নানা উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে বড় পরিসরের বিমান হ্যান্ডলিংয়ের সক্ষমতা থাকলেও চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বৈশ্বিক যোগাযোগে প্রত্যাশিত গতি আসেনি। বাংলাদেশ বিমানের পাশাপাশি দুটি বিদেশি এয়ারলাইন্স এখান থেকে ফ্লাইট অপারেট করলেও বিশ্বের বেশি কানেক্টিভিটির কোনো ফ্লাইট অপারেটর নেই চট্টগ্রামে। এতে করে চট্টগ্রাম থেকে বিশ্বের নানা দেশে ভ্রমণের ক্ষেত্রে চট্টগ্রামের মানুষকে ঢাকা হয়ে যাতায়াত করতে হয়। সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে উদ্যোগ নিয়ে এমিরেটস, থাই এয়ার কিংবা সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের মতো ফ্লাইট অপারেটরকে চট্টগ্রামে আনতে পারলে বিপুল সংখ্যক মানুষ উপকৃত হতো বলে মন্তব্য করে বলা হয়েছে, বর্তমানে পশ্চিমমুখী কিছু যোগাযোগ থাকলেও পূর্ব দুয়ার পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে।
শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিমানবন্দর। চল্ল্লিশের দশকের শুরুতে এয়ারফিল্ড হিসেবে এই বিমানবন্দর নির্মাণ করা হয়। মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিত্রবাহিনীর যুদ্ধবিমানের জ্বালানি সরবরাহের জন্য এয়ারফিল্ডটি তৈরি করা হয়েছিল। পরে ধীরে ধীরে তা বিমানবন্দরের রূপ নেয়। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে এটি বাণিজ্যিক অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দর হিসেবে ব্যবহার শুরু হয়। বাংলাদেশ বিমান এবং ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্স এখানে ফ্লাইট অপারেট করতে থাকে। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা এবং কলকাতায় ফ্লাইট চলাচল করত। ১৯৯০ সালে বাংলাদেশ বিমান মধ্যপ্রাচ্যের দুবাই ও সৌদি আরবে যাত্রী পরিবহন শুরু করলে বিমানবন্দরটি ১৯৯০ সালে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে রূপ নেয়। তবে বিমানবন্দরটিকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের স্বীকৃতি লাভ করে প্রায় ২৩ বছর পর ২০১৩ সালে।
এর আগে জাপানি সংস্থা জাইকার আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় ১৯৯৮ সালে বিমানবন্দরটির আধুনিকায়নের কাজ শুরু হয়। ৫৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রায় দুই বছর সময়ে আধুনিকায়নের কাজ সম্পন্ন হয়। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করলেও তেমন উল্ল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিদেশি ফ্লাইট এখানে চলাচল করত না। বাংলাদেশ বিমান সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতে ফ্লাইট অপারেট করত। পরে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান সিল্ক এয়ার, থাইল্যান্ডের থাই এয়ারওয়েজ, থাই স্মাইল এয়ারওয়েজ এবং ফুকেট এয়ার চট্টগ্রাম থেকে থাইল্যান্ডের বিভিন্ন গন্তব্যে ফ্লাইট অপারেট করে। মালয়েশিয়ার মালিন্দো এয়ারলাইন্সও চট্টগ্রাম থেকে কুয়ালালামপুরে যাত্রী পরিবহন করতে থাকে।
পরবর্তীতে এই বিমানবন্দর থেকে যাত্রী পরিবহন করতে শুরু করে ওমান এয়ার। এর আগে জিএমজি এয়ারলাইন্স, বেস্ট এয়ার, ইউনাইটেড এয়ার, রিজেন্ট এয়ার এবং রয়েল এয়ার চট্টগ্রাম থেকে আন্তর্জাতিক রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করে। কিন্তু সবগুলো ফ্লাইট অপারেটর কিছুদিন পরপর বন্ধ হয়ে যায়। বিদেশি অপারেটররা এখান থেকে ব্যবসা গুটিয়ে চলে যায়। দেশীয় এয়ারলাইন্সগুলোও ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে পারেনি। এক পর্যায়ে কেবল রাষ্ট্রায়ত্ত বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইটই এখান থেকে আন্তর্জাতিক রুটে মধ্যপ্রাচ্যে চলাচল করতে থাকে। বর্তমানে বাংলাদেশ বিমানের সাথে ইউএস বাংলা এয়ারওয়েজ এবং এয়ার এরাবিয়া চট্টগ্রাম থেকে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে ফ্লাইট অপারেট করছে। ফ্লাই দুবাই চট্টগ্রাম থেকে যাত্রী পরিবহন করলেও গত ১ সেপ্টেম্বর থেকে তারা ফ্লাইট অপারেট বন্ধ রেখেছে। তবে আগামী ১ মার্চ থেকে আবার চট্টগ্রাম থেকে দুবাই রুটে তাদের ফ্লাইট অপারেট শুরু করার কথা রয়েছে।
বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোর মধ্যে থাই এয়ারওয়েজ চট্টগ্রামে দীর্ঘ সময় ব্যবসা করেছিল। যাত্রী সেবার মান এবং সিডিউল ঠিক রেখে ফ্লাইট অপারেট করায় থাই এয়ারওয়েজ জনপ্রিয়তাও পেয়েছিল। যাত্রীও ছিল প্রচুর। কিন্তু থাইল্যান্ডের অভ্যন্তরীণ সংকটে এখান থেকে ব্যবসা গুটিয়ে চলে যেতে বাধ্য হয় প্রতিষ্ঠানটি। পরবর্তীতে তাদেরকে আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি।
চট্টগ্রাম থেকে বর্তমানে সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতে ফ্লাইট চলাচল রয়েছে। পশ্চিমমুখী এই যোগাযোগ সীমিত। চট্টগ্রাম থেকে ইউরোপ–আমেরিকা, সিঙ্গাপুর, চীন, জাপান এবং কোরিয়াসহ উন্নত দেশগুলোর যাতায়াতের ক্ষেত্রে এসব ফ্লাইট অপারেটরের সুযোগ–সুবিধা সীমিত। অথচ এমিরেটস, থাই এয়ারওয়েজ কিংবা সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের মতো কোনো অপারেটরের একটি ফ্লাইটও যদি সপ্তাহে চালানো সম্ভব হতো তাহলে চট্টগ্রামের মানুষ উপকৃত হতো বলে মনে করছেন ব্যবসায়ী–শিল্পপতিরা এবং যাত্রীরা।
চট্টগ্রামে চীন, জাপান ও কোরিয়ার প্রচুর বিনিয়োগ রয়েছে। এসব দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ বসবাস করেন চট্টগ্রামে। এছাড়া চট্টগ্রামের হাজার হাজার ব্যবসায়ী এবং শিক্ষার্থীসহ পর্যটক নিয়মিত পূর্ব–পশ্চিমের বিভিন্ন দেশে যাতায়াত করেন। যাদেরকে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা হয়ে এমিরেটস, সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্স, থাই এয়ার, গাল্ফ এয়ারসহ বিভিন্ন খ্যাতনামা ফ্লাইট অপারেটরের মাধ্যমে যাতায়াত করতে হয়। পূর্ব এবং পশ্চিমের অন্তত দুটি ফ্লাইট অপারেটরকে চট্টগ্রামে আনা গেলে আকাশপথের অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যায় মন্তব্য করে সূত্র বলেছে, এতে চট্টগ্রামের সাথে কানেক্টিভিটি বাড়ার সাথে সাথে বিনিয়োগ বহু গুণ বৃদ্ধি পাবে। বাড়বে শিল্প–বাণিজ্য এবং পর্যটন খাতের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড।
শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, আমাদের রানওয়ের দৈর্ঘ্য এবং থিকনেস বড় পরিসরের এয়ারবাসসহ সব ধরনের ফ্লাইট অপারেট করতে সক্ষম। বিমানবন্দরের অবকাঠামোগত সুযোগ–সুবিধাসহ সক্ষমতার অনেকটাই অব্যবহৃত রয়ে গেছে। চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে যাত্রীসেবার মানসহ আনুষাঙ্গিক সবকিছু আন্তর্জাতিক মানের। যে কোনো ধরনের যাত্রী এবং ফ্লাইট হ্যান্ডলিং করার সক্ষমতা আমাদের রয়েছে।
চট্টগ্রামের একাধিক ব্যবসায়ী এবং শিল্পপতি বলেছেন, আকাশপথে চট্টগ্রাম থেকে পূর্ব এবং পশ্চিমমুখী যোগাযোগ বাড়ানো সময়ের দাবি। সরকার বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে। তারা বলেন, একসময় যাত্রী সংকটের কথা বলা হতো। এখন চট্টগ্রামে যাত্রী সংকটের কারণ নেই। সপ্তাহে অনায়াসে একাধিক ফ্লাইট অপারেট করার মতো যাত্রী চট্টগ্রামে রয়েছে। তবে সরকারি উদ্যোগ ছাড়া তা সম্ভব নয়।