সংকট উত্তরণে অর্থবহ সহযোগিতার ডাক

জাতিসংঘে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ

| শনিবার , ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ৮:৩৬ পূর্বাহ্ণ

করোনাভাইরাসের মহামারী যে জরুরি সঙ্কট সামাল দিতে আন্তর্জাতিক উদ্যোগের ঘাটতিগুলোও দেখিয়ে দিয়েছে, সে কথা বিশ্ব নেতাদের মনে করিয়ে দিয়ে সব সঙ্কীর্ণতার উর্ধ্বে উঠে ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ উত্তরণের লক্ষ্যে ‘অর্থবহ’ সহযোগিতার ডাক দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। খবর বিডিনিউজের।
বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের নেতা হিসেবে গতকাল শুক্রবার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৬তম অধিবেশনে দেওয়া বক্তৃতায় তিনি বলেছেন, দুঃখজনক হলেও এই মহামারী আরও বেশ কিছুদিন স্থায়ী হবে বলে মনে হচ্ছে। সেজন্য এ অভিন্ন শত্রুকে মোকাবিলা করার জন্য অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন আমাদের অনেক বেশি নতুন, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বৈশ্বিক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। ২০১৯ সালের শেষে চীন থেকে ছড়াতে শুরু করে পুরো বিশ্ব দখল করে নেওয়া করোনাভাইরাস ইতোমধ্যে ২৩ কোটির বেশি মানুষকে আক্রান্ত করেছে, মৃত্যু ঘটিয়েছে সোয়া ৪৭ লাখ মানুষের। এ বছর নতুন আশা হয়ে এসেছে টিকা, কিন্তু অন্য সব বিষয়ের মত করোনাভাইরাসের টিকা পাওয়ার ক্ষেতেও ধনী আর গরিব দেশের মধ্যে বৈষম্য প্রকট। এই বৈষম্য ঘুচিয়ে সবার জন্য ন্যায়সঙ্গত ও সাশ্রয়ী মূল্যে টিকার প্রাপ্যতা নিশ্চিত করার দাবি আবারও জাতিসংঘে তুলে ধরেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।
ভাষণের শুরুতেই তিনি বলেন, সাধারণ পরিষদের এই ৭৬তম অধিবেশনটি এমন এক সময়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যখন কোভিড-১৯ বিশ্বজুড়ে অব্যাহতভাবে মানুষের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে। করোনার নতুন ধরনের মাধ্যমে অনেক দেশ বার বার সংক্রমিত হচ্ছে। এ মহামারীতে গোটা বিশ্বের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।
আর এই বিপর্যয় কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে, বিশ্বকে আবারও শান্তি, সমৃদ্ধি আর অগ্রগতির পথে নিয়ে যেতে শেখ হাসিনা টেকসই পুনরুদ্ধারের ওপর জোর দিয়েছেন বার বার, যে বৈশ্বিক পরিকল্পনা হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক, যেখানে কেউ পেছনে পড়ে থাকবে না। সেজন্য বিশ্বকে উদ্যোগী হওয়ার তাগিদ দেওয়ার পাশাপাশি এবারের ভাষণে ছয় দফা প্রস্তাব তিনি বিশ্বনেতাদের সামনে তুলে ধরেছেন।
সেখানে টিকার প্রসঙ্গ যেমন এসেছে, তেমনি এসেছে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর কথা, কোভিড মহামারী যাদের আরও বেশি ক্ষতির মুখে ফেলে দিয়েছে। মহামারীর প্রকোপে বিপর্যস্ত শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো এবং সঙ্কটে পড়া অভিবাসীদের কর্মসংস্থান ও কল্যাণ নিশ্চিত করার দাবি প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘের সামনে এনেছে। সেই সঙ্গে পাঁচ বছর ধরে ঝুলে থাকা রোহিঙ্গা সমস্যার একটি স্থায়ী সমাধান খুঁজে বের করতে আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের ‘জোরালো ভূমিকা’ চেয়েছেন তিনি। করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে গতবছর জাতিসংঘের ইতিহাসে প্রথমবারের মত সাধারণ পরিষদের অধিবেশন বসে ভার্চুয়ালি। এ বছর সশরীরে সাধারণ পরিষদের ৭৬তম অধিবেশনে মিলিত হয়েছেন বিশ্ব নেতারা।
বঙ্গবন্ধু হত্যায় ন্যায়বিচারের প্রত্যাশা : প্রায় পাঁচ দশক আগে বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের নির্মমভাবে হত্যার ন্যায়বিচার পাওয়ার প্রত্যাশার কথা জাতিসংঘে তুলে ধরলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৬তম অধিবেশনে দেওয়া ভাষণে তিনি এই প্রত্যাশার কথা বলেন। তিনি বলেন, সারা বিশ্বে শান্তি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার এই মহান সংস্থার সামনে বিগত প্রায় ৪৬ বছর আগে আমার পরিবারের সদস্যদের নির্মমভাবে হত্যার ন্যায়বিচার পাওয়ার প্রত্যাশার কথা তুলে ধরতে চাই।
টিকা হোক সবার : ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ উত্তরণের লক্ষ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধির যে ছয় প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে তুলে ধরেছেন, তার শুরুতেই রয়েছে করোনাভাইরাসের টিকার প্রসঙ্গ। লক্ষ লক্ষ মানুষকে টিকা থেকে দূরে রেখে কখনোই টেকসই পুনরুদ্ধার সম্ভব নয়। আমরা পুরোপুরি নিরাপদও থাকতে পারব না। তাই আমি আবারও আহ্বান জানাচ্ছি, সবার জন্য ন্যায়সঙ্গত ও সাশ্রয়ী মূল্যে টিকার প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। সংহতি আসুক জলবায়ু প্রশ্নেও : প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ মহামারী জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এর মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক আন্তঃসরকার প্যানেল যে প্রতিবেদন দিয়েছে, তাতে পৃথিবীর পরিস্থিতির আরও ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে। দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে জলবায়ু পরিবর্তনের ধ্বংসাত্মক প্রভাব কাটিয়ে ওঠা কঠিন হবে।
শিক্ষার ক্ষতি পূরণ : জাতিসংঘ শিশু তহবিলের তথ্য অনুযায়ী, মহামারীর মধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বিশ্বের প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিগত বছরগুলোতে শিক্ষা খাতে নিম্ন আয়ের দেশগুলোর যে অর্জন, তা হুমকির মুখে পড়েছে। এই বাস্তবতা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী ডিজিটাল সরঞ্জাম ও সেবা, ইন্টারনেটের সুযোগ-সুবিধার সহজলভ্যতা ও শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে আরও বিনিয়োগ করার আহ্বান জানান।
এলডিসি থেকে উত্তরণ : মহামারীর নজিরবিহীন প্রতিকূলতার মধ্যেই বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণের সুখবর পেলেও এ মহামারী অনেক দেশের উত্তরণের আকাঙ্ক্ষাকে যে বিপন্ন করেছে, সে কথা জাতিসংঘে তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।
অভিবাসীদের কল্যাণ : শেখ হাসিনা বলেন, এই মহামারীর মধ্যেও প্রবাসীরা অপরিহার্য কর্মী হিসেবে স্বাস্থ্য ও অন্যান্য জরুরি সেবাখাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন, তারাও সম্মুখসারির যোদ্ধা। তবুও তাদের অনেকে চাকুরিচ্যুতি, বেতন কর্তন, স্বাস্থ্য ও অন্যান্য সামাজিক সেবার সহজলভ্যতার অভাব ও বাধ্যতামূলক প্রত্যাবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
রোহিঙ্গা সঙ্কট : রোহিঙ্গা সঙ্কট এবার পঞ্চম বছরে গড়িয়েছে, কিন্তু নিপীড়িত এই জনগোষ্ঠীর একজনকেও এখন পর্যন্ত মিয়ানমারে তাদের মাতৃভূমিতে ফিরিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়নি। এর মধ্যে মিয়ানমারে সামপ্রতিক রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে অনিশ্চয়তা আরও বেড়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ সমস্যার একটি স্থায়ী সমাধান খুঁজে বের করতে আমরা আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের জোরালো ভূমিকা ও অব্যাহত সহযোগিতা আশা করি। মিয়ানমারকে অবশ্যই তার নাগরিকদের প্রত্যাবর্তনের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে হবে। এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমরা আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়কে সহযোগিতা করতে সদা প্রস্তুত।
মহামারীতে বাংলাদেশ : জাতিসংঘে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশে কোভিড-১৯ মহামারীর প্রকোপ ‘আশঙ্কার চেয়ে অনেক কম’ হয়েছে। তৃণমূল পর্যায় থেকে আমাদের শক্তিশালী স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কারণে এটা সম্ভব হয়েছে। এ ছাড়া এ মহামারী মোকাবিলায় আমাদের সময়োচিত, সমন্বিত ও বহুমুখী উদ্যোগ কার্যকর ভূমিকা রেখেছে।
আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ আফগানদের ওপর : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আফগানিস্তান কোন পথে যাবে তা সে দেশের নাগরিকদের ওপরই নির্ভর করবে এবং তাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের সাথে বাংলাদেশ কাজ করে যেতে প্রস্তুত।

পূর্ববর্তী নিবন্ধইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেকের ৫৯তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ
পরবর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামবাসী না চাইলে চাপিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন নেই