দোহাজারী–কক্সবাজার ১০২ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে পাহাড়ি এলাকার ৬৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের বনভূমি কাটা হয়েছে। ৯১ স্থানে পাহাড় কাটা হয়েছে প্রায় ১৩ কিলোমিটার। কর্তনকৃত বনভূমি এবং সাফারি পার্কের অবস্থান দোহাজারী থেকে চকরিয়া হয়ে হারবাং পর্যন্ত প্রায় ৬৭ কিলোমিটার।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সঠিকভাবে সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই প্রকল্প গ্রহণ এবং প্রকল্পের নকশায় ত্রুটির কারণে পাহাড় নিধন, পাহাড়ি ঢল ও বন্যায় কক্সবাজারের রেলপথ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বারবার। এই প্রকল্পে পরিবেশ বিপর্যয়ে রেল কর্তৃপক্ষ বাজে দৃষ্টান্ত রেখে গেছে।
পরিবেশবিদদের অভিযোগ, রেলওয়ে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ ছাড়াই নিজেদের ইচ্ছেমতো অপরিকল্পিতভাবে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ভেতরে নির্বিচারে পাহাড় ও বৃক্ষ কেটে উজাড় করে ফেলেছে। বিশেষ করে সংরক্ষিত বন, বনভূমি এবং বিলুপ্তপ্রায় বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য চুনতি, ফাঁসিয়াখালী, ডুলাহাজারা সাফারি পার্কের মধ্য দিয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত নির্মিত রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পে সংঘটিত হয়েছে পরিবেশ ধ্বংসসহ নজিরবিহীন দুর্নীতি।
এরূপ বিধ্বংসী পরিবেশ বিনাশের জন্য পুরো চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের জলবায়ুতে পড়েছে বিরূপ প্রভাব। নির্বিচারে পাহাড় ও বৃক্ষ নিধনের ফলে এখন খেসারত দিতে হচ্ছে রেলওয়েকে। ভারী বর্ষণে পাহাড় ধসে বারবার বন্ধ হয়ে পড়ছে এই রুটের ট্রেন চলাচল। রেল যোগাযোগ সাময়িক বন্ধ হওয়ার পাশাপাশি পাহাড়ি কাদা মাটিতে একাকার হয়ে পড়ছে দীর্ঘ রেলপথ। গত বছরের নভেম্বরে এই রেলপথ উদ্বোধনের পর চলতি বর্ষা মৌসুমে এই পথের কয়েক জায়গায় বেশ কয়েকবার পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটেছে। পাহাড় ধসে হারবাং এলাকায় দীর্ঘ রেলপথ পাহাড়ি কাদামাটি আর পানিতে একাকার হয়ে গেছে। দেখে মনে হতে পারে কাদা–জল মিশ্রিত কোনো ধানি জমি এটি। এখানে যে সদ্য নির্মিত একটি ব্যয়বহুল রেলপথ আছে সেটা মনেই হবে না।
এছাড়া চলতি বর্ষা মৌসুমে ডুলাহাজারা, চকরিয়া–রামু এলাকায়ও পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটেছে। এই রেলপথ নির্মাণে শুরু থেকেই অপরিকল্পিতভাবে সংরক্ষিত বনাঞ্চল, নির্বিচারে পাহাড় ও বৃক্ষ নিধনের অভিযোগ ছিল পরিবেশবিদসহ বিশেষজ্ঞদের।
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে রেলওয়ের প্রকল্প সংশ্লিষ্ট এক প্রকৌশলী জানান, দোহাজারী–কঙবাজার রেলপথ নির্মাণে সম্ভাব্যতা যাচাইসহ পরিবেশের সব দিক বিবেচনা করে নির্মাণ করা হয়েছে। প্রকল্পের নকশায় কোনো ধরনের ত্রুটি নেই। পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য নষ্ট করে কিছু করা হয়নি। যেটুকু পাহাড় কাটা হয়েছে পরিবেশসম্মতভাবেই হয়েছে। রেলপথ নির্মাণের সাথে সাথে ৫ লাখের মতো গাছ লাগানো হয়েছে। হাতি চলাচলের পথ নির্মাণ করা হয়েছে। এই পথ দিয়ে নিয়মিত হাতি চলাচল করছে। পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে কিছুই করা হয়নি।
পরিবেশবিদ ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা জানান, ব্যাপকভাবে কর্তনকৃত বৃক্ষরাজির অবস্থান দোহাজারীর জঙ্গল চুনতি, নাপিতখালী ও হারবাং ফুলছড়ি। এখানে কাটা হয় ১০২ প্রজাতির প্রায় ৫ লাখ গাছ। এদের মধ্যে ৫০ প্রজাতির প্রায় ৩ লাখ, ৬ প্রজাতির প্রায় ৬৫০টি ঔষধি গাছ, ৩৫ প্রজাতির প্রায় ২ লাখ সাধারণ ফলদ ও বনজ গাছ। নির্মিত রেলপথটি নদী, পাহাড়, পাহাড়ি জলধারা এবং সমুদ্রের খাঁড়ি অতিক্রম করেছে ১৭৭টি স্থানে। হাতি চলাচলের পথ ধ্বংস হয়েছে ১১টি স্থানে। বিশ্বে সংরক্ষিত বন, বনজ সম্পদ, পাহাড় আর বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল ধ্বংস করে রেলপথ নির্মাণের এরূপ নজির বাংলাদেশ ছাড়া আর কোথাও হয়নি।
পরিবেশগত প্রভাব বিবেচনায় প্রকল্পটি এডিবির ‘এ’ ক্যাটাগরিতে পড়ে। অর্থাৎ এ অঞ্চলে রেলপথ নির্মাণ করা হলে তা এর জলবায়ু ও জীববৈচিত্র্যের প্রাণ ধারণে যে ভয়াবহ পরিবর্তন ঘটাবে, সেটাকে কখনোই পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনা যাবে না–এমনটি মনে করছেন পরিবেশবিদরা।
১৪ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম–কঙবাজার রেললাইনে পাহাড় ধসে পড়ে। টানা দুদিন ধরে অতি বৃষ্টির ফলে পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে। এর আগে আগস্টে রেললাইনের দুই স্থানে পাহাড় ধসে পড়ে ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল।
চকরিয়া উপজেলার হারবাং ইউনিয়নের ৯ নং ওয়ার্ডের গাইন্যাকাটা এলাকায় রেললাইনের ওপর পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে বলে জানান চকরিয়া স্টেশন মাস্টার ফরহাদ চৌধুরী।