাৎ করে ‘আশ্রয়’ নামে এক নাটকে মানসিক ভারসাম্যহীন এক চরিত্রে অভিনয় করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিলেন একজন নতুন অভিনেতা। নাম : সদরুল পাশা। আমরা তখন কলেজে পড়ি। একদিন জানলাম, আমাদের বন্ধু গীতিকবি আসিফ ইকবালের বড় ভাই সদরুল পাশা। শুনে দারুণ চমকিত হই। পরে তো আসিফের সাথে বন্ধুত্বতার সূত্রে নন্দনকানন বাসায় নিত্য যাতায়াত। পাশা ভাইকে প্রথম দেখলাম জেসি আপার বিয়েতে। এরমধ্যে পাশা ভাই টিভি নাটকে স্বতন্ত্র ইমেজের অধিকারী হয়ে গেছেন। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার পর আমরা ঢাকা যেতাম দল বেঁধে। আজগর বাবু, মাসুদ, তাপস, শাহীন, সোমেন। ঠিকানাঃ মগবাজারে পাশা ভাইয়ের বাসা (ডা. বদরুজ দোজার গলি) পাশা ভাই তখন নাটকে অভিনয়ের পাশাপাশি বিজ্ঞাপন চিত্র নির্মাণ করতেন। সেই সময়ে ‘ শুকতারা‘ নামে একটি ধারাবাহিক নাটক জনপ্রিয় হয়। পাশা ভাই ঐ নাটকের নায়ক। যাক, সেই পাশা ভাইয়ের সাথে ঢাকার বাসায় আলাপ– কথা। আমি ‘হা’ করে তাকিয়ে দেখি একজন ‘তারকাকে’। যা বলেন, তাতেই মুগ্ধ। তার অনেক বছর পর ১৯৯২ সালে অরিন্দম নাট্য সমপ্রদায়ের উনিশতম প্রযোজনা ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর’ নাটকে নেপথ্যের কর্মী হিসেবে আমার যুক্ত হওয়া। পরে বিশতম প্রযোজনা ‘সাজন মেঘ’ নাটকে অভিনয় এবং পরবর্তীতে অরিন্দমের বিভিন্ন প্রকাশনার সাথে যুক্ত থেকে কাজ করেছি।
চট্টগ্রামে পাশা ভাইয়ের প্রতিষ্ঠিত অরিন্দম নাট্য সমপ্রদায়ে যখন কাজ করি, তখন আরেক অনুভূতি হয়। যে মানুষটি আমার তারকা ছিলেন, তারই নাট্য দলে কাজ করছি। আর যখন আমি কাজ করছি অরিন্দমে, তখন পাশা ভাই আকাশের তারা হয়ে গেছেন। পাশা ভাই অরিন্দম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বলেই আজ আমরা নিজেদের মেলে ধরার সুযোগ পেয়েছি। চট্টগ্রামের গ্রুপ থিয়েটারকে এবং সংস্কৃতি চর্চাকে আধুনিকতার সাথে সাজিয়ে দিয়ে গেছেন পাশা ভাই।
আমাদের নাট্যজগতের অগ্রজ ও প্রিয়জন, যিনি সদরুল পাশার স্নেহধন্য মুনির হেলাল একসময়ে গড়ে তুললেন একাডেমি অব পারফর্মিং আর্টস। তিনি তাঁর সংগঠন থেকে চালু করলেন ‘সদরুল পাশা স্মৃতি পদক’। নিঃসন্দেহে এটি পাশা ভাইয়ের প্রতি আমাদের সকলের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার। ইতিমধ্যে চারজন গুণীকে এই পদক প্রদান করা হয়েছে। এঁরা হলেন রাইসুল ইসলাম আসাদ, এনায়েত হোসেন, জাকারিয়া মামুন এবং শুভ্রা বিশ্বাস।
অরিন্দম নাট্য সমপ্রদায়ও ‘সদরুল পাশা সম্মাননা স্মারক’ প্রদান করেছে। এটিও সদরুল পাশার কাজের প্রতি চট্টগ্রামে নাট্য কর্মীদের শ্রদ্ধা। অরিন্দম ‘সদরুল পাশা সম্মাননা স্মারক’ যাঁদের হাতে তুলে দিয়েছেন, তাঁরা হলেন ফেরদৌসী মজুমদার, সারা যাকের এবং শিমুল ইউসুফ। এঁরা সকলেই বাংলাদেশের নাট্যভুবনে শ্রদ্ধেয়জন।
১৯৯৫ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর তারিখে আকস্মিক চিরবিদায় নিলেন সদরুল পাশা ভাই। বয়স মাত্র একচল্লিশ। এমন বিদায় আমাদের সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রটিকে অনেকটাই সংকুচিত হয়ে গেছে। যা এখন, ২০২৫ সালে এসে উপলব্ধি করি। মহান আল্লাহ তায়ালা পাশা ভাইয়ের বেহেশত নসীব করুন।
লেখক : প্রাবন্ধিক