এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে সড়ক ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে বছরে প্রায় সাড়ে ৪১ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় করে সরকার। জ্বালানি তেল ও যানবাহন থেকে শুল্ক, কর ও নিবন্ধন ফি আদায় এবং টোল বাবদ আয় হয় এ অর্থ। যদিও সড়ক রক্ষণাবেক্ষণে ব্যয় হয় তার মাত্র ২১ শতাংশ বা ৮ হাজার ৭৬০ কোটি টাকা। ফলে দেশের সড়ক নেটওয়ার্কের একটি বড় অংশই থেকে যাচ্ছে ভাঙাচোরা দশায়।
‘রোড মেইনটেন্যান্স ফাইন্যান্সিং অ্যান্ড কস্ট রিকভারি অপশনস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সড়ক ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে প্রতি বছর ১২টি খাতে আয় করে বাংলাদেশ সরকার। এর মধ্যে জ্বালানি তেলের কাস্টমস শুল্ক বাবদ বছরে আয় হয় ৬ হাজার ৫৫২ কোটি টাকা। অগ্রিম কর বাবদ ৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা আয় হয়। ১ হাজার ৩০৮ কোটি টাকা আসে অগ্রিম আয়কর বাবদ। মূল্য সংযোজন কর থেকে আয় হয় আরো ১০ হাজার ৮১২ কোটি টাকা।
রাষ্ট্রীয় কোষাগারে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ রাজস্ব দেয়ার পরও সড়ক ব্যবহারকারীদের চলাচল করতে হচ্ছে ভাঙাচোরা সড়কে। বাংলাদেশে প্রায় চার লাখ কিলোমিটার সড়ক নেটওয়ার্ক, যার ৪৫ শতাংশ পাকা। আর এসব সড়ক রক্ষণাবেক্ষণে প্রতি বছর ২৬ হাজার ৭৯৬ কোটি টাকা প্রয়োজন বলে উল্লেখ করা হয়েছে এডিবির প্রতিবেদনে। যদিও এ খাতে সরকার বছরে ব্যয় করছে কেবল ৮ হাজার ৭৬০ কোটি টাকা, যা চাহিদার মাত্র ৩৩ শতাংশ।
দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কগুলোর নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ)। সংস্থাটির আওতাভুক্ত জাতীয়, আঞ্চলিক ও জেলা মহাসড়কের পরিমাণ প্রায় সাড়ে ২২ হাজার কিলোমিটার। অন্যদিকে দেশের পাকা সড়ক নেটওয়ার্কের সিংহভাগ অংশ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। ১ লাখ ৬১ হাজার কিলোমিটারের বেশি পাকা সড়ক রয়েছে সংস্থাটির আওতাধীন। এলজিইডি মূলত উপজেলা, ইউনিয়ন ও গ্রামীণ সড়ক নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ করে।
প্রকৌশলীদের মতে, বিশ্বের উন্নত দেশগুলো মহাসড়ক নির্মাণের ক্ষেত্রে যেসব যন্ত্র ব্যবহার করা হয়, সেগুলো বাংলাদেশেও ব্যবহার করা হয়। নির্মাণযন্ত্র এক হলেও পার্থক্য সেগুলোর মানে। দেশী ঠিকাদাররা যেসব যন্ত্র ব্যবহার করেন, তার বেশির ভাগই পুরনো ও রিকন্ডিশন্ড। বিদেশী ঠিকাদাররা বিভিন্ন প্রকল্পের কাজে যেসব নির্মাণযন্ত্র নিয়ে আসেন, কাজ শেষের পর সেগুলো দেশের ঠিকাদারদের কাছে কম দামে বিক্রি করে দেন। আবার বিদেশ থেকেও সরাসরি রিকন্ডিশন্ড যন্ত্রও সংগ্রহ করতে দেখা যায় ঠিকাদারদের। দীর্ঘদিন ব্যবহারের কারণে এসব যন্ত্রের কর্মক্ষমতা কমে যায়।
আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে বাজেট স্বল্পতার কারণে রাস্তাঘাট বারবার করা সম্ভব নয়। তাই এর স্থায়িত্ব রক্ষা ও রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়ে সচেতন করতে হবে। তাহলেই আমরা পারব বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্য দিয়ে গড়া আমাদের উন্নতির প্রধান মাধ্যম যোগাযোগ ব্যবস্থাকে সচল রাখতে। কোনো কিছু ধ্বংস বা নষ্ট করার জন্য কোনো মানুষ এককভাবে দায়ী নয়, এর জন্য দায়ী আমরা সবাই। দেশের জন্য ক্ষতিকর যেকোনো কর্মকাণ্ড প্রতিহত করতে হবে যার যার অবস্থান থেকে।
যোগাযোগ অবকাঠামো বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় বেশি হওয়ার অন্যতম কারণ হলো সময়ের কাজ সময়ে করতে না পারা। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সামছুল হক বলেন, ‘টাকার অভাবে আমরা সময়মতো রাস্তা মেরামত করতে পারি না। এ সময়ে রাস্তা আরো বেহাল অবস্থায় চলে যায়। ফলে রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় বাড়তে থাকে চক্রাকারে।’ কার্যকর সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ তহবিল গড়ে তুলে সমস্যাটির টেকসই সমাধান সম্ভব উল্লেখ করে বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘সরকার সড়ক ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে নানাভাবে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয় করে। এ রাজস্বের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ তহবিলে রাখতে পারলে সেই অর্থ দিয়ে সহজেই সময়মতো রক্ষণাবেক্ষণের মতো কাজগুলো করে নেয়া যায়। বিষয়টি খুব জটিল কিছু নয়। দরকার শুধু সদিচ্ছা।’ তাঁরা বলেন, উন্নত সড়ক নেটওয়ার্ক গড়তে রক্ষণাবেক্ষণে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। কেবল রক্ষণাবেক্ষণের বরাদ্দ বাড়ালেই হবে না, প্রশাসনিক অদক্ষতা ও অনিয়মগুলো দূর করতে হবে।