সংসদে সংরক্ষিত নারী আসন ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা

| শনিবার , ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ at ১০:৫৮ পূর্বাহ্ণ

কাজী রুনু বিলকিস

কয়েকদিন ধরে পত্রিকার পাতায় একটি খবর বারবার চোখে পড়ছে। জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত মহিলা আসনে এমপি হওয়ার দৌড়ঝাঁপ! খবরটায় চোখ বুলাতে বুলাতে মনে পড়ে গেল আকিমুন রহমানের লেখার একটা উদ্ধৃতি,‘বাঙালি নারী দশকের পর দশক ধরে উচ্চ থেকে উচ্চতর শিক্ষালাভ করেছে। উচ্চ থেকে উচ্চতর পদেও আসীন হয়েছে কিন্তু ভেতরে ভেতরে তার চেতনা অজাগ্রত ও অবিকশিত একারণে নয় যে সে অপারগ। একারণে যে সে সুবিধাবাদী ও পরজীবী সম্পন্ন তাই নারীর পক্ষে এখনো হয়ে উঠা সম্ভব হয়নি স্বাধীন ও স্বায়ত্তশাসিত মানুষ।’

যারা দৌড় ঝাঁপ করছেন তাঁদের প্রতি সম্মান রেখে বলছি। তাঁরা তা করছেন সিস্টেমের কারণে। আমরা জানি ভোটে জিতে আসা প্রার্থীদের সম্মান অনেক বেশি এবং কাজ করার সুযোগও অনেক বেশি। এছাড়া নারী পুরুষের সমাধিকারের প্রশ্নে এই পদ্ধতিটা অমর্যাদাকর। ১৯৭২ সালে যখন এই আইনটি করা হয় তখন নারীরা অনেক বেশি পিছিয়ে ছিল। শিক্ষার হার ছিল কম। কর্মের সুযোগ ও কর্মক্ষেত্র অবাধ ছিল না। রাজনীতিতে নারীর প্রবেশ অধিকার ছিল খুবই সীমিত। তাই পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য কোটা সিস্টেমের প্রয়োজন ছিল। ১৯৭২ সালের সংবিধানের এক উপধারায় এই ঘোষণা দেওয়া হয় যে সংবিধান প্রবর্তন হওয়ার ১০ বৎসর অতিবাহিত হওয়ার পরবর্তীকালে সংসদ ভেঙে না যাওয়া পর্যন্ত ১৫টি আসন কেবল নারী সদস্যদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। এবং তারা আইন অনুযায়ী পূর্বোক্ত সদস্যদের দ্বারা নির্বাচিত হবেন। সেই আইনটাকে সংশোধন করে বাড়িয়ে বাড়িয়ে ২০৪৪ সাল পর্যন্ত নেওয়া হয়েছে। নারী উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকগুলো দেখলে এর যৌক্তিকতা কতটুকু তা পুনর্বিন্যাসের প্রয়োজন আছে কিনা তা আইন প্রণেতারা ভেবে দেখতে পারেন। বিভিন্ন নারী সংগঠনের পক্ষ থেকে অনেকদিন ধরে দাবি ছিল প্রত্যক্ষ ভোটে নির্দিষ্ট সংখ্যক নারী সাংসদ নির্বাচনের। সংরক্ষিত নারী আসনের জন্য কোনো সংগঠন দাবি করেছেন এমনটা আমাদের জানা নেই। দ্বাদশ সংসদে যেসব নারী প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন তারা মোটামুটি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেই উঠে এসেছেন। এটা অবশ্যই মর্যাদাসম্পন্ন। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরেপক্ষ হয়েছে কি হয়নি সেটা আমার বিষয় নয়। এই নিয়ে প্রতিদিন বিস্তর আলাপ আলোচনা আমরা দেখছি। আমার বিষয় হচ্ছে সংরক্ষিত নারী আসন বর্তমান প্রেক্ষাপটে কতটা অপরিহার্য। তিন দশক ধরে রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ নারী নেতৃত্বের হাতে। সংসদে এবং সংসদের বাইরে গুরুত্বপূর্ণপদে নারীরা তাদের সক্ষমতা ও দক্ষতার প্রমাণ রেখে চলেছেন। এটা অবশ্যই মানতে হবে সংরক্ষিত নারী আসনের চেয়ে ভোটে জিতে আসাটা প্রার্থীদের অবস্থান অনেক বেশি সম্মানজনক। এছাড়া নারীপুরুষের সমধিকার ও সমমর্যাদার প্রশ্নে এই পদ্ধতিটা মোটেও সম্মানজনক নয়। আমরা মনে করি না আমাদের নারীরা পিছিয়ে আছে। কোনো কোনো সূচকে দেখা যায় নারীরা পুরুষদের থেকেও এগিয়ে আছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্টে রাষ্ট্র ক্ষমতায় নারীর অবস্থান বিবেচনায় সবাইকে পেছনে ফেলে এক নম্বরে উঠে এসেছে বাংলাদেশের নাম। ডব্লুভিইউএফের হিসেবে নারীর সার্বিক ক্ষমতায়নে ৪৮তম অবস্থানে বাংলাদেশ। এই অবস্থানের কারণই হচ্ছে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন। নারীর উন্নয়নের সার্বিক সূচকে এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলভুক্ত ২৪টি দেশের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার পরেই দ্বিতীয় শীর্ষ অবস্থান বাংলাদেশের। নারী পুরুষের সমতা (জেন্ডার ইকুইটি) প্রতিষ্ঠায় এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবার শীর্ষে বাংলাদেশ। জাতিসংঘ সহ বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা নারী উন্নয়নের প্রশংসা করেছেন। জাতিসংঘের এমডিজি অ্যাওয়ার্ড, সাউথ সাউথ অ্যাওয়ার্ড, প্ল্যানেট ৫০৫০ চ্যাম্পিয়ন, এজেন্ট অব চেঞ্জ, শিক্ষায় লিঙ্গ সমতা আনার স্বীকৃতিস্বরূপ ইউনেস্কোর শান্তিবৃক্ষ এবং গ্লোবাল উইমেন লিডারশিপঅ্যায়ার্ডসহ অসংখ্য আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করেছে বাংলাদেশ। বিভিন্ন নারী সংগঠন ও নাগরিক সমাজ বরাবরই দাবি করে এসেছেন নীতি নির্ধারণে নারীর প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে। তার ফলে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২ সংশোধন করে ২০০৮ সালে এর বিধান করা হয় ২০২০ এর মধ্যে নিবন্ধিত সব দলের প্রত্যেক স্তরের কমিটিতে এক তৃতীয়াংশ নারী সদস্য রাখতে হবে তাতে আশা করা গিয়েছিলো জাতীয় সংসদসহ সব নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়নের সময় অন্তত এক তৃতীয়াংশ নারী থাকবেন। এবং তারা পুরুষ প্রার্থীর মতোই সরাসরি নির্বাচিত হবেন। সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনের এটাই উপযুক্ত গণতান্ত্রিক উপায়। উন্নত দেশগুলিতে এই পদ্ধতিই প্রচলিত। বদলে যাওয়া এই বাংলাদেশে সুস্থ প্রতিযোগিতায় নারীরা এগিয়ে আসুক কোনো দয়াদাক্ষিণ্যে নয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশিল্পকলায় সপ্তাহব্যাপী কর্ণফুলী সাংস্কৃতিক উৎসব শুরু
পরবর্তী নিবন্ধএকজন গৌরি গিল