সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিতে ৮ বিষয়ে পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের গুরুত্বারোপ

রাতের বেলা যত্রতত্র গাড়ি না রাখার আহ্বান মেয়রের । যানবাহন পাহারায় প্রশাসনের পাশাপাশি মালিক-শ্রমিকদের নিয়ে কমিটি করার পরামর্শ

আজাদী প্রতিবেদন | বৃহস্পতিবার , ২৫ জুলাই, ২০২৪ at ১০:৪৪ পূর্বাহ্ণ

রাতের বেলা যত্রতত্র গাড়ি না রাখার জন্য পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। এসময় যেখানেসেখানে গাড়ি রাখলে দুর্বৃত্তরা সুযোগ পাবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। এছাড়া যানবাহন পাহারায় প্রশাসনের পাশাপাশি মালিকশ্রমিকদের নিয়ে একটি কমিটি করারও পরামর্শ দেন মেয়র। বলেন, যারা মালিকশ্রমিক আছেন উভয়ই গাড়ি পাহারা দেন। কোথাও কোনো সমস্যা দেখলে প্রশাসনকে অবহিত করুন। প্রয়োজনে আমাকে জানান। প্রশাসনের সাথে যোগাযোগ করে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হবে। এসময় যাত্রী, মালিক, গাড়ি ও সংশ্লিষ্ট কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুসারে প্রশাসন সজাগ আছে বলেও মন্তব্য করেন মেয়র।

গতকাল বুধবার সকালে টাইগারপাসস্থ চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) অস্থায়ী কার্যালয়ে নগরের পরিবহন মালিকশ্রমিক সংগঠনগুলোর নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আয়োজিত মতবিনিময় সভায় এসব কথা বলেন মেয়র। সভায় পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা চলমান পরিস্থিতিতে সড়কে যানবাহন চলাচলের ক্ষেত্রে তাদের শঙ্কা ও উদ্বেগ প্রকাশ করেন। একইসঙ্গে সড়কে নিরাপত্তা জোরদারের জন্য প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানান।

সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিতে পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা ৮টি বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন। এগুলো হচ্ছেসড়কে কোনো গাড়ি আক্রান্ত হলে মামলা নেওয়া, সড়কে যাত্রী ও যানবাহনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, পণ্য পরিবহনে পাহারা দেওয়া, গণহারে মামলা না দেওয়া, যত্রতত্র গাড়ি তল্লাশি বন্ধ করা, আক্রান্ত মালিকশ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া ও বাসট্রাক টার্মিনাল নির্মাণ করা। এছাড়া সকাল ৭টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত কারফিউ শিথিল করারও প্রস্তাব দেন পরিবহন মালিকরা।

সভায় চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পরিবহন মালিক গ্রুপের সভাপতি বেলায়েত হোসেন বলেন, সড়কে যানবাহন ও পরিবহন শ্রমিকেরা আক্রান্ত হলে থানায় মামলা নিতে চায় না। তখন মেয়র পুলিশ প্রশাসনকে কোনো গাড়ি সহিংসতার শিকার হওয়ার পর গাড়ির মালিক মামলা করতে চাইলে ওই মামলা গ্রহণ করার পাশাপাশি সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিতে জোরালো ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান।

এসময় সিমপির অতিরিক্ত কমিশনার মো. মাসুদ আহাম্মদ বলেন, মামলা নেয়ার জন্য আক্রান্ত হওয়ার পর কোনো থানা মামলা না নিলে আমাদের জানাবেন। আমরা ব্যবস্থা নেব। যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু রাখতে পুলিশের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করা হবে।

সভায় মেয়র আরো বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনের আড়ালে স্বাধীনতা বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি ও জঙ্গীরা দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করেছে। সাধারণ ছাত্ররা স্বাধীনতা বিরোধীদের ষড়যন্ত্র টের পেয়ে আন্দোলন থেকে সরে গেলেও স্বাধীনতা বিরোধীরা আন্দোলনের আড়ালে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। তাদের আন্দোলনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শ্রমজীবী মানুষ। আন্দোলনের নামে তারা গাড়ি জ্বালিয়ে, গাড়ি ভাংচুর করে পরিবহনখাতের বহু মানুষকে নিঃস্ব করে দিয়েছে। এজন্য পরিবহন মালিকশ্রমিকসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। তাই রাতে পরিবহনের নিরাপত্তা নিশ্চিতে গাড়ির মালিকশ্রমিকদের নেতৃত্বে কমিটি করে নিরাপত্তা টহল দিতে হবে। কোথাও কোনো সমস্যা হলে সাথে সাথে প্রশাসনকে অবহিত করলে প্রশাসন ব্যবস্থা নিবে।

মেয়র বলেন, একাত্তরে আমরা ওদের পরাজিত করেছি, চব্বিশেও করব। এসময় সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপে সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিত হওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থা স্বাভাবিক করার জন্য পণ্য ও যাত্রীবাহী গাড়ি পুরোদমে চালু করতে পরিবহন মালিকশ্রমিক সংগঠনগুলোকে আহবান জানান মেয়র।

পরিবহন মালিকশ্রমিকের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে মেয়র বলেন, আগ্রাবাদে পেপার্কিং চালু করেছি। কুলগাঁওতে বাস টার্মিনাল নির্মাণকাজ পুরোদমে চলছে। বাস স্টপেজ নির্ধারণে জরিপ করে স্থান নির্ধারণের পর উন্নত দেশগুলোর আদলে আলাদা রং দিয়ে বাস স্টপেজ চিহ্নিত করা হবে। ডিজিটাল ট্রাফিক লাইট সিস্টেম নিয়েও চিন্তাভাবনা করছি। পরিবহন মালিকশ্রমিক সংগঠনগুলো সহযোগিতা করলে সরকারের কোনো একটি খাস জমি চিহ্নিত করে বরাদ্দ প্রদান করা হলে বাস ও ট্রাকলরির জন্য টার্মিনাল করার জন্যও আমি পদক্ষেপ নেব।

সিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মো. মাসুদ আহাম্মদ বলেন, যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু রাখতে পুলিশের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করা হবে। মামলা দিয়ে রাজস্ব আহরণ করা পুলিশের উদ্দেশ্য নয়, সড়কে শৃঙ্খলার জন্য মামলা দেওয়া হয়। এটি কীভাবে আরো সহজ করা যায় সেটি বসে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। ট্যাংকলরি যত্রতত্র চেক না করার যদি কোনো সিদ্ধান্ত থাকে সেটি আমাদের দিলে আমরা সেভাবে ব্যবস্থা নিবো। তিনি বলেন, সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিতে পুলিশ কঠোর অবস্থানে আছে। পণ্য পরিবহন বন্ধ থাকলে বাজারে পণ্যের সঙ্কট দেখা দেয়, এতে সাধারণ মানুষ কষ্ট পায়। এজন্য পুলিশ আপনাদের পাশে আছে। আপনারা সরকার নির্ধারিত সময় ও গাইডলাইন মেনে পুরোদমে গাড়ি চলাচলের ব্যবস্থা নিন।

সভায় চসিকের প্যানেল মেয়র মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন, চট্টগ্রাম জেলা সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপের সভাপতি মাহবুবুল হক মিয়া, চট্টগ্রাম সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপের মহাসচিব মনজুরুল আলম চৌধুরী, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পরিবহন মালিক গ্রুপের সভাপতি বেলায়েত হোসেন বেলাল, আমজাদ হোসেন হাজারী, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের পূর্বাঞ্চল কমিটির সভাপতি মৃণাল চৌধুরী, আরাকান সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মো. মুছা, উত্তর চট্টগ্রাম ট্রাক মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. আহসানউল্যা চৌধুরী হাসান, চট্টগ্রাম বিভাগীয় ট্যাংকলরি শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি রবিউল মাওলা, চট্টগ্রাম জেলা সড়ক মালিক গ্রুপের মহাসচিব হাজী মো. ইউনুছ, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক অলি আহমদ, পণ্য পরিবহন মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক কে এম মহিউদ্দিন বক্তব্য রাখেন।

সভায় পরিবহন শ্রমিকমালিক নেতৃবৃন্দ জানান, আন্দোলনে তাদের অনেক গাড়ি ভাংচুর করা হয়েছে, জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে, শ্রমিকদের আহত করা হয়েছে। তারা এর সুষ্ঠু বিচার দাবি করেন। নেতৃবৃন্দ জানান, আন্দোলনের কারণে গাড়ি বন্ধ থাকায় অনেক মালিক আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এবং গাড়ির ডকুমেন্টস সময় মতো আপডেট করতে পারেননি। তাই আগামী এক মাস গাড়ির ডকুমেন্টস ফেইল থাকলে মামলা দেয়া থেকে বিরত থাকার জন্য প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানান তারা। গাড়ি রাখার জন্য চট্টগ্রামে পর্যাপ্ত পার্কিং ও টার্মিনাল না থাকায় গাড়ির নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয় জানিয়ে চট্টগ্রামে দ্রুত পার্কিং ও টার্মিনাল নিশ্চিতে পদক্ষেপ নেয়ার দাবি করেন তারা।

মঞ্জুরুল আলম চৌধুরী বলেন, রাজনৈতিক সংঘাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় পরিবহন মালিকশ্রমিকরা। কিন্তু আমরা সেভাবে কোনো ক্ষতিপূরণ পাই না। নির্ভয়ে যেন গাড়ি চালাতে পারি সে সহযোগিতা আমরা চাই।

বেলায়েত হোসেন বেলাল বলেন, সড়কে যানবাহন ও পরিবহন শ্রমিকরা আক্রান্ত হলে থানায় মামলা নিতে চান না। ঘটনার পর সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে যেন মামলা নেওয়া হয়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। সড়কে গণপরিবহনের জন্য পার্কিং লেইন তৈরি করে দিয়ে অবৈধ পার্কিংয়ের মামলা থেকে রেহাই দিতে হবে।

মৃণাল চৌধুরী বলেন, পণ্য পরিবহনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাহারা নিশ্চিত করতে হবে। জীবনের নিশ্চিয়তা তৈরি হলে যাত্রী বাড়বে। যাত্রী বাড়লে যানবাহনও চলবে। আমরা গাড়ি চালাতে চাই, কিন্তু প্রয়োজনীয় নিরাপত্তাও চাই।

রবিউল মওলা বলেন, দেশের যে কোনো দুর্যোগ মুহূর্তে জ্বালানি পরিবহন অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। সেটিই করে থাকে পরিবহন শ্রমিকরা। ট্যাংক লরি যেখানে সেখানে দাঁড়ানো যায় না। এটি ঝুঁকি তৈরি করে। কিন্তু যত্রতত্র ট্যাংকলরিতে দাঁড় করিয়ে কাগজপত্র যাচাই করা হয়। আগের বিভিন্ন সভার সিদ্ধান্ত ছিল ট্যাংকলরির কাগজপত্র নির্দিষ্ট জায়গায় চেক করা হবে। সেটি যেন করা হয়।

আবুল বাসার চৌধুরী বলেন, দূরপাল্লার যাত্রীবাহী বাস চলাচলের জন্য রাতের বেলা ব্যবস্থা রাখতে হবে।

চসিক সচিব মো. আশরাফুল আমিনের সঞ্চালনায় সভায় অংশ নেন কাউন্সিলর আফরোজা কালাম, মো. ইলিয়াছ, আবদুস সালাম মাসুম, মেয়রের একান্ত সচিব আবুল হাশেম, চসিকের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মো. ইমাম হোসেন রানা, প্রধান প্রকৌশলী শাহীন উল ইসলামসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিবৃন্দ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআবেদনের সময় ১ আগস্ট পর্যন্ত বাড়ল
পরবর্তী নিবন্ধপরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলবে না : শিক্ষামন্ত্রী