মসজিদ থেকে মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে ভেসে আসে ‘আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম’। রোজ ফজরের আজান শুনে আইয়ূব সাহেবের ঘুম ভাঙে। এরপর নামাজ পড়ে ভোরে ভোরে হাঁটতে বেরিয়ে যান। কমপক্ষে আধাঘন্টা হাঁটাহাঁটি করে বাড়ি ফিরে গোসল করেন। তারপর নাস্তা সারেন। এটা তাঁর বিশ বছরের অভ্যাস। বয়সে বয়সে অনেক অভ্যাস পরিবর্তন হলেও এটা এখনও টিকিয়ে রেখেছেন। ফলে বাষট্টি বছর বয়সেও দারুন চনমনে আইয়ূব সাহেব।
নামাজ শেষে হাঁটতে বেরুনোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। হঠাৎ দরজায় ঠক ঠক শব্দ। বাইরে একটু একটু আলো ফোটেছে মাত্র। এসময় আবার কে এলো? দরজার খোলে দেখেন, একজন অপরিচিত লোক। সাথে দশ–বারো বছরের একটা ছেলে। চোখে–মুখে ঘাম, দুজনরেই খালি পা। একটু পর পর চোখ মুছছে লোকটা। গায়ে ময়লা কাপড়।
‘কে আপনি?’ আইয়ূব সাহেব জিজ্ঞেস করলেন।
‘স্যার আমি আফনের গাড়ির গ্যারেজে রাখা গরুটার মালিক।’
‘মালিক মানে! গতকাল সন্ধ্যায় সরকার হাট থেকে এক লাখ ষাট হাজার চারশ পঁচাত্তর টাকা দিয়ে গরু কিনে আনলাম, আর তুমি বলছো ‘গরুর মালিক!’
‘না স্যার, আসলে আমি গরুটার মালিক আছিলাম, মানে গতকাল আমিই গরুটা আফনের কাছে বিক্রি করছি।’
‘ও আচ্ছা, তাই তো বলি চেহারাটা কেমন চেনা চেনা লাগছে! তা এত ভোরে কেনো এলে? ভুল করে টাকা কম দিয়েছি? নাকি জাল নোট পড়েছে?
লোকটা ‘না সূচক’ মাথা নেড়ে চুপ হয়ে যায়। চোখ থেকে পানি পড়ছে অনবরত।
আইয়ূব সাহেব বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আরে কী হয়েছে বলবে তো! কাপড়–চোপড় লাগবে? নাকি আরও টাকা চাও?’
‘না স্যার, আসলে গরুটারে শেষবারের মত এক নজর দেখতে আইছিলাম। আমার পোলাডা সারা রাইত কিছু খায় নাই, ঘুমাই নাই। বারবার গরুটারে দেখতে চাইতেছে। তাই মাঝরাইতে হাঁটা ধরছি, ৬ মাইল হাঁইট্যা আইছি স্যার। যদি কিছু মনে না করেন, অনুমতি দিলে গরুটারে একটু দেইখ্যা যাইতাম।’
সামান্য একটা গরুর প্রতি এমন মায়া দেখে আইয়ূব সাহেব নিস্তব্ধ হয়ে গেলেন। দেরি না করে নিজেই গ্যারেজ খুলে দিলেন। লোকটা ভেতরে ঢুকেই গরুকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলেন। ছোট ছেলেটাও কাঁদছে আর লোকটাকে জড়িয়ে ধরে বলছে, ‘বাজান, ওই স্যাররে ট্যাকা ফেরত দিয়া দেও, আমি গরু নিয়া যামু! বাজান! ও বাজান! আমি গরু নিয়া যামু।’
ছেলেকে কোনো উত্তর দিতে পারছে না লোকটা। শুধু কেঁদেই যাচ্ছে। আইয়ূব সাহেব দূর থেকে চুপচাপ দেখে যাচ্ছেন সব। বেশ কিছুক্ষণ পরে বাপ–ছেলে বেরিয়ে এলো গ্যারেজ থেকে। লোকটা চোখ মুছতে মুছতে বলল, ‘স্যার, আফনেরে কষ্ট দিলাম, মনে কিছু নিয়েন না।’
‘ও তোমার বড় ছেলে?’
‘জ্বী স্যার, একটাই পোলা। এইডারে পড়ালেখা করানোর লাইগ্যা আদরের গরুটা বেইচ্যা দিলাম।’
‘কোন ক্লাসে পড়ে?’
‘হাই ইস্কুলে পড়ে, সেভেনে। গেলাম স্যার, আসসালামু আলাইকুম।’
‘একটু দাঁড়াও।’ আইয়ূব সাহেব ঘর থেকে এক হাজার টাকার দুটা নোট এনে জোর করে ছেলেটার হাতে গুঁজে দিয়ে বললেন, ‘ঈদের দিন এসে খেয়ে যেও।’
তারপর বিদায় দিয়ে আইয়ূব সাহেব ঘরের ভেতরে ঢুকতে না ঢুকতেই লোকটা আবার হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে দৌঁড়ে এলো, ‘স্যার স্যার, আরেকটা কথা স্যার।’
‘বলো?’
‘জবাই করার সময় গরুটারে একটু আস্তে ফালায়েন স্যার। অনেক আদরের গরু তো, যেন কষ্ট না পায়…। এইটুকু বলেই লোকটা আবার কেঁদে ওঠল। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে চোখ মুছতে মুছতে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে রাস্তার দিকে হাঁটা ধরে লোকটা। আইয়ূব সাহেব অনুভব করলেন নিজের চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। গেইটের গ্রিল ধরে লোকটাকে যতদূর দেখা যায় নিশ্চুপ তাকিয়ে থাকেন। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বিড়বিড় করে বলে ওঠেন, ‘এই মানুষগুলোর কুরবানিই, সত্যিকারের কুরবানি।’