দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কড়া হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সে যে–ই হোক, দুর্নীতি করলে কারও রক্ষা নেই। যারাই দুর্নীতি করবে, আমরা তাদের ধরব। গতকাল শনিবার জাতীয় সংসদে শুরু হতে যাওয়া ২০২৪–২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের সাধারণ আলোচনায় দৃঢ়তার সঙ্গে এ কথা বলেন তিনি। বাংলাদেশের জনগণকে কর্মঠ ও সৃজনশীল আখ্যা দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, (জনগণের মধ্যে) কিছু কিছু মাঝখানে দুষ্টু প্রকৃতির থাকে; ওগুলোকে ধর্তব্যে নিই না।
বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগের বিষয়ে এদিন সংসদ সদস্যদের বক্তব্যের জবাবও দেন সরকারপ্রধান। তিনি বলেন, এখন সব জিনিসের দাম বেড়ে গেছে। ঢাকায় যার এক কাঠা জমি আছে, সে কয়েক কোটি টাকার মালিক। এইভাবে অনেক সময় কিছু করতে গিয়ে অতিরিক্ত অর্থ চলে আসে। সেটা তারা বাজেটে দেখাতে পারে না, আয়কর দিতে পারে না। আয়কর দিয়ে যাতে মূল জনগোষ্ঠীতে ফিরে আসে, এ ধরনের কর্মকাণ্ড যাতে আর না করে; সেজন্য মাঝে মাঝে এ ধরনের সুযোগ দেওয়া হয়। এ সুযোগ খালেদা জিয়া নিয়েছিল, ড. কামাল হোসেনসহ আরও অনেকেই নিয়েছিল। তারা কিন্তু ২০০৬–০৭–০৮ বা পরবর্তীতে সুযোগ নিয়ে টাকা সাদা করেছিল। জেনারেল এরশাদ সাহেবও মনে হয় করেছে। খোঁজ নিতে হবে। তিনি না করলেও কেউ না কেউ করেছে। আমাদের বিরোধীদলীয় নেতা করছেন কিনা সেটা দেখতে হবে।
বিরোধীদলীয় নেতা জিএম কাদেরের বক্তব্যের জবাবে সংসদ নেতা বলেন, টেন্ডারের শুভংকরের ফাঁকির কথা উনি বলেছেন। টেন্ডার না দিয়ে কাজ দেওয়া, উনি তো মন্ত্রী ছিলেন, টেন্ডার না দিয়ে কাজ করে তার মাধ্যমে কিছু উপার্জন করার বিষয় মনে হয় উনি নিজেই রপ্ত করেছেন।
তিনি বলেন, আমাদের সুচিন্তিত কৌশল এবং গণমানুষের শক্তিকে যুগপৎ ধারণ করে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার মাধ্যমে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ব। এই বাজেট বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ এক ধাপ এগিয়ে যাবে।
মেট্রোরেল নির্মাণের বিরোধীতাকারীদের সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল চলছে। এই মেট্রোরেলে দুই লাখ ৪০ হাজার যাত্রী যাতায়াত করে। কিছু অর্থনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, মানে আঁতেল আরকি; বুদ্ধি বেচিয়া জীবিকা নির্বাহ করেন যাহারা, তারা বলেছিলেন মেট্রোরেলের কী প্রয়োজন ছিল? ৩০ হাজার কোটি টাকা খরচ না করে মেট্রোরেল না করলেই চলত। এটা তো অপচয়। তিন হাজার কোটি টাকা দিয়ে বাস কিনলেই তো যানজট মুক্ত হবে। এই হলো বুদ্ধিজীবীদের বুদ্ধি! এখন মেট্রোরেল মানুষের জীবন বিশেষ করে মহিলাদের জন্য সব থেকে নিরাপদে চলাচলের সুযোগ করে দিয়েছে। বুদ্ধিজীবীরা এখন কী বলবেন, সেটা আমার একটু জানতে ইচ্ছে করে। তাদের সাথে দেখা হলে একটু জিজ্ঞাসা করতে পারতাম।
সব বিভাগীয় শহরে মেট্রোরেল চালুর পরিকল্পনার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, এমআরটি লাইন–১, লাইন–২, লাইন–৪ ও লাইন–৫ এর কাজ পর্যায়ক্রমে ২০৩০ সালের মধ্যে সম্পন্ন করলে ঢাকা শহরে আর যানজট বলে কিছু থাকবে না। মানুষ খুব আরামে চলাচল করতে পারবে। তাদের জীবনমান উন্নত হবে। যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে সরকারের পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন হলে পূর্ব ও দক্ষিণ এশিয়ার উন্নয়নের হাব হিসেবে বাংলাদেশ গড়ে উঠবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
তিনি বলেন, সরকার দেশব্যাপী যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি করেছে বলেই অর্থনীতিতে প্রাণচাঞ্চল্য এসেছে। আমার লক্ষ্য কেবল বাংলাদেশ নয়, আমরা এশিয়ান হাইওয়ের সাথে যুক্ত হব। প্রতিবেশী দেশসমূহের সাথে রেল ও সড়ক যোগাযোগ সহজতর হবে।
বিদ্যুৎ নিয়ে সমালোচনাকারীদের উদ্দেশে সংসদ নেতা বলেন, বিদ্যুৎ নিয়ে অনেক কথা। যে বিশেষ আইন করেছি সেটা নিয়েও সমালোচনা শুনছি। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, এই বিশেষ আইন যদি না করতাম; বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র নির্মাণ না করলে আজকে বিদ্যুতটা আসত কোথা থেকে? আমরা ৩০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জন করেছি। ভবিষ্যতে বিদ্যুৎ যাতে পরিবেশবান্ধব হয় আমরা সেদিকে দৃষ্টি দিয়েছি। নেপাল ও ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির উদ্যোগ নিয়েছি।
তিনি বলেন, আমি বলে দিয়েছি আমার গ্রামে লোডশেডিং যেন না দেয়। গুলশান, বনানী, বারিধারা এসব এলাকার বড়লোকদের এলাকায় ২ হাজার মেগাওয়াট লোডশেডিং দিয়ে তাদের মনে করিয়ে দিতে হবে এখন এয়ারকন্ডিশন, গাড়ি, লিফট ইত্যাদির আরাম–আয়েশটা এটা কিন্তু আসমান থেকে পড়েনি। এটা আমাদের করা, সেটা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য অন্তত লোডশেডিংয়ের চাপ বিত্তশালীদেরও দিতে হবে। এই ব্যবস্থাটা আমরা করব।
জ্বালানি তেল মজুদ রাখার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ বছর জ্বালানি উন্নয়ন তহবিলে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বর্তমানে যে বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দিতে হচ্ছে, যা ধীরে ধীরে কমাতে হবে। এ খাতে আমরা কেন ভর্তুকি দেব? বেশি বেশি এয়ার কন্ডিশন, ফ্রিজ, লিফট চলার জন্য দেব? তা তো দেব না। দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে যেটা করার দরকার সেটা করব।
বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীদের উৎপাদন খরচটা দিতে হবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, তবে আমরা হঠাৎ করে এটা করছি না। সহনশীল করে ধীরে ধীরে এটা করা হচ্ছে। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ব্যবস্থা আমরা করছি। আমরা এলএনজিতে ভর্তুকি দিই। ভবিষ্যতে সেই ভর্তুকি দেওয়া হবে না।
সামাজিক সুরক্ষার ব্যপ্তি আরও সুগভীর করতে সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালুর কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, একটা পর্যায়ে যেন কারও মুখাপেক্ষী না থাকতে হয়, তার জন্য এই সর্বজনীন পেনশন স্কিম নেওয়া হয়েছে। আমরা দেখলাম এই পেনশন স্কিম নিয়ে কেউ আন্দোলন করে, অনেক কথা বলে। কিন্তু এই সর্বজনীন পেনশন স্কিমের সুফলটা দেশবাসী পাবে। এটার মাধ্যমে জীবনব্যাপী একটি সুরক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
বাজেট নিযে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কেউ কেউ বাজেটকে উচ্চাবিলাসী বলেছেন। কেউ বলেছে ঘাটতি বাজেট। আবার কিছুক্ষণ আগে বিরোধী দলীয় নেতা বললেন, এ বাজেট বাস্তবায়নযোগ্য না। প্রবৃদ্ধির হার কমাতে হবে, বার্ষিক উন্নয়নের হার কমাতে হবে। চ্যালেঞ্জ নেওয়ার মতো সক্ষমতা আছে কিনা? চ্যালেঞ্জ নেওয়াটাই আমাদের কাজ। চ্যালেঞ্জ নিয়ে চলতে চাই। চ্যালেঞ্জ নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি।
তিনি বলেন, আমাদের ইচ্ছা দেশের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন। সেজন্যই উন্নয়ন বাজেট। দেশের মানুষের যে উন্নয়ন করেছি, সেই গতিধারাটা যাতে অব্যাহত থাকুক, সে লক্ষ্য নিয়ে বাজেট প্রণয়ন করেছি, বাজেট দিয়েছি। এখানে কমাবার কিছুই নেই।
সরকারের চলার পথ বন্ধুর ছিল মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, বারবার এখানে বাধা এসেছে। একটা হচ্ছে দেশের ভেতরে অভ্যন্তরীণভাবে; আবার আন্তর্জাতিকভাবে নানান ঘাত–প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে আমাদের চলতে হয়েছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের পদক্ষেপের ফল বাজারে দ্রুত পড়বে আশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, আকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যাশা অনুযায়ী হ্রাস করতে পারব।
সরকারের নেওয়া বিভিন্ন উন্নয়নমূলক পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে সমালোচকদের সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের নেওয়া কিছু পদক্ষেপ তুলে ধরতে চাই। কারণ এতক্ষণ শুনলাম কিছুই করি নাই। একটা গোষ্ঠী আছেই, তাদের কিছু ভালো লাগে না। তাদের জানার জন্য বলা দরকার। দেশে কিছু আঁতেল আছেন, তারা সবকিছুতেই সমালোচনা করেন। ঋণখেলাপি নিয়ে অনেক কথা, মন্দ ঋণ নিয়ে অনেক কথা। ২০০৯ সালে জিডিপির আকার ছিল ১০২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তখন ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র ২২ হাজার কোটি টাকা। মন্দ ঋণ ছিল ১০ দশমিক ৫ শতাংশ। ২০২৩ সালে জিডিপির পরিমাণ ৪৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৫৫ হাজার কোটি টাকা। মন্দ ঋণের হার হচ্ছে ৯ দশমিক ৯ শতাংশ। অর্থাৎ এটা কিন্তু হ্রাস পেয়েছে। সেটাকে বলার সময় উল্টো টাকার অংক বলে কিন্তু শতাংশ বলা হয় না। সেখানে শুভংকরের ফাঁকি দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে। এইভাবে মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করবেন না। যারা এটা করে খুবই দুঃখজনক।