সকালের পেপারওয়ালা কাকা!

শাহনাজ সিঁথি | সোমবার , ১৩ মে, ২০২৪ at ৬:৫২ পূর্বাহ্ণ

বিষয়টি নিঃসন্দেহে নস্টালজিক। আমাদের বাসায় সেই আশির দশক থেকে রাখা হয় দৈনিক আজাদী। লোহার দরজার ফাঁক গলে একটা শিকের ওপর রেখে সাইকেলে টুং টাং আওয়াজ তুলে চলে যেতেন পেপার ওয়ালা কাকা। পাড়ার মুরুব্বীদের এভাবেই সম্বোধন করি আমি। আমাদের জীবনের সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে এমনভাবে জড়িয়ে আছে কেরোসিন কাকা‘, ‘লেইসফিতা কাকা‘, মতিন পাগলা, মাইকেল, মুন্নি পাগলি, কিংবা পরিচ্ছন্নতা কর্মী আব্দুল ও টুনু। সবাই থাকতেন আশেপাশের এলাকা জুড়েই। আজ কেবল একজনের কথাই লিখছি বিষয়ের অবতারণায়। এক ঝটকায় মনে পড়ে গেলো সবার মুখ। উনাদের মধ্যে কেবল কেরোসিন বিক্রি করতেন মতিন কাকা বেঁচে আছেন। অন্য একদিন লিখবো উনার কথা। ফিরে যাই পেপার কাকার কথায়। ছোটবেলায় সাইকেলের এই টুং টাং শব্দ মানেই ছুটে যেয়ে বাহির গেইটের সাথে যত্নে আটকে থাকা পেপার নিয়ে আব্বার হাতে দেয়া।

আস্তে আস্তে আমার আসক্তি হতে থাকে এই ‘দৈনিক আজাদী’ খবরের কাগজে। মাঝারি গড়নের, মুখে কাঁচাপাকা দাড়ির মেদহীন শরীরের সাদা পাঞ্জাবী আর লুঙ্গি পরিহিত একজন মানুষ আমাদের নিত্য দিনের অনিবার্য অংশ হয়ে গেলো। কেবল মাসের এক তারিখ বিলের কাগজ দিয়ে পেপারের বিল নেয়ার সময় তিনি অল্প কিছু সময় গেইটের কাছে সাইকেলটি দাঁড় করিয়ে টাকাটা নিয়ে নীরবে চলে যেতেন। কি অদ্ভুত কোনও দিন উনার সঙ্গে কোনও কথা হয়নি।

পেপারে প্রথমে চোখ রাখতাম সম্পাদীকয়ের উপরে লিখা একটা কোরানের বাণী, একটা হাদীস, ও একটা প্রবাদ বাক্যের ওপর। ‘সামপ্রতিক চট্টগ্রাম’, রাশেদ রউফ ভাই এর ‘অন্ত্যমিল’, সাহিত্য পাতাআমাকে এখনও ভীষণ টানে। এখনও আমার বাবা এই পত্রিকাটিই পড়েন। ঢোল কলমী নিয়ে চট্টগ্রামে একবার ভীষণ হৈ চৈ। মৃত্যু ভয়ে অস্থির সবাই। আব্বার এই বিষয়ে একটা আর্টিকেল ছিলো আগেই। সবাইকে আশ্বস্ত করতে টিভিতে আব্বার সেই লেখা নিয়ে আলোচনা করতে ডাকা হলো। পরদিন পেপারে আব্বার ঢোল কলমী নিয়ে লেখা ফিচারটি গর্ব করে সবাইকে দেখাতে পত্রিকা হাতে পেয়েই বাসা থেকে বের হই।

বৃষ্টির দিন পেপার কাকা একটা নীল রেইনকোট পরে এসে কলিং বেল বাজাতেন যেনো পেপার খানা হাতে দিতে পারেন। সময়ের স্রোতে ভাসতে ভাসতে আমি অন্য ঘরে। একদিন বাবামায়ের কাছে বেড়াতে যেয়ে লক্ষ্য করলাম এখন একটা বাচ্চা ছেলে পেপার দেয়। জানতে পারি আমাদের পেপারওয়ালা কাকা অসুস্থ। শুনে খারাপ লাগলেও দেখতে যাওয়া হয়নি। একদিন ফেসবুকের মাধ্যমে জানতে পারি আমাদের সকাল বেলার অন্যতম সদস্য আর নানান খবরের বাহক আবুল হোসেন কাকা আর আমাদের মাঝে নেই।

এই মানুষটি কখনও জানবেনা যে তার কথা কারও মনে আছে। একটা জীবনে কত শত মুখ আসে যায়, এদের মধ্যেই কেউ কেউ উঁকি দিয়ে বলে, ‘আমিও ছিলাম তোমার জীবন নাট্যের এক অনন্য সঙ্গ।’

পূর্ববর্তী নিবন্ধপৃথিবীর সকল মায়ের জন্য শুভ কামনা
পরবর্তী নিবন্ধপত্রলেখক এম এ গফুর :